ফাগুনে কৃষ্ণচূড়া | শেখ নাঈমুল ইসলাম

ফাগুনে কৃষ্ণচূড়া | শেখ নাঈমুল ইসলাম

ফাগুনে কৃষ্ণচূড়া ● শেখ নাঈমুল ইসলাম

২০০৮ সাল। পড়াশোনার জন্য ঢাকায় প্রথম এসেছি। উঠেছি মেজ ভাইয়ের বাসায় পুরান ঢাকায়। প্রথম প্রথম মেনে নিতে পারছিলাম না এই জাদুর শহরকে। খুলনার পরিষ্কার-প্রশস্ত রাস্তায় ভোরবেলা শিউলি ফুলের ঘ্রাণ মেখে চলা, সন্ধ্যায় হাসনাহেনার সৌরভ নিয়ে চলা, রুপসা আর ভৈরব নদীর প্রাণজাগানিয়া বাতাস বুক ভরে নেওয়া এই আমি জনসমুদ্র আর ধুলোভরা শহরকে মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল ঢাকায় থাকতে। এরই মধ্যে কথা হলো যে আমরা বই মেলায় যাব।

আমাদের নিয়ে ভাইয়া যেদিন প্রথম বই মেলায় গেলেন, সেই প্রথম আমি অনুভব করি এই ধুলোভরা শহরের অন্তত একটা জায়গা আছে যেখানে গিয়ে আমি বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারবো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে না। সেটা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা।

সেদিন ছিলো ২০ ফেব্রুয়ারী, তখন বই মেলা হয় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে তিন ভাই-বোন মিলে গেলাম বই মেলায়। রিক্সা থামলো ঢাকা মেডিকেলের সামনে। আর যাওয়া যাবে না কারণ রাস্তা ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। সামনে এগিয়ে প্রথম দুচোখ ভরে দেখি ফাগুনে কৃষ্ণচূড়ার মাঝে স্ব-গর্বে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনার। তার সামনে দেখি এক অপরূপ দৃশ্য!

শতশত ছেলেমেয়ে শহীদ মিনারের সামনে রাস্তায় উঁবু হয়ে বসে আল্পনা আঁকছে। অসংখ্য মানুষ তা দেখছে। বিভিন্ন সাংবাদিক, পর্যটক ছবি তুলছে। সেই প্রথম আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার প্রেমে পড়া। আমি মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে সামনে এগোই। দোয়েল চত্ত্বর পর্যন্ত একই অবস্থা দেখি। পুরো রাস্তা বন্ধ করে আল্পনা আঁকছে শতশত তরুণ তরুণী।

এভাবে দেখতে দেখতে ঢুকলাম বই মেলায়, ঢোকার মুখে লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় আমার সামনে থাকা বিপুলাকায় এক তরুণী ঘুরতে গিয়ে আমার সাথে ধাক্কা লাগলে পরে আমি তিন চক্কর দিয়ে আবার জায়গায় দাঁড়ালে সে যে ভঙ্গিতে আমাকে স্যরি বলেছিলো সেই হাসির দৃশ্য আজও চোখে ভাসে।

ভীড় ভেঙে মেলায় ঢোকার পরে একটার পর একটা স্টল ঘুরি আর মুগ্ধ হই। ভাইয়া আমাকে নজরুলের কাব্য ‘অগ্নিবীণা’ আর ‘সঞ্চিতা’ কিনে দিলেন। সেই আমার প্রথম বই মেলা থেকে বই কেনা। ফাল্গুনের বাংলা একাডেমির মেলা প্রাঙ্গণের আম গাছ ভর্তি মুকুলের ঘ্রাণ আমায় আজও আন্দোলিত করে।

সেই থেকে আজ অবদি আমি সারা মাস যতই যাই না কেন ২০ ফেব্রুয়ারী হচ্ছে আমার বই মেলায় যাওয়ার বিশেষ দিন। দেখতে দেখতে প্রায় ১২ বছর হয়ে গেল। এই ১২ বছরে একবারের জন্যেও আমার ২০ ফেব্রুয়ারি বই মেলায় যাওয়া বাদ যায়নি।

সময় পাল্টেছে, সেই সাথে পাল্টেছে বই মেলার স্থান, ভাবগাম্ভীর্যতা, আর পরিবেশ। এখন আর পুরো এলাকা জুড়ে আল্পনা আঁকা হয় না। শতশত তরুণ তরুণীর আল্পনা আঁকা অবস্থায় প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা চোখ আর দেখা যায় না। দোয়েল চত্ত্বর থেকে বাংলা একাডেমির রাস্তায় ঢুকলে বসন্ত বাতাসে মন কেমন করে উঠে না। মুকুলের গন্ধে আমোদিত হয় না এই প্রাণ। নাম না জানা অনেক ফুলের গন্ধে চিত্ত উদ্বেলিত হয় না এখন আর।

সেখানেও ভরে গেছে ধুলাবালি আর ডেভেলপমেন্ট এর নামে মেট্রোরেলের দানবসদৃশ পিলার। উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পিলারের ভীড়ের মাঝে ঐতিহাসিক রমনা গেটের পিলার লজ্জায় ম্রিয়মাণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো ভোগবাদী এই সমাজে এটাকেই ডেভেলপমেন্ট বলে। তবে কথা হলো যে, একটি জাতির ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং স্থাপনার জড়-ই যদি উপড়ে ফেলা হয় তাহলে বাঁচে কি?

লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *