ফিরতে হবে আস্থার মূলে; ফ্যাশন ফেলে সুন্নতের মিছিলে
মাওলানা আরিফ বিল্লাহ ❑ ঈমানের মূল হলো বিশ্বাস। বিশ্বাস থেকে বিশ্বস্থতা। একজন মোমিন পূর্ণতা লাভ করে বিশ্বস্থতা অর্জনের মাধ্যমে। এই বিশ্বস্থতা অর্জন করতে হলে নিজে বিশ্বাসী হতে হবে। আর বিশ্বাস পূর্ণতা পাবে বিশুদ্ধ জ্ঞান বা ইলমের মাধ্যমে। আমাদের সমাজে দুই শ্রেণীর মানুষ থাকে। একজন জ্ঞানী, অপরজন গুণগ্রাহী। একজন জ্ঞান আহরণ বা বিতরণকারী, অপরজন জ্ঞানলব্ধ ফায়দা ভোগকারী।
ধরা যাক, একজন ডাক্তার; অসুস্থ হলে মানুষ এই গুণীর সমাদর করে। ডাক্তারের স্বরণাপন্ন হয়। বিশেষণ অনুযায়ী এই বিদ্বানকে মূল্যায়ন করে। ধাপে ধাপে মূল্যায়ন বাড়ে। ঐশী গ্রন্থ কোরআনের ইলম যিনি অর্জন করেন, তিনিও জ্ঞানী। তারও অনেক গুণগ্রাহী থাকে। বরং অন্য জ্ঞানীদের চেয়ে বেশি থাকে। কারণ ঐশী জ্ঞান মহাজ্ঞান। নিজের আত্ত্বিক রোগের চিকিৎসা নিতে যেমন মানুষ আলেমের কাছে আসে, তেমনি আসে শারীরিক, আর্থিক ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে। এমনকি মামলার নিষ্পত্তি নিয়েও মানুষ আসে একজন আলেমের কাছে।
কেন আসে মানুষ একজন আলেমের কাছে? কেন আসে রোগী বা মামলার বাদী ও বিবাদী? কারণ আলেমরা নবীদের ওয়ারিশ। সম্পদের নয়, বিদ্যার ওয়ারিশ। আস্থা ও বিশ্বাসের ওয়ারিশ। সাহাবা রা: এর বিশ্বাস ছিল নবী সা: যা বলেন তা সত্য এবং আস্থা ছিল নবী সা: যা বলেন তা বাস্তব। কেননা নবীরা উম্মতের জন্য যুগের ডাক্তার। তারা যা বলেন তা কল্যাণকর।
পৃথিবীর শীর্ষ চূড়ার ওপারে আরও বহু সীমা থেকে সংবাদ তুলে আনেন একজন আলেম কোরআন রিসার্চ করে।
পৃথিবী এখন বিশ্বায়নের পথে। তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে পৃথিবী এখন আকাশসম। আকাশ থেকে নামিয়ে আনছে নতুন নতুন বিষয়। সংবাদ তুলে আনছে গহীন তলদেশ থেকে। তারপরও পৃথিবী একজন আলেম থেকে অগ্রগামী নয় কিংবা নয় আধুনিক। পৃথিবীর শীর্ষ চূড়ার ওপারে আরও বহু সীমা থেকে সংবাদ তুলে আনেন একজন আলেম কোরআন রিসার্চ করে। তুলে আনেন গভীর কালো জলের কালো পাথরের চাপায় কালো পিঁপড়ার সংবাদকে। তাহলে কেন একজন আলেমকে বিশ্বাস করবেনা? আস্থা রাখবেনা তার সংবাদে।
পৃথিবীর সংবাদ যা পেশ করছে, বিজ্ঞানের যন্ত্র যা আবিষ্কার করবে, তার সবকিছুই অনেক পূর্বে একজন আলেম জানতে পারে কোরআন থেকে। ফলে মানুষ মূল্যায়ণ করে একজন আলেমকে। আস্থা রাখে একজন আলেমের সংবাদে। কিন্তু আজ একজন আলেমকে বিশ্বাস করেনা চেনা অচেনা বহুজনে। আস্থা রাখেনা তার সংবাদে। না দুনিয়ার ব্যাপারে, না ধর্মের বিষয়ে। আমার ধারনা এর কারণ দু’টো হতে পারে। এক. হতে পারে তাঁর সংবাদ বিজ্ঞান বা পৃথিবীর খবরের সাথে সাংঘর্ষিক থাকে। দুই. কিংবা সময়ের বিবর্তনে আলেমের আচরণ ও বিচরণে আস্থার সংকট ঘনিভূত হয়েছে। আমরা জানি পৃথিবীর বিজ্ঞানে কোন তথ্যই কোরআনের সাংঘর্ষিক হবেনা। কোরআনের পাতায় যা আছে, বিজ্ঞান তা বাস্তবায়ন করবে। হয়তো আমাদের জ্ঞানের ভুল কিংবা পৃথিবীর উপস্থাপন ভুল।
কিন্তু আস্থার বিষয়? তা এখন ভয়াবহ অবস্থার রূপ নিয়েছে। আমার উস্তাদ আল্লামা আবুল ফাতাহ রহ. বলতেন একটা সময় ছিল; গভীর রজনীতে অন্ধকার পথে একজন পথিক শুভ্রকাপড় পরিহিত একজন আলেমকে দেখলে তার দেহে প্রাণ সঞ্চারিত হতো। তার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ উবে গিয়ে শান্তনার তৃষ্ণা মিটতো। তার কথা-আচরণে নয়। তার উপস্থিতি পথিকের স্বস্থি দিত।
আগে সমাজে মানুষ একজন আলেমকে খুঁজে বের করতো তার প্রয়োজনে। এখন আলেমরাই নিজেকে তুলে ধরছে ইউটিউব আর ইনষ্টাগ্রামে।
আজও আলেম আছে, পথিক আছে, বেড়েছে আলেম, বেড়েছে পথিক। কিন্তু শান্তনা আর স্বস্থি কোথায়? হারিয়ে গেছে আমাদের থেকে। সাহাবায়ে কেরাম রা: আস্থা কুঁড়িয়েছেন সুন্নাত পালনের মাধ্যমে। আমরা কুঁড়াচ্ছি ফ্যাশন বানিয়ে। সাহাবা রা: বিশ্বাসের ছবক দিয়েছেন তাওরাতুরের মাধ্যমে; আমরা বিশ্বাস চাই টুইটার ও ফেসবুক শেয়ারের মাধ্যমে। সাহাবা রা: ও মনিষীরা বড় হয়েছেন নিজেকে লুকিয়ে। এখন একজন নবীন আলেম বড় হতে চেষ্টা করেন ভাইরাল হয়ে। পূর্বের মুসলিম দানবিররা সেবা করেছেন গণ মানুষের আস্থা নিয়ে। এখন সেবা করা হয় পুলিশ প্রহরায় ক্যামেরার ক্যাপশন দিয়ে। নির্জনে স্রষ্টার ইবাদতকেও আমরা তুলে ধরছি সেলফির মাধ্যমে। আগে সমাজে মানুষ একজন আলেমকে খুঁজে বের করতো তার প্রয়োজনে। এখন আলেমরাই নিজেকে তুলে ধরছে ইউটিউব আর ইনষ্টাগ্রামে। আসুন আমরা আবার ফিরে যাই আস্থার মূলে। ফ্যাশন ফেলে সুন্নতের মিছিলে।
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক