ফিদায়ে মিল্লাতের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি, পর্ব-৪ (সমাপ্ত)

ফিদায়ে মিল্লাতের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি, পর্ব-৪ (সমাপ্ত)

এক অনন্য বৈশিষ্ট

হযরতের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি মুসলমানদের ইস্যুতে অত্যান্ত ড়ভাবে বক্তব্য রাখতেন। কিন্তু যখন মুসলমানদের সামনে বক্তব্য দিতেন, তখন মুসলমানদের অসহায়ত্বের প্রতি অত্যন্ত কঠোর নিন্দাবাদ করতেন এবং সরকারের বিরোধীতায় মুসলমানদের সামনে অধিক কড়া কোনো বক্তব্য দিতেন না। বরং অনেক সময় এমন হতো, খোদ মুসলমানদেরকে তিনি তিরষ্কার করতেন যে, তেমারা এমন এমন করেছ, তোমরা ঢিল ছুড়েছ, তােমরা পাথর মেরেছ। হাঙ্গামার সময় তিনি তাদের সামনে এ ধরনের কথা বলতেন। যার যে ত্রুটি তাঁর নজরে পড়ত, তাকেই সতর্ক করে দিতেন।

পক্ষান্তরে যখন সরকারের সাথে আলোচনায় বসতেন (প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) তাদের সঙ্গে এর চেয়েও অধিক কড়া ভাষায় কথা বলতেন। অথচ বর্তমান নেতৃবৃন্দের তো এই অবস্থা, জনগণের সামনে তো সরকারের অনেক কঠোর সামালোচনা করেন আর যখন সরকারের সামনে যান, তখন তাদের পায়ে চুমু খান, তোষামোদ করেন, প্রশংসার বুলি আওড়ান, নানারকম গীত গাইতে থাকেন, তাদের থেকে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেন। আমাদের হযরত (রহ.) পুরোপুরি এর বিপরীত ছিলেন। মুসলমানদের সামনে যখন আসতেন, তাদেরক সতর্ক করে দিতেন, সরকারের কাছে যখন যেতেন তখন কঠোর সমালোচনা করতেন।

প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সঙ্গে যখন সাক্ষাৎ করতে যাবেন তখন আমি (হযরতের অতীত অভ্যাস সম্পর্কে অবগত ছিলাম) হযরতের কাছে আরজ করলাম, হযরত! এই প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক ব্যক্তি নয় বরং অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সে আপনাঁকে ব্যক্তিগতভাবে মহব্বত করে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে যেভাবে আপনি তার সঙ্গে আলোচনা করেছেন এভাবেই করবেন। অতীতের প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে যে ধরনের আলোচনা করে এসেছেন, এমন আলোচনা না করাই ভালো। অন্ততঃ প্রথম সাক্ষাতে তাকে কড়া কথা বলবেন না; বরং তাকে কাজ করার প্রতি আন্তরিকভাবে উৎসাহিত করবেন। পরে যখন আপনার কিংবা মিল্লাতের কোনো কাজ না করবে, এক দু’বছর যাক পরে আপনি যদি চান তাকে কঠোর কোনো কথা বলতে চান, তহলে বলবেন । যদি এই সময়ে আপনি তার সঙ্গে কোনো কড়া ভাষা ব্যবহার করেন তাহলে অরাজনৈতিক ব্যাক্তি হওয়ার দরুন সে তা সহ্য নাও করতে পারে এবং আপনার সঙ্গে সম্পর্ক প্রথম অস্থায়ই বিনষ্ট হয়ে যাবে। হযরত মেহেরবানী করলেন, আমার এই দরখাস্ত তিনি গ্রহণ করলেন, অত্যান্ত অনাড়ম্বর পরিবেশে আলোচনা হলো এবং এই বৈঠকেই সাচার কমিটির জন্য তার অনুমোদন নিয়ে নিলেন ।

নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের হযরত (রহ.)-এর চিন্তাধারা

হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) প্রথম দিকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিরোধী ছিলেন। বরং তাঁর চিন্তাধারা ছিল যে, মুসলমান এমন রাজনৈতিক দলের অন্তর্ভুক্ত থাকবে যা সেকুলার। কিন্তু রাজনীতিবিদদের সংকীর্ণ মন মানসিকতা দুর্নীতি পরায়ণতা, বিশ্বাসঘাতকতা, অসাধুতা, মিথ্যাবাদিতা, ধোঁকাবাজি ইত্যাদির কারণে সত্যিকার রাজনীতিবিদের অপ্রতুলতা লক্ষ্য করে পরে হযরত বলতেন, ভাই! বর্তমানে এমন সেকুলার পলিটিক্যাল পার্টি হওয়া চাই যা বাস্তবিক অর্থেই সেকুলার হবে এবং তাতে মুসলিম অমুসলিম সমাহারে থাকবে। বিশেষতঃ দলিতদের সাথে জোটের ক্ষেত্রে হযরত (রহ.) অত্যন্ত আগ্রহী মনোভাব রাখতেন এবং এই চিন্তাধারায় তিনি তাদের সঙ্গে এক থালে খানা খাওয়ার রীতি বানিয়ে ছিলেন এবং তা নিজেও করেছেন। যাহোক, এটা হযরতের (রহ.) বৈশিষ্ট্য ছিল যে, কেবল মুসলমানদেরই নয়। বরং এমন এক সেকুলার পলিটিক্যাল পার্টি হবে যাতে মুসলমানদের বৃহৎ অংশদারিত্ব থাকবে এবং কিছু নিয়ন্ত্রণও থাকবে। এই ধরনের পার্টি হওয়া বাঞ্চনীয়। এতে হয়তঃ কিছুটা হলেও আমরা সম্মান অর্জন করতে পারি। কিন্তু নিরেট মুসলিম রাজনৈতিক পার্টি সম্পর্কে হযরতের অবস্থান এত অনড় ছিল, বলতেন, এটা হবে ‘আত্মহনন’। মুসলমানদের কোনো পলিটিক্যাল পার্টি গঠন, এতে কেবল মুসলমানই থাকবে এবং মুসলমানের নামেই গঠিত হবে, এমন পলিটিক্যাল পার্টি মুসলমানদের জন্য এবং রাষ্ট্রের জন্য আত্মহনন বলে গণ্য হবে। ‘এটা তো খোদকাশী’ এই শব্দই তিনি ব্যবহার করতেন।

এই দেশে যদি মুসলমান অমুসলমান আলাদা আলাদা বসবাস করে এবং নিজেকে পৃথক করে রাখে, এবং অমুসলিমের প্রতি ঘৃণা ও ঘৃণ্য মনোভাব, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও কঠোরতার পথ বেছে নেয়, তাহলে এতে ইসলামের ক্ষতি হবে।

হযরত (রহ.)- এর জীবন চরিত থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা

হযরতের (রহ.) দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে আমি যা বুঝেছি তা হলো, ইসলাম হল ‘দাওয়াতী মাযহাব’ এবং এই দেশে যদি মুসলমান অমুসলমান আলাদা আলাদা বসবাস করে এবং নিজেকে পৃথক করে রাখে, এবং অমুসলিমের প্রতি ঘৃণা ও ঘৃণ্য মনোভাব, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও কঠোরতার পথ বেছে নেয়, তাহলে এতে ইসলামের ক্ষতি হবে। কেবল মুসলমানের নয় বরং ইসলামের ক্ষতি সাধন হবে। সুতরাং আপনি যতই কঠোরতা অলম্বন করবেন দাওয়াতের পথ ততই বন্ধ হতে থাকবে। আরেকটি বিষয় যে, যতই রুক্ষ কঠোরতার পথ বেছে নেওয়া হবে, তাতে যেসব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা রয়েছে সেখানে এর তেমন প্রভাব পড়বে না বটে। কিন্তু ঐ সব এলাকা যেখানে মুসলমান সংখ্যায় অল্প, এলাকা অনুপাতে গ্রাম হিসেবেও শহর বা মহল্লাহ হিসেবেও সেখানকার মুসলমানদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত কঠিন এবং এই দেশে মুসলমানদেগর অধিকাংশই প্রায় ৭০ শতাংশ এমন, যারা গ্রামাঞ্চলে থাকে এবং এমন গ্রামাঞ্চলে থাকে যেখানে অবস্থানগত দিক থেকেও সাধারণ গ্রামের মানের চেয়ে নিম্নমানের। তাই মুসলমানদের জন্য মৌলিকভাবে তাঁর চিন্তাধারা ছিল যে, এই দেশে মুসলমান যদি রুঢ় মনোভাব ও মানসিকতা নিয়ে থাকে তাহলে এতে মুসলমানদেরই ক্ষতি হবে।

আরেকটি বিষয় হলো, হযরতের (রহ.) চিন্তা থেকে যা আমি বুঝেছি, যে সকল লোক যুদ্ধ লড়ছে, কঠোর মনোভাব রাখে, তারা মূলতঃ মুসলমান এবং ইসলামের দুশমন। যেমনটি উল্লেখ করেছি যে, ইসলাম হলো ‘দওয়াতী মাযহাব’। আর ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য লোকদেরকে ইসলামের দিকে আনার জন্য আমাদের প্রথম পদক্ষেপই হল লোকদের সাথে নিজের সম্পর্ক সরল এবং উত্তমভাবে গড়তে হবে। বর্তমানে একটি প্রশ্ন উঠেছে যে, জুলুমের বিরোদ্ধে যেসব লোক যুদ্ধে লিপ্ত, তাদের ক্ষেত্রে আমরা কি বলব? বেশ। খুবই সুন্দর প্রশ্ন। আমি বলব, ট্রেনে লোকদের উপর বোমা বিস্ফোরণ ঘটছে, মানুষ মারা যাচ্ছে তো এই ক্ষেত্রে কি চিন্তাধারা হওয়া উচিত? এই প্রেক্ষাপটে আমাদের হযরতের অত্যান্ত খোলাখুলি বক্তব্য ছিল যে, ‘এই ভাবে নিরাপরাধ মানুষদেরকে হত্যা করা তাও আবার ‘জিহাদের’ নামে, এতে ইসলামের ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এসব কর্মকান্ড কখনও করা উচিত নয়। এ থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।

আমাদের সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা

আমার মতামত হলো যে, জাতীয় খেদমত আঞ্জামের দুটি দিক- আমরা স্বীয় বুযর্গদের কাছ থেকে যে চিন্তাধারা ধ্যান-ধারনার ওয়ারাসত লাভ করেছি তা পরের উত্তরসূরীদের কাছে যথাযথভাবে পৌছে দিব এবং সর্বশক্তি ব্যয় করব। যদি আমরা তাদের চিন্তা চেতনার প্রচার প্রসার এবং মুসলমানদেরকে তাঁদের চিন্তা চেতনার উপর সুদৃঢ় করতে পারি, তাহলে মিল্লাতে ইসলামিয়া হিন্দের জন্য এর চেয়ে বড় খেদমত আর কিছু হবেনা । আরেকটি বিষয়ে হলো, সংগঠনের সাথে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সম্পর্ক থাক বা না থাক ইনশাআল্লাহ জুলুম নির্যাতনের বিরোধিতা কখনও পরিহার করব না এবং ইনশাআল্লাহ জালেমের সামনে কখনও হাঁটু গাড়ব না। চিন্তাধারার ক্ষেত্রে কোনোরূপ সমঝোতা বা আপোস করব না। চাই এই চিন্তাধারায় কাজ করার ফলে আপনি নারাজ হোন বা নারাজির মনোভাব রাখেন- এর পরওয়া করব না। যে সত্য বুঝেছি, শিখেছি এ থেকে এক ইঞ্চিও হটব না ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা সহীহ বুঝার তাওফীক দান করেন এবং আকাবির রাহিমাহুমুল্লাহের চিন্তাধারা ও ফিকির এবং তাঁদের পথে চলার তাওফীক নসীব করেন। আমীন।

(ফিদায়েমিল্লাত সেমিনার-নিউ দিল্লীতে প্রদত্ত ভাষণ )

সংকলক : মুফতী সালমান মানসুরপুরী। প্রকাশক : জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ।

ভাষান্তর : মুহাম্মদ মাজহারুল হক চৌধুর

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *