ফিদায়ে মিল্লাতের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি (পর্ব-৩)

ফিদায়ে মিল্লাতের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি (পর্ব-৩)

দায়িত্ব প্রদানে হযরত (রহ.) -এর পদ্ধতি

হযরতের মহান বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি যাকে দিয়ে কাজ করাতে চাইতেন তার প্রতি যতক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ আস্থা না জন্মাত, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে দিয়ে কাজ করাতে চাইতেন না। আর যখনই তার উপর আস্থা আসত, তখনই কাজ সোপর্দ করতেন। আস্থা আসার পর যখন কাউকে কাজ সোপর্দ করতেন, তখন আর পিছনে ফিরে তাকাতেন না। কেবল রিজাল্ট দেখতে চাইতেন। ফলাফল এই ছিল, যে ব্যক্তি দায়িত্বপ্রাপ্ত হতেন তিনি শুধু নামেই কাৰ্য্য সমপাদক বা সাধারণ সম্পাদক হতেন না। বরং কার্যতই তাকে পূর্ণ ঐকান্তিকতায় ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) নিজ পক্ষ থেকে দিয়ে রাখতেন যে, ঠিক আছে, মূলনীতি অনুসারে এই কাজটি করা চাই। এখন এই কাজটি সম্পাদন কিভাবে হবে? তার ডিজাইন কিভাবে করা হবে? কেমন করে বিন্যস্ত করা হবে? কোন কোন তারিখে হবে? কী ধরনের হবে? কে কে আসবেন? কে কে বক্তব্য রাখবেন? এই সবকিছুই তার উপর ছেড়ে দিতেন। তাঁর কাছে কোন পরামর্শ চাইলে পরামর্শ দিয়ে দিতেন বা বিশেষ কোনো বিষয় স্মরণে এলে তাও বলে দিতেন যে, এটাকে এভাবে না করে এভাবে কর, কিংবা কাজটি ভুল হলে সতর্ক করে দিতেন ।

জমিয়তের সাংগঠনিক প্রোগ্রাম সম্পর্কে হযরতের আন্তরিকতা

আমি আমার নিজের জীবনে সাংগঠনিক প্রোগ্রামে হযরতকে যেভাবে দেখেছি, এক তো হলো দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিরসনে হযরত অত্যন্ত আন্তরিক হতেন এবং এর প্রেক্ষিতে হযরত অত্যান্ত আবেগপ্রবন হতেন। সার্বিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সব ধরনের ব্যায় ভার নিজ থেকে করা, সর্বদা সর্বশক্তি নিয়োগে প্রস্তুত থাকতেন। অনুরূপভাবে মুসলিম ফান্ড কর্তৃক নিয়মানুযায়ী সুদবিহীন ঋণের প্রতিও হযরতের অনেক মনযোগ ছিল ।

তথাপি হযরতের একটি স্বপ্ন ছিল যে, বিত্তশালীদের সন্তানদের জন্য এমন ‘ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠা করা যা ঐ আঙ্গিকে পরিচালনা হবে, যে আঙ্গিকে পরিচালিত হয় খ্রিষ্টানদের স্কুলগুলো এবং পাঠদানও হবে ঐ রকম । কিন্তু শিক্ষা দান ও পরিবেশ হবে ইসলামী। আমি ২০/২৫ বছরের মধ্যে দেখেছি যে, হযরত (রহ.) এই লক্ষ্যে বেশ কয়েক বার দেরাদুনও তাশরীফ নিয়েছেন । হযরতকে আরজ করলাম, ‘হযরত আপনার কি এটাই স্বপ্ন’? বড় ভাড়াক্রান্ত মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হযরত বললেন, ‘আমার একটি স্বপ্ন’, “যেখানে ইসলামী পরিবেশে সমকালীন প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলন ঘটবে’। জানি না, আল্লাহর কি মর্জি, আমি চেষ্টা করব। বলেলেন, ‘হ্যাঁ, তুমিই কর, আমি তো চেষ্টা করে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। এই অধম চেষ্টা শুরু করল, আলহামদুলিল্লাহ হযরতের জীবদ্দশায়ই ২০ একর জমি প্রায় দেড় কোটি রুপি মূল্যে দেরাদুনে কিনে নিলাম।

হযরতের এক মুরিদ ড. হুসাইন মুকাদ্দম (ব্রিটেন), তারই অর্থ সহায়তায় পুরো জমি ক্রয় করলাম। আমার খুশনসীব যে, কোনো প্রোগ্রাম না করেই হযরতকে আমরা সেখানে নিয়ে গেলাম এবং নিয়ে গিয়ে আমরা নীরবেই হযরতের দস্তে মোবারকে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলাম। এই দিন আমি হযরতের (রহ.) চেহারায়ে আনওয়ারে যে খুশি ও আনন্দ দেখেছি, তা আমার জীবনে আরও এক বার দেখেছিলাম। এই দুটি সময়ে হযরতকে এরুপ আনন্দিত দেখেছি। চেহারা থেকে সন্তুষ্টির ছাপ প্রস্ফুটিত হচ্ছিল।

বলতেন, যখন মুসলমান সংখ্যায় অপ্রতুল ছিল, বিত্ত-সম্পদ ছিল না, বেশী শিক্ষিতও ছিল না, মূর্খ ছিল, তখন আল্লাহ ইজ্জত দান করলেন । মুসলমানদের কাছে এত ধন-সম্পদও কখনও ছিল না। বর্তমান সময়ে যে পরিমানে বে-ইজ্জত হচ্ছে মুসলমান, এত বে-ইজ্জত মুসলমান কখনও হয়নি ।

মুসলমানদের অপদস্ততা কিভাবে নিবারণ হবে

এই ক্ষেত্রে হযরতের অবস্থান ছিল যে, মুসলমান নিজের আমলগুলো শুধরিয়ে নিবে, কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরবে, আল্লাহর প্রতি তাকওয়া, ভয়-ভীতি অলম্বন করবে, গোনাহ ও গর্হিত কাজ ছেড়ে দিবে, ন্যায় ও নেক আমল করা আরম্ভ করবে, কুরআনকে মজবুতির সঙ্গে গ্রহণ করবে, তাহলে সে কখনও অকৃতকার্য হবে না এবং তার অপমান ইজ্জতে রূপ নিবে বলতেন, যখন মুসলমান সংখ্যায় অপ্রতুল ছিল, বিত্ত-সম্পদ ছিল না, বেশী শিক্ষিতও ছিল না, মূর্খ ছিল, তখন আল্লাহ ইজ্জত দান করলেন । আর বর্তমানে যখন মুসলমানদের যে সংখ্যা ইসলামের পুরা ইতিহাসে এত সংখ্যক কখনও ছিল না এবং যত ধন-সম্পদ বর্তমানে, মুসলমানদের কাছে এত ধন-সম্পদও কখনও ছিল না। বর্তমান সময়ে যে পরিমানে বে-ইজ্জত হচ্ছে মুসলমান, এত বে-ইজ্জত মুসলমান কখনও হয়নি ।

হযরতের ফরমান, যা আমার স্মৃতি থেকে কখনো এক মুহূর্তের জন্যও বিস্মৃত হয় না, বারবার বলতেন মুসলমান! যদি তোমরা ইজ্জত হাসিল করতে চাও তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ কর। হযরতের ৯০ শতাংশ প্রোগ্রাম ইসলাহী হতো। কিন্তু এই সকল প্রোগ্রাম থেকে এবং ইসলাহী ও তালীমী কাজে সম্পৃক্ত লোকদের হালকা থেকে গঠিত তাদের সংগঠন এমন মোতিমালায় গড়া ছিল যে, ঐ ব্যক্তিগণই সংগঠনে সবচেয়ে মূল্যবান কীর্তি রেখেছেন, যারা হযরতের সঙ্গে ইসলাহী এবং দ্বীনি মাদরাসাসমূহের সাথে জড়িত। হযরত (রহ.) বাহ্যত সবচেয়ে বেশী সফর ইসলাহী করতেন। কিন্তু এগুরোই সাংগঠনিকও হয়ে যেত। হযরত (রহ.) রাজনৈতিক প্রোগ্রাম যৎসামান্য করতেন। এর সংখ্যা কম ছিল।

বায়আতের ক্ষেত্রে হযরত (রহ.) -এর মামূল

এক্ষেত্রে হযরতের (রহ.) দুটি তবকা ছিল, যদি সেই এলাকা গরীব ও নিঃস্ব লোকদের হয়, দূরবর্তী হয়, লোকজন নিরক্ষর হয়, মূর্খতা ও বিদআতে প্রভাবান্বিত এলাকা হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশী আন্তরিকাতার সঙ্গে তিনি বায়আত ও ইরশাদ করতেন এবং এ সব লোকদেরকে এই ধারায় জড়ো করতে চাইতেন। এমনকি আমি কয়েক জায়গায় এও দেখেছি যে, হযরত (রহ.) স্বয়ং তাওয়াজ্জুহ প্রদান করছেন। বিপরীতে, যদি কোনো বড় আলেম আসতেন তাহলে তাকে সহজে বায়আত করতেন না।

আমার ভালোভাবেই স্মরণ আছে যে, বাংলাদেশে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ সাহেব যিনি সেখানকার প্রসিদ্ধ ও শীর্ষ উলামায়ে কেরামের একজন, তিনি হযরতের কাছে বায়আত হতে চাইলেন, এতে ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) বিরত থাকলেন। কয়েকদিন পার হলো হযরত তাঁকে বায়আত করলেন না। তখন তিনি আমাকে বিষয়টি বললেন, তাঁকে বললাম, আমার কাছে এখন একটিই পথ আছে, যখন হযরত সাধারণ মানুষের যে মজমায় বায়আত করতে থাকবেন, তখন আপনি চুপচাপ গিয়ে এত বসে পড়বেন এবং কাপড়টি ধরে নিবেন। বায়আত হয়ে গেলেন। পরে আপনি পারচা লিখে হযরত থেকে সবক নিয়ে নিবেন। তখন তিনি এমনটিই করলেন ।

বাহ্যত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) তাকে জেনে বুঝে তাঁর দরখাস্ত মঞ্জুর করেননি। তিনি বড় মজমায় গিয়ে বসলেন। এমন কয়েকটি এলাকা ছিল যেখানে উলামা অনেক হতেন। অন্যান্য মাশায়েখের সঙ্গেহ সম্পর্কিত এমনও অনেক হতেন। সেখানে হযরত (রহ.) বায়আত ও ইরশাদ অত্যান্ত বিচক্ষণতার সাথেই করতেন এবং বলতেন, মুফতী মাহমুদুল হাসান সাহেবের কাছে বায়আত হয়ে যান বা হযরত মাওরানা আবরারুল হক সাহেব তাশরীফ আনছেন তার কাছে বায়আত হয়ে যান । বয়ান তো সব জায়গাতেই হতো। তবে হযরতের বয়ানে কোথাও কেউ যদি বিশেষ আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ করে দিতেন যেমন জুমুআ সম্পর্কে, বা রাজনৈতিক বিষয়ে, ইতিহাস সম্পর্কে, তাহলে তো ঠিক আছে, অন্যথায় সবখানেই প্রায় একই ধরনের বয়ান করতেন। তাতে হয়তো ১৯/২০ এর ফারাক ছিল তিনি আল্লাহর আনুগত্য, মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ার ফযিলত, ঈমান ইয়াকীনের কথা অত্যান্ত মর্মস্পর্শীভাবে বয়ানে তুলে ধরতেন।

(চলবে…)

আগামী পর্বের বিষয় : নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে ফিদায়ে মিল্লাতের চিন্তাধারা ও তাঁর জীবন চরিত থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

(ফিদায়ে মিল্লাত সেমিনার-নিউ দিল্লীতে প্রদত্ত ভাষণ।)

সংকলক : মুফতী সালমান মানসুরপুরী

ভাষান্তর : মাওলানা মাজহারুল হক চৌধুরী

‘স্মৃতির মলাটে ফিদায়ে মিল্লাত’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত

এই ধারাবাহিকের পূর্বের লেখা পড়ুন

১. ফিদায়ে মিল্লাতের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি (পর্ব-১)

২. ফিদায়ে মিল্লাতের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি (পর্ব-২)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *