ফিদায়ে মিল্লাতের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি (পর্ব-২)

ফিদায়ে মিল্লাতের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি (পর্ব-২)

জমিয়তে উলামার নেতৃত্ব গ্রহণ : তাঁর কর্মপন্থা

জমিয়তে উলামা বুযর্গদের মহান মর্যাদাপূর্ণ দল এবং হযরত (রহ.) এই দলের উন্নয়ন সাধনে উপমাহীন কুরবানী দিয়েছেন। আর তা বুঝেই জিন্দেগী পার করে দিয়েছেন এবং হযরতের (রহ.) বারাকাত দলীয় প্লাটফর্ম থেকে শুরু করে সর্বত্র লক্ষণীয়। তন্মধ্যে সেই প্রাথমিক ক্রান্তকাল, যে সময়ে তিনি দলের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন তখনকার সময়ে অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্ব বিদ্যমান ছিলেন, যাঁরা দলকে নিজ পদ্ধতি ও পন্থায় পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। হযরত (রহ.) প্রভাব বিস্তার কিংবা দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর হযরত (রহ.) কী পথ ও পন্থা অবলম্বন করেছিলেন? সেই যামানা আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারিনি। তথাপি নিজ অবগতি থেকে কতিপয় বিষয় বিশেষভাবে আলোচনা করতে প্রয়াস পাব।

হযরত (রহ.) জমিয়তে উলামার এই অনন্য বৈশিষ্ঠ্যের সর্বাধিক বিকাশ ঘটিয়েছেন মুসলমানদের চিন্তাধারাকে দিক নির্দেশনা করে। তিনি বৈশিষ্ট্যের প্রতি অধিক জোর দিয়েছেন। উদাহরণতঃ বাবরি মসজিদের ঘটনা ঘটল। তখন মুসলমানদের নয়ন তারকা হওয়ার জন্য এর চেয়ে উত্তম সময় সুযোগ আর ছিল না এবং কিছু লোক হয়েও গিয়েছিলেন। হিন্দুস্তানের মুসলমান নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেবল মওলানা আসআদ মাদানী (রহ.) এমন নেতা ছিলেন, যিনি ব্যক্তি স্বত্ত্বার লাভ ক্ষতির প্রতি মোটেও পরওয়া না করে মিল্লাতকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে নেতৃত্বের হক তথা দাবী আদায় করেছেন। যখন লোকজন আক্রমণাত্মক ছিল এবং হিন্দুস্থানে বড় বড় নেতা তৈরী হয়ে গিয়েছিলো, তখন হযরত আসাআদ মাদানী রহ, নীরব ছিলেন এবং এই কথা বলতেছিলেন যে, ‘এই লড়াই রাজপথে নয় বরং আদালতে লড়তে চাই’। এটা অত্যন্ত অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন বক্তব্য ছিল ।

তখনকার কথা আমার ভালোভাবেই স্মরণ আছে, আমার ছাত্র জীবন ছিল। একদিন খান জাহানপুরে আমার ফুফা মাওলানা সাইয়্যিদ মুহাম্মদ নাঈম সাহেবের বাড়িতে যাওয়ার জন্য হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) ফজরের নামাযের আগেই দেওবন্দ থেকে রওয়ানা হলেন এবং ফজরের নামায সেখানে পড়লেন। আমাদের ফুফুও সেখানে ছিলেন, নাস্তা করলেন। মাওলানা সাইয়্যিদ নাঈম সাহেবের বড় ভাই সাইয়্যিদ আনিস সাহেবও বাড়িতে ছিলেন। তিনিও নাস্তায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি আবার হযরতের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ছিলেন। তখন বাবরি মসজিদের বিষয়টি বেশ সরগরম ছিল। তো তিনি এই বিষয় নিয়েই শুরু করলেন, ভাই সাহেব, (সাইয়্যিদ আনাস সাহেব হযরতকে ভাই সাবে বলে সম্মোধন করতেন) জমিয়তে উলামা দেশের মুসলমানদের এত বিরাট একটি দল, সর্বক্ষেত্রেই তা অনেক মহান নেতৃত্বের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ জানেন, আপনার কি হলো আপনি নীরব বসে আছেন? এখনি সময় সামনে অগ্রসর হয়ে মুসলমানদের নেতৃত্ব দিবেন। আমাদের হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) অত্যন্ত ধৈর্য্য ও নিশ্চুপ হয়ে তাঁর তিক্ত-কড়া বক্তব্য সবই শুনতে থাকলেন। বাবরি মসজিদ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের প্রশংসা শুনেও খামোশ রইলেন। চেহারায় কোনো রেখাপাতই নেই। ধীরস্থিরভাবে নাস্তা করছেন।

যখন তাঁর কথা শেষ হলো, জিজ্ঞেস করলেন, আনিস সাহেব! আপনার বক্তব্য শেষ হলো? তিনি বললেন, জী হ্যাঁ! আমার কাছে বলার মতো আর কীইবা আছে। সবই তো বলেছি। হযরত বললেন, ‘আপনি শুনে রাখুন, বেশী দিন নয়; কয়েক বছরের মধ্যেই আপনার এই অবগতি হবে যে, এই সব লোকজনের নিজেদের কর্মকান্ডে মুসলমানদের অপূরনীয় ক্ষতিসাধন করেছে। হ্যাঁ, তাদের তো ফায়দা হাসিল হবে, কিন্তু হিন্দের মিল্লাতে ইসলামিয়ার অপূরণীয় ক্ষতিসাধন হবে’। এই বলে আবার নিজের কাজে লেগে গেলেন। আর একটি বাক্যও উচ্চারণ করলেন না।

ইতিহাস সাক্ষী, বাবরি মসজিদ আন্দোলনকে রাজপথে আনায়নকারী ব্যক্তিগণই মূলতঃ বাবরি মসজিদ ধ্বংসকারীদের কাছে মাথানত করলেন। যখন কোন ঈমানদার মুন্সী, ইতিহাসবিদ ইতিহাস লিখবেন, তখন তার অভিজ্ঞতা এটাই হবে। সারকথা হলো, হযরতের দৃষ্টিতে সবচেয়ে মৌলিক বিষয় ছিল ‘মুসলমানদের চিন্তাধারাকে দিকনির্দেশনা প্রদান’। এরই (ফিকরী রাহনুমায়ী) ধারাবাহিকতায় আরজ করব যে, এক সময় এমন এসেছে, সারা দুনিয়ায় ইসলামকে এক উগ্রপন্থি ধর্ম বলে প্রপাগন্ডা চালানোর হীণ প্রয়াস চলে। একদিন হযরত বললেন, ‘আমি অনুভব করছি, কয়েকটা ছোট ছোট পুস্তিকা লিখতে চাই, ‘ইসলামে নিরাপত্তার রূপরেখা কী?’ “ইসলাম তার দুশমনদের সাথে কী ধরনের আচরণের হুকুম করে?’ ‘হিযরতের পর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গীগণের সঙ্গে কী আচর করা হলো?’ ‘হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের পর নিজ দুশমনদের সঙ্গে কী ব্যবহার করলেন?’ এই ধরনের বিভিন্ন শিরোনামে ৩/৪/৫ টা ছোট ছোট পুস্তিকা লিখতে চাই’। এর বিশেষ কোনো গুরুত্ব আমার বুঝে আসেনি। বললাম, জী হযরত! আপনি যেহেতু হুকুম করেছেন; আমি লিখিয়ে নিবো। কিন্তু লেখা যেহেতু আমার ধৈর্য্যে ধরে না তাই এর প্রতি আমার কোনো বিশেষ মনোযোগও নেই। কিছুদিন পর হযরত (রহ.) আবারো এই কথাই বললেন। বললাম, অমুক অমুক জনকে বলে দিয়েছি। হযরত (রহ.) বললেন, তারা কী জবাব দিয়েছেন? বললাম, তারা বলেছেন যে, কাজ করেছেন। বললেন, ঠিক আছে। যখন আবার কয়েকদিন গেল পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন কী হলো? আরজ করলাম, হযরত তা তো এখনও কিছু হয়নি। বললেন, কাকে কাকে বলেছ? বললাম, মুফতী সালমান সাহেব, মাওলানা আব্দুল হামিদ নোমানী সাহেব, মুফতী শিব্বীর আহমদ সাহেব। ঠিক আছে, মাওলানা নোমানীকে কঠোরভাবে বললেন যে, এখনই বসে লেখ। এখনই, এই সময়ই। তাকে বিষয় দেওয়া হয়েছিল ইসলামে নিরাপত্তার রূপরেখা’। যাহোক পুস্তিকা লিখানো হলো এবং বললেন, এটার হিন্দীও করাও ইংলিশও করাও এবং ছাপিয়ে দাও আর তা সারা দেশে বিতরণ করা চাই। এটাকে আমাদের মিশন বানানো চাই। পরে অনুরূপভাবে মুফতী সালমান সাহেবকে ফোন করলেন এবং কঠোরভাবে তাকে বললেন, আপনিও লিখেন। আলহামদুলিল্লাহ, তিন হযরত তিনটি পুস্তিকা লিখলেন ও প্রকাশিত হলো। বিভিন্ন সময়ে হযরত (রহ.) এগুলোকে বিতরণ করালেন। তাঁর অন্তরে আজকের সময়ে বড় গুরুত্ব ছিল, কিভাবে উগ্রপন্থি আখ্যা দিয়ে ইসলামের দুশমন ইসলামের চিত্রকে বিকৃত করতে চাচ্ছে। আমাদের হযরতের এই বিষয়ে পুরোপুরি শরহে সদর ছিল যে, যে সব লোকজন নিষ্পাপ ও নিরপরাধ মানুষদের মারধর, হত্যা করছে তারা কখনও ইসলামের বন্ধু হতে পারে না এবং এসব লোকদের হাতে ইসলামকে বন্ধক দেওয়া যাবে না। না ইসলামকে, না মিল্লাতে ইসলামকে। বরং নিজে এই দায়িত্ব নেওয়া উচিত যে, ইসলামের মূল যে চিত্র, তা হলো ‘নিরাপত্তা ও শান্তির’, এই চিত্রকে বিকৃত করার প্রয়াস যেন কেউ না পায়। যদি কোনো বিষয়ে আন্দোলন করতেই হয় তাহলে সেই আন্দোলনকে ঐ সীমা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখা চাই যে সীমা এবং যে ইস্যুতে এই আন্দোলন করা হচ্ছে। একদিন হযরত খুব ভোরে ফজরের আগেই ‘পরিয়াগ রাজ’ (ট্রেন) দিয়ে কানপুর থেকে তশরীফ আনছেন, শীতকাল ছিল, আমি হযরতকে নিয়ে আসার জন্য স্টেশনে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে একটা কথা এই হয়েছিল, হযরত দেখলেন রাস্তার মাঝে লোকেরা সবজি বিক্রি করছে, হযরতকে বললাম, তাদের সারা রাতের কাজ হয়ে গেছে। বললেন, দুনিয়াটা দেখ, একটা খাঁচা নিয়ে লোকটি এসছে এবং কিছু রুপীর জন্য এই সময় জেগে উটছে। আর মুসলমান আল্লাহকে রাজী করার উদ্দেশ্যে নামাজের জন্যও জাগে না। আরেকটি কথা হয়েছিল, যখন রাম লীলা গ্রাউন্ডের সামনে দিয়ে অতিক্রম করছিলাম, তখন হযরত বললেন, আমার একটা ইচ্ছা, একবার জমিয়তের ইজলাস এই মাঠে হোক। আমি তৎক্ষণাৎ হযরতকে বললাম, হযরত আপনি দুআ করেন, আমরা মেহনত করব এবং ইজলাস হবে ইনশাআল্লাহ।

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ স্বাধীনতার পর এই প্রথম এত বড় মহা সমাবেশের আয়োজন করল রাজধানী দিল্লীতে। মে মাসের বিকেল বেলা ছিল আল্লাহ তাআলার রহমত, তাঁরই করমে সবই হচ্ছিল। তাঁর রহমত দেখুন, ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল, যোহরের সময় থেকেই মৌসুম বদলে গেল এমন মনোলোভা মৌসুম মে মাসে কখনো কল্পনাও করা যাচ্ছিল না ।

কালো বিলের বিরুদ্ধে বিরাট ইজলাস

কিছুদিন পরে ইউ, পিতে উপাসনালয় সংক্রান্ত আইন তৈরী হয় এবং আইনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাৎক্ষণিক ওয়ার্কিং কমিটি আহ্বান করা হলো। আমি বললাম, এই ওয়ার্কিং কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ মাদরাসাসমূহের দায়িত্ব শীল ব্যক্তিদেরকে যথাসম্ভব বিশেষ দাওয়াতে আহ্বান করা হবে, (হযরতকে আমি এই পরামর্শ দিলাম এবং হযরত তা মঞ্জুর করলেন) এবং তা এক বিরাট সভায় পরিণত হলো। সভায় যদিও কতিপয় ব্যক্তি এই বিষয়কে হালকাভাবে নিতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু আমি হযরতের কাছে আরজ করলাম, হযরত এই বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং মিল্লাতে ইসলামিয়াকে এই সময়ে জাগ্রত করা দরকার। একত্র করা, ঐক্যে নিয়ে আসার এটাই সুযোগ । তিনি আমার এই আবেদন গ্রহণ করলেন এবং আমাকে অনুমতি দিলেন, আমি যেন এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিই। বললেন, কার্যকরি পদক্ষেপ কী হবে? বললাম, সারা প্রদেশে ইজলাস করব এবং লৌক্ষ্মোতেও ইজলাস করব। বললেন, ঠিক আছে যেমন মুনাসিব মনে কর। অতঃপর যোহরের পর আলোচনায় এই সিদ্ধান্ত হলো যে, সারা প্রদেশে এই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে। যাহোক, অনুমোদন সাপেক্ষে সারা উত্তর প্রদেশে জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন জেলাসমূহে ৬৩ টি ইজলাস হলো, ৬৪ তম ইজলাস হলো লৌহ্মোয়। লৌক্ষ্মোর আদি প্রবীণ বাসিন্দারা বলেছেন, স্বাধীনতার পরে স্বাধীন হিন্দুস্তানের ইতিহাসে লৌক্ষ্মোয় মুসলমানদের এমন ইজতেমা আমরা দেখিনি। দৃষ্টি যতদূর যায় কেবল মানুষ আর মানুষ। লৌহ্মোর রাজপথ লোকে লোকারণ্য ছিল আলহামদুলিল্লাহ, এটা হযরতের বরকত ছিল। লৌক্ষ্মোর এই ইজলাস অনেক শানদার ও সফল ছিল। প্রকাশ যে ইউ, পির এলজিআরডি মন্ত্রী লাল জি টেন্ডন এই সময় ঘোষণা করলেন যে, এই ইস্যু উগ্রপন্থিদের দ্বারা গঠিত এবং যেসব ব্যক্তি এই ইস্যুতে আন্দোলন করেছেন তারা উগ্রপন্থিদের মদদপুষ্ঠ। আমরা কোনো অবস্থাতেই এই আইন ফিরিয়ে নিবো না। এই আইন যখন লোক সভায় পাশ হয় তখন তার বিরোধীতা না করে সমাজবাদি পার্টি মূল বিরোধী পার্টি ছিল; তারা ওয়াক আউট করল, তখন সেখান থেকেও পাশ করিয়ে নিল, কাউন্সিল থেকেও পাশ করিয়ে নিল এবং গভর্নরের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল ।

লৌক্ষ্মোর ইজলাসের পরের দিন সমাজবাদি পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী ঠাকুর অমর সিং- এর বক্তব্য আসে যে, মাওলানা আসআদ মাদানী কংগ্রেসপন্থী এবং অনেক প্রদেশগুলোতে কংগ্রেসের সরকার রয়েছে। আর সেখানে এই আইন আগে থেকেই তৈরী হয়ে আছে। সুতরাং তাঁর এই অধিকার নেই যে, তিনি এই আইনের বিরোধিতা করবেন। যদি তাঁর করতেই হয় তাহলে প্রথমে কংগ্রেস সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রদেশসমূহে এবং পশ্চিমবঙ্গে করুন’। তার এই বক্তব্য আসার পর আমরা খোঁজ নিলাম যে, রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ, তিন প্রদেশেও এই আইন ১৯/২০ ব্যবধানে তৈরী হয়ে আছে। এই সব বক্তব্যের পর আমি হযরতের কাছে দরখাস্ত করি যে, হযরত ইজাযত দিয়ে দেন এখন আমরা দিল্লিতে প্রোগ্রাম করব। হযরত বললেন, ঠিক আছে কোথায় করবে? বললাম, রাম লীলা গ্রাউন্ডে করব। বললেন, অনেক মুশকিল হবে, গরম অনেক প্রচন্ড। বললাম, আপনি দুআ করেন। যেহেতু ৫ মার্চ লৌক্ষ্মোয় ইজলাস হয়েছিল। এরপর আমাদের এই আলোচনা হয়েছিল ২০/২৫ মার্চের দিকে। তাই হযরত বলছিলেন, কখন করবে? বললাম, আমরা মে মাসে করব ইনশাআল্লাহ। দেখলেন কোন তারিখ খালি আছে ফিদায়ে মিল্লাত রহ. বললেন, অনেক কষ্ট হবে। বললাম, আপনি দুআ করে দিন, বাকী কাজ আমাদের উপর ছেড়ে দিন। আল্লাহ করাবেন। ফায়সালা হয়ে গেল। তার উপর ভিত্তি করে আমরা কাজ শুরু করলাম। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ স্বাধীনতার পর এই প্রথম এত বড় মহা সমাবেশের আয়োজন করল রাজধানী দিল্লীতে। মে মাসের বিকেল বেলা ছিল আল্লাহ তাআলার রহমত, তাঁরই করমে সবই হচ্ছিল। তাঁর রহমত দেখুন, ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল, যোহরের সময় থেকেই মৌসুম বদলে গেল এমন মনোলোভা মৌসুম মে মাসে কখনো কল্পনাও করা যাচ্ছিল না । এমনকি স্টেজে উপবিষ্ট কয়েকজনের ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছিল। সব কালেই আল্লাহ তাআলার এমন কুদরত প্রত্যক্ষ হয়, আল্লাহ তাআলা তাঁর দ্বীনের জন্য অগ্রসরমান লোকদের উপর এ ধরনের করম ফরমান এবং এমনই রহম করেন। কিন্তু আমরা কখনো তাঁর শুকরিয়া জ্ঞাপন করি না। এরপর হযরতের জীবদ্দশাতেই আমরা রাম লীলা মাঠে আরো তিনটি ইজলাস করেছি, এটি নিয়ে মোট ৪টি।

হযরতের হায়াতেই ৫ম ইখলাসের ফায়সালা হয়েছিল। তখন আমি হযরতকে হাসপাতালেই বলেছিলাম যে, বুশ হিন্দুস্তানে আসছে। তাই তার আগমনে লোকদেরকে শান্ত রাখা হবে, এটা উচিৎ নয়। আমাদের জাতীয়, ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হলো, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জালেম ওই রাষ্ট্রনায়ক যখন এখানে আসছে, সরকার লালগালিচা সংবর্ধনা ভালোভাবেই করবে, কিন্তু এমন জনস্রোত হওয়া চাই; যারা তার আগমনের বিরোধীতায় দাঁড়াবে। তাই দিল্লীতে কিছুসংখ্যক বিবেকবান মুসলিম এবং অমুসলিম বন্ধুদের পরামর্শে এই কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। কেননা কতিপয় জাতীয় সংগঠন নিজেদের মাঝে পারষ্পরিক পরামর্শ করছিল। জমিয়তে উলামার স্বকীয়তা মোতাবেক তাদের চেয়ে অগ্রগামী থাকলাম। আমরা দু’দিনের মধ্যেই পরামর্শ করে এবং প্রেস কনফারেন্স করে কর্মসূচি ঘোষণা করলাম। ড. জে কে জিনকে সঙ্গে নিলাম; গোত্রীয় দৃষ্টিকোণ এবং গোত্রীয়করণের গন্ধ যেন না আসে এবং হযরতের রীতি অনুসারে, তিনি এই ধরনের প্রেক্ষাপটে অমুসলিমদেরকেও সঙ্গে নিতেন। এরপর ওয়ার্কিং কমিটি আহ্বান করলাম, কেননা এই সিদ্ধান্তটি তো আমরা অতিদ্রুত নিয়েছিলাম, আমরা অনুভব করছিলাম যে, তা জমিয়তে উলামার কৌশল এবং স্বভাবতই ছিল। দ্বিতীয়তঃ যদি বিলম্ব করি তাহলে অন্যরা এর ঘোষণা করে ফেলবে। এতে আমাদের জন্য ঘোষণা করা এবং কাজ করা কিছুটা কঠিন হয়ে যাবে। লোকজন বলবে আমাদের বিরোধীতায় এসেছে। তাই আমরা ঘোষণা করে দিলাম এবং ঘোষণা করার পরই জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ওয়ার্কিং কমিটি আহ্বান করলাম। হযরত হাসপাতালে কোমায় ছিলেন তো ওয়ার্কিং কমিটির কিছু সদস্য এতে জোর আপত্তি তুললেন যে, এই সিদ্ধান্ত আপনার কিভাবে নিলেন? এই সিদ্ধান্ত ভুল । বললাম, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জালেম এবং স্বৈরশাসক হিন্দুস্তান আসছে, তাই এই ফায়সালা কি করে ভুল হবে? আর যদি ভূলই হয়, তাহলে ওয়ার্কিং কমিটি নিষেধ করে দিক, আমরা প্রত্যাহার করে নিবো। তারা বললেন, এখন তো ঘোষণা হয়েই গেছে। সারকথা, পরে আরো আলোচনা হলো এবং ওয়ার্কিং কমিটির অধিকাংশই প্রোগ্রাম করার পক্ষে রইলেন। ফলে আলহামদুলিল্লাহ এই ইজলাস হলো বুশ এসেছিলেন ২৮ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায়। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, ১ মার্চ সকাল বেলা ইজলাস হবে। যদিও হযরতের ইন্তিকাল ৬ ফেব্রুয়ারি হয়েছিল। অনেক বন্ধুগণ বলেছিলেন, প্রোগ্রাম পিছিয়ে দিতে। বললাম, না এটা পিছানো যাবে না। যথাসময়েই হবে। আলহামদুলিল্লাহ এই ইজলাসও উপমাহীন রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল। এমনিভাবে হযরতের নেতৃত্বকালেও রিজারভেশনের যে আন্দোলন চালিয়েছিলাম, রিজারভেশনের দাবি আদায়ের জন্য জনমত গড়ে তোলা, পরে স্বাক্ষর গ্রহণে গুরুত্বারোপ করা, এরপর সারাদেশে রিজারভেশনের তত্ত্বাবধানে সভা সমাবেশ করা এবং এরপরে দেশ ও জাতি বাঁচাও আন্দোলন চালানো। সাচার কমিটি গঠন, এই সবই হযরতের (রহ.) কীর্তি। সবকটিতে হযরত আমাকে নির্দেশ দিয়ে কাজগুলি করিয়েছেন।

(চলবে…)

(ফিদায়ে মিল্লাত সেমিনার-নিউ দিল্লীতে প্রদত্ত ভাষণ।)

সংকলক : মুফতী সালমান মানসুরপুরী

ভাষান্তর : মাওলানা মাজহারুল হক চৌধুরী

‘স্মৃতির মলাটে ফিদায়ে মিল্লাত’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত

এই ধারাবাহিকের পূর্বের লেখা পড়ুন

১. ফিদায়ে মিল্লাতের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি (পর্ব-১)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *