কাউসার মাহমুদ : নিশুতি রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার শুকনো আওয়াজ গান হয়ে বাজে প্রান্তর কানে। কি এক আনমনা সুরে মন ছুটে যায় পেছনের বাগানটায়। যেখানে রাতে ঝিঁঝিঁ দলের স্বর্গ রাজ্য নামে। প্রান্ত ‘অনেক ভেবেছে কিন্তু কিছুতেই কিছু মেলাতে পারছে না। ভেতরে শুধু একটা নিরুদ্দেশ টান অনুভব করছে আজ রাতে।
মনে আছে গতবছর ভরা পূর্ণিমায় ওর জন্মদিন ছিলো। সেদিন সন্ধেবেলা কি ভেবে যেন ও পেছনের বাগানে গিয়েছিল একবার! কালো আকাশে তখন অন্ধকারের পাতা বিছানো। পূর্ণিমা রাত কি কখনো অন্ধকার হয়! প্রান্তর বুঝে আসে না। মনে মনে সে ভাবে আজ তো আকাশ আলোজ্বলা থাকার কথা ছিলো! তাহলে এ কিসের অন্ধকার? ছোট্ট মনের ছোট্ট ভাবনা। সেখানে অতো কিছু ভাবার সময় কই। ‘প্রান্ত’ তাড়াহুড়া করে ঘরে ফিরছিল, হঠাৎ দেখে কি একটা যেন নীচু গাছটার দু’পাতার ফাঁকে জ্বলজ্বল করছে। প্রান্তর ভালোলাগে! সে ঐ আলোর কাছে যায়। গিয়ে দেখে ঝিঝি পোকার মতই কিছু, তবে এটা একটু বড় ও আলাদা ধরনের প্রাণী। দু’পাতার ফাঁকে আটকে আছে তার ছোট্ট ডানা দুটি। কোনভাবেই ডানা দু’টি ছাড়াতে পারছে না সে। প্রান্ত’কে দেখে ওটা ‘ঝিঁঝিঁ’ ডাক দেয়া শুরু করে। প্রান্তর খুব মায়া হয় ওটাকে দেখে। এক অদ্ভূত ভালোলাগা সেই সন্ধ্যায় প্রান্তকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। পরম আদরে ‘প্রান্ত’ পোকাটাকে ওখান থেকে বের করে আনে। তার হাতের তালুতে রেখে হালকা করে ফুঁ দেয়, যেন আকাশে উড়ে যায়।
কিন্তুু আশ্চর্য! ওটা যায় না। ‘প্রান্তর’ দিকে মুখ করে কাঁদো কাঁদো স্বরে ঝিঁঝিঁ ডাকছে বরং। সঙ্গে তার শরীরে এক প্রকার আলো জ্বলছে আর নিভছে। এভাবে প্রায় অনেকক্ষণ থাকার পর, একসময় পোকাটি আকাশে উড়ে যায়। ‘প্রান্ত’ তার যাওয়া দেখতে আকাশের দিকে মুখ করে তাকায়। অথচ অদ্ভূত! সেটা ওপরে উঠছে তো উঠছেই। একনাগাড়ে আকাশের দিকেই উড়ে যাচ্ছে। যেন আকাশ ভেদ করে খুব দূরে কোথাও চলে যাবে। যখন তার শরীরের শেষ আলোটুকু অদৃশ্য হয়ে যায়।
তারপর! আর সাত, পাঁচ না ভেবে ঘরে চলে আসে ও। মধ্যরাতে ওর বন্ধু- আত্মীয়রা জন্মদিন শেষ করে সব্বাই ঘুমুতে গেছে। প্রান্ত’ও তার রুমে ঘুমুতে এসেছে। প্রান্ত’র শোয়ার ঘর থেকে আবার বাগানটা স্পষ্ট দেখা যায়। জানালা দিয়ে কতো রাত্তিরে সে চাঁদের বুড়ীর সঙ্গে মন দেয়া নেয়া করেছে। তারায় তারায় দেখা-অদেখার খেলা প্রান্ত এখনো খেলে। জোৎস্নায় যেন তার জানালায় আলোবৃষ্টি ঝরে। তাই প্রতি রাতেই ‘প্রান্ত’ নিয়ম করে আকাশ দেখতে বসে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শোবার আগে প্রান্ত একবার জানালায় বসে। হঠাৎই চোখ পড়ে সন্ধের সেই আলোমাখা ঝিঁঝিঁ পোকাটার দিকে। সামনের চালতে গাছের একডালে সে নিশ্চুপ বসে আছে। যেন নিবীড় ভাবে প্রান্তকে দেখছে। প্রথমটায় ‘প্রান্ত’ চমকে গেলেও, তার কৌতূহল তাকে ঝিঁঝিঁ পোকার দিকে দৃষ্টি বেঁধে রাখতে বাধ্য করে। পোকাটাও তাকে দেখে মিষ্টি করে ডাকতে শুরু করে। এবং সাথে মিল করে তার শরীরের সে রহস্যময় আলোটুকুও ছড়াতে শুরু করে। ঘুরে ঘুরে সে এ ডাল থেকে ও ডালে যায়। প্রান্তর ভালোলাগে। যেন চোখের ইশারায় নাচছে ঝিঁঝিঁ পোকাটা। তারপর থেকে প্রত্যেকদিন একটা করে ঝিঁঝিঁ পোকা বাড়তে থাকে চালতার ডালে। তারা গান ধরে, প্রান্তর ভালোলাগে খুব। কিন্তুু প্রান্ত কখনো বের হয়নি তার ঘর ছেড়ে। এখন হাজার হাজার ঝিঁঝিঁ পোকা বাগান ভরে ঘুরে ঘুরে ডাকতে থাকে। একসঙ্গে তাদের সুরটা বেশ মিষ্টিই লাগে প্রান্তর কাছে। বুকের ভেতরে কেন যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। আজকেও ভরা পূর্ণিমা। আকাশে চাঁদের হাট বসেছে। চারধার যেন আলোকন করা। তারার পায়ে পায়ে আলোকছটা। পেছনের বাগানে জোনাকিপোকারা দলছুট হয়ে উড়ছে। যে যার মতো এখানে ওখানে আলো বিলিয়ে সুখ দিচ্ছে। ঝিঁঝিঁ পোকারা আজ উন্মাদ। তাদের ডাকে যেন কোন বিরাম নেই। নিরবিচ্ছিন্নভাবে তারা ডেকেই চলছে। প্রান্ত জানালার ওপাশে বসে সৃষ্টির এ নিপুণ সৌন্দর্যরূপ দেখছে গভীরভাবে। সামনের চালতার ডালে সেই আলোমাখা ঝিঁঝিঁ পোকা বসে যেন প্রান্তর চোখ পাহারা দিচ্ছে। একেবারে চোখে চোখ রেখে অদ্ভূত আহ্বান। প্রান্তর ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এক স্নিগ্ধ ভালোলাগা কাজ করে মনের ভেতর। গত পূর্ণিমা থেকে আজ অবধি পোকাটা প্রতি রাতে ঠিক এভাবেই এখানে আসে। আজকেও পূর্ণিমা। তাই প্রান্তর ঐ ঝিঁঝিঁ পোকাটাকে একটু ছুঁতে ইচ্ছে করলো। আনমনেই প্রান্ত হাত বাড়িয়ে দেয় জানালার বাইরে। ধীর মন্থর গতিতে মায়াবী আলো জ্বেলে ঝিঁঝিঁ পোকাটা প্রান্তর আঙ্গুল ছোঁয়।
প্রান্তর গাটা কেমন শীতল স্নিগ্ধ আবেশে মুড়িয়ে যায়। চোখ বন্ধ হয় প্রান্তর। ধীরে ধীরে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে প্রান্ত। পৃথিবীর যত অনিন্দ্য সুন্দর পথ মাড়িয়ে কোথায় যেন প্রান্ত ছুটছে। মাথায় তাজ পরা একটা সাদারঙের ঘোড়ায় চরে উড়ছে প্রান্ত। সবুজ বন বনান্তর, আলো দিঘীর জল, পাহাড়, ঝর্ণা, আকাশ সবকিছু ছাপিয়ে সেই কোন দূরদেশে নিয়ে যাচ্ছে ঘোড়াটি তাকে। পথে পথে কুঞ্জবন রেখে এসেছে ও। সাতরঙা গোলাপের বাগান। বাহারি ফুলের স্তবক। পরীদের সাদা পাখায় ভর করে উড়ে যাওয়া। এভাবে নীলাকাশ ছুঁয়ে কোন এক স্বর্গে গিয়ে যেন উঠলো প্রান্ত।
এ স্বর্গের চারাপশ জুড়ে ফানুস উড়ানো। জোৎস্নার আলোর মত আধা আলোকন। একটু সামনে যেতেই চোখে পড়লো একটা সর্পিল রাস্তা। টকটকে লালরঙের মখমখলের গালিচা পাতা পুরো রাস্তায়।
ওর বয়সই ছোট ছোট মেয়ে বাচ্চারা দু’ধারে দাঁড়িয়ে। কেমন নেশালাগা নীল চোখ তাদের। পেছনে আবার দুটো ডানা আছে ওদের। এরা ছোট পরী। সোনালী চুলের একগোছা করে তাদের কপালে ছড়িয়ে আছে।
সবার হাতে একটি করে ফুল ভরা রুপোর থালা। প্রান্তর অপেক্ষায় অভ্যর্থনা মিছিল যেন। এ ঐশ্বর্য সুন্দরে বুদ হয়ে আছে প্রান্তর চোখ। গালিচা বিছানো রাস্তা ধরে এগুতে যাচ্ছে, পা বাড়াতেই সারা শরীর যেন গোলাপের পাঁপড়িতে ডুবে গেল। সেই ছোট্ট সোনালি চুলের পরীরা মৃদুসুর ধরে প্রান্তর গায়ে ফুল ছেটাচ্ছে ।
পথের শেষে একটা ধবধবে সাদা বিস্তৃত প্রাসাদ। এর শেষ কোথায় দেখা যায় না। প্রান্তর ভেতর শিহরণ জাগে। প্রাসাদের সামনের ফটকটা যেন আস্ত একটা স্বর্ণের দেয়াল। ইয়া উঁচু। কাছে যেতেই আপনা আপনিই খুলে গেল সেটি। ভেতরে ঢুকে দেখে এ যেন এক স্বপ্নের জগৎ। দেয়ালে টানানো বিচিত্র রকমের কত কিছু। কোনদিন কোথাও এগুলো দেখেনি প্রান্ত। কাঁচা ফুলের মাদকতা মাখা গন্ধ পুরো ঘর জুড়ে। প্রান্ত কোথায় বসবে কি ধরবে কিছুই বুঝতে পারে না।
হঠাৎ দেখে সেই ঝিঁঝিঁ পোকাটি। তার জানালার ওপাশে চালতার ডালে বসে থাকা সে ঝিঁঝিঁ পোকা। এক ভরা সন্ধ্যায় যাকে দু পাতার ফাঁক থেকে ছাড়িয়েছিল। হাতের তালুতে রেখে সেটাকে আকাশে উড়িয়েছিল প্রান্ত। যাওয়ার সময় কি রকম কৃতজ্ঞ মায়ামাখা দৃষ্টি ছিল ঝিঁঝিঁর চোখে। আজও সে একই রকম দৃষ্টি নিয়ে বিশাল এক পালঙ্কে বসে আছে ওটা। প্রান্তর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে তার দৃষ্টি। প্রান্ত আলগোছে প্রথমদিনের মত আবার তাকে আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দেয়।
এবার এক অদ্ভূত কা- ঘটে!
ঝিঁঝিঁ পোকা তার সঙ্গে কথা বলে। প্রান্তর আঙ্গুলে বসে তার ডগায় মাথা ঘষে বলে ‘তুমি আমার বন্ধু’।
আমিই তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি। এই যা কিছু দেখছো। এর পুরোটাই আমার সা¤্রাজ্য। আমিই এখানকার রাজা। পৃথিবীর ঝিঁঝিঁ পোকাদের সর্দার আমি। অনেকদিন আগে তুমি যখন আমাকে বাঁচালে, তখন থেকেই আমি তোমাকে দেখে রাখি। জানালার ওপাশে বসে প্রতিরাত তোমাকে পাহারা দিতাম আমি।
জানো!
সেই সন্ধেতে আমার ‘শক্তি কাঠি’ হারিয়ে যায়। ওটা ছাড়া আমার এতটুকুন শক্তি থাকে না উড়ার। তবে মানুষের হাতের স্পর্শে আমি আবার উড়তে পারি। কিন্তুু একটা মানুষ ও তো নেই! এই সন্ধ্যায় আমাকে বাঁচাতে আসবে কে? ধরবেই বা কে? আমি আমার মৃত্যুর সময় গুনছিলাম। তখনই তুমি কি মনে করে বাগানে এলে। আমাকে ছুঁইয়ে আকাশে উড়িয়ে দিলে।
আমি আমার ওড়ার শক্তি পেয়ে আমার সা¤্রাজ্যে ফিরে আসি। সেখান থেকে আবার আমার ‘শক্তি কাঠি’ খুঁজে বের করি জাদুর সাহায্যে।
তারপর থেকেই তো তোমাকে আমি ভালোবাসি বন্ধু।
আজ থেকে আমরা পূর্ণ বন্ধু হয়ে গেলাম। তোমার যখনই কোথাও বেড়াতে ইচ্ছে করবে তুমি এটাকে ছোঁবে! এখন থেকে তুমি সবখানেই যেতে পারবে এই জাদুর কাঠি দিয়ে। এই বলে প্রান্তকে একটা ‘কাঠি’ দিল ঝিঁঝিঁ সরদার। প্রান্ত ধন্যবাদ জানিয়ে সেটা দু’হাতে গ্রহণ করল।
ভোরের আযান হচ্ছে চারপাশে। পাখিদের ঘুম ভেঙে গেছে এতোক্ষণে। কিচিরমিচির করে পুরো বাগানে এক নৈসর্গিক সুর সৃষ্টি করে ওরা। প্রান্তরও ঘুম ভাঙে। আধবোজা চোখেই মনে পড়ে গতরাতের স্বপ্নের কথা। বিসমিল্লাহ বলে বালিশের নীচে হাত দিয়েই দেখে সেই জাদুর কাঠিটা আছে কিনা। সেই রুপো ঝলমল কাঠি। আচ্ছা পুরোটাকি স্বপ্ন ছিল? মনে হয় না। স্বপ্ন তো এত বাস্তব হয় না।
প্রান্ত জানালার পাশে এসে চালতার ডালে তাকায়। আবার কখন সন্ধ্যে নামবে। ঝিঁঝিঁ বন্ধুর সঙ্গে তার আজ কথা বলতেই হবে! আচ্ছা কাঠিটা কই, হ্যাঁ?
মাসিক পাথেয়, মে ২০১৮