ফুটবলের পর পৃথিবীও ছাড়লেন বাদল রায়
পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : ফুটবলই তাঁর জীবন, ফুটবলই মরণ। ফুটবলের নির্বাচন শেষে বাদল রায় যেন ওপারের ডাক শুনতে পাচ্ছিলেন। তাই বোধ হয় আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তির আগে তিনি নানা কথা বলে গিয়েছিলেন স্ত্রী মাধুরী রায়কে। তিনি যদি আর হাসপাতাল থেকে না ফেরেন, তখন কী করবেন আর না করবেন ইত্যাদি। সেখানে ছিল ফুটবল ফেডারেশনের প্রতি তাঁর ক্ষোভ-অভিমানের কথা, মাধুরী রায় তখন যেভাবে বলেছিলেন, ‘বাদল বলেছিল, খারাপ কিছু হয়ে গেলে তার মরদেহ যেন ফেডারেশন চত্বরে নেওয়া না হয়। তার চেয়ে বরং শহীদ মিনার ভালো।’ ফোনে তিনি আরেকটি কথা বারবার বলছিলেন, ‘তার (বাদল রায়ের) সমস্যা আসলে ফুটবল। ফুটবলের সঙ্গে তার জীবনটা এমনভাবে জড়িয়ে গেছে, ওটা বাদ দিয়ে বাদলের সুস্থ থাকা কঠিন। ফুটবল ফেডারেশন ছেড়ে থাকাটা সে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। এটা তার বড় মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাকে কুরে কুরে শেষ করে দিচ্ছে।’
গতকাল সব শেষ হয়ে গেছে। কী অদ্ভুত! মাত্র গত অক্টোবরে ফুটবলের সঙ্গে বাদলের সম্পর্কচ্ছেদ, অনেকখানি আরোপিত এই সম্পর্কচ্যুতি। ফুটবলের নির্বাচনের মনোনয়পত্র কিনে তিনি বেশ বিপাকে পড়েছিলেন। সেটি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েও গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। যা-ই হোক, গত অক্টোবরে ফুটবল ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে আর পরের মাসেই বাদল রায় চলে গেলেন ধরাধাম ছেড়ে। ফুটবলকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণামুক্ত হয়ে তিনি চলে গেলেন ওপারে।
ফুটবল আর মোহামেডান—এ দুটি ছিল তাঁর ভীষণ ভালোবাসার জায়গা। কখনো-কখনো তাঁর পরমাত্মীয়দের চেয়েও বেশি! তাঁর জীবনে প্রথম আনন্দের জায়গা ছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ১৯৭৭ সাল থেকে সাদাকালো জার্সিতে তাঁর শুরু, এরপর এই ঐতিহ্যবাহী জার্সিতে ছয়টি লিগ শিরোপাসহ জিতেছেন অনেক ট্রফি। ১৯৮১ সালে আবাহনীর বড় অঙ্কের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েও থেকে গেলেন মোহামেডানে। তিনি না থাকলে নাকি ১৯৮২ সালে সালাম মুর্শেদীর ২৭ গোলের রেকর্ডও হয় না! প্রায় অর্ধেক গোলই বাদলের পায়ে তৈরি, মুর্শেদী শুধু গোলের আনুষ্ঠানিকতা সেরেছেন। পুরো খেলোয়াড়ি জীবন সাদাকালোয় কাটিয়ে বাদল হয়ে ওঠেন দেশের ফুটবলের জনপ্রিয় তারকা। জনপ্রিয়তার এমন তুঙ্গে ছিলেন যে ডাকসু নির্বাচনে কাদের-চুন্নু পরিষদ থেকে ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে সুবিধা করতে পারেননি ১৯৯৬ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।
ফুটবলে এমন মোহাবিষ্ট ছিলেন ১৯৮৯ সালে ক্যারিয়ার শেষ করেও অন্য লাইনে পা বাড়াননি। সংগঠক হয়ে কাজ করেছেন ফুটবল উন্নয়নে। তাঁর সাংগঠনিক ক্যারিয়ারের বড় অর্জন নিঃসন্দেহে ১৯৯৯ সালে সাফ গেমস ফুটবলে সোনা জয়। তখন তিনি ফুটবল ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক আর দল গেছে নেপালে সাফ গেমস ফুটবল খেলতে। আন্তঃকোন্দলে জেরবার বাংলাদেশ দলের সব আশা ফুরিয়ে যেতে বসেছিল। কাঠমাণ্ডু থেকে এমন দুঃসংবাদ পেয়ে ছুটে গেলেন বাদল রায়, তাঁর জাদুতেই সংহতি ফেরে দলে এবং বাংলাদেশ ফুটবল প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশীয় ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরে। ২০০৩ সালে ঢাকায় সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের সাংগঠনিক কারিগর তিনি। সব সময় ফুটবলারদের বিষয়ে তিনি ছিলেন ভীষণ আন্তরিক আর খেলোয়াড়রাও তাঁকে বিশ্বাস করতেন। তাঁর চরিত্রে এক সম্মোহনী ম্যাজিক ছিল।
ফুটবলারদের সেই প্রিয় মানুষটি সাংবাদিকদেরও খুব পছন্দের ছিলেন। ফুটবল ফেডারেশনে ‘বাদলদা’র রুমেই সাংবাদিকদের ঢোকা কিংবা বসার অনুমতি ছিল সব সময়। তিনি ২০১৭ সালে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লে সাংবাদিকরাও সমস্যায় পড়েন। ওপরে ফেডারেশনে গিয়ে তাঁরা কোথায় বসবেন আর যাওয়াটাও যে অবাধ নয়। বাদল রায় চিকিৎসা শেষে সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আবার ফেডারেশনে আসতে শুরু করেন। লাঠি ভর দিয়ে আসতেন আর বলতেন, ‘ফুটবল ছাড়া থাকব কিভাবে। নিজে বাঁচার জন্য হলেও ফুটবলের সঙ্গে থাকতে হবে আমার।’ কিন্তু সেই ফুটবলকে ছেড়ে দিতে হলো বলে বাদলও চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। এই প্রস্থান যেন অবশ্যম্ভাবী ছিল!