ফেরাকে বাতেলা নিয়ে কওমীতে আবার মুনাজারা চালু হোক

ফেরাকে বাতেলা নিয়ে কওমীতে আবার মুনাজারা চালু হোক

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী 

দারুল উলুম দেওবন্দে এখনও পর্যন্ত ফেরাকে বাতেলা নিয়ে বহাস-মুবাহাসা হয়। ছাত্রদের মধ্যে দু-দল হয়ে বিভিন্ন বাতিল ফিরকা সম্পর্কে ডিবেট হয়ে থাকে। বিভিন্ন জেলার আঞ্জুমান বা জেলাভিত্তিক ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে ফেরাকে বাতেলা নিয়ে মুনাজারা করতে দেখা যায়।কখনো সাপ্তাহিক,কখনো মাসিক, কখনো ত্রৈমাসিক এভাবে দারুল উলুমের অভ্যন্তরে এসব অনুষ্ঠানগুলো চলতে থাকে। এসব বহাস- মুবাহাসার বিচারক থাকেন দারুল উলুমের আসাতিযায়ে কেরাম। কখনো অতিথি হিসাবে দারুল উলুমের সদরে মুদাররিস,শাইখুল হাদীস এমনকি মুহতামিম সাহেবও এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। এর মাধ্যমে সবচেয়ে বড় ফায়দা হয় ছাত্রদের। তারা সপ্তাহব্যাপী বা মাসব্যাপী প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। মুনাজারার সময় উভয় পক্ষের দালায়েলগুলো সামনে চলে আসে। এবং এসব ডিবেটে উপস্থিত হাজারো ছাত্ররা সবচেয়ে বেশী উপকৃত হয় ।

দারুল উলুম দেওবন্দের অনুসরণে আমাদের দেশের কওমীর মাদ্রাসার অভ্যন্তরে প্রতিটি শাখাতে বিভিন্ন ফেরাকে বাতেলা নিয়ে বহাস-মুবাহাসা জরুরী। এর দ্বারা আমাদের ছাত্রদের জেহেন পরিস্কার হবে। উভয় পক্ষের দালায়েলগুলো রপ্ত করা সম্ভব হবে। বর্তমান যেসব ফেতনার ছোবল চলছে কওমীতে, ওসব বিষয়ে বিস্তর জ্ঞান লাভ করতে পারবে আমাদের ছাত্ররা।

একসময় কিন্তু আমাদের কওমী অঙ্গনে বিভিন্ন ফেরাকে বাতেলা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা- গবেষণা হত। উস্তাদগণ ঠিকই সেটার দেখভাল করতেন। তবে হালজামানায় সেগুলো ভাটা পড়েছে। এখন তেমন আলোচনা হয় না। নামে মাত্র আকায়েদের কিতাব পড়ানো হচ্ছে। ছাত্ররা পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।ব্যস এতটুকু। কিন্তু এব্যাপারে ছাত্ররা মজবুতির সাথে গড়ে উঠছেনা। বিশেষ করে আমাদের কিছু ওলামায়েকেরাম রাজনীতিতে আগ্রহপ্রবণ হয়ে যাওয়ার কারণে বাতিল ফেরকার ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। এখন আর কেউ কথা বলেন না।

মওদুদী ফিতনা যেটা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ ফিতনা। আর সেটা কওমী মাদ্রাসার অভ্যন্তরে এমন ভাবে ছড়িয়ে আছে, বোঝা বড় দায়।বিশেষ করে হকের ছদ্মাবরণে কওমী অঙ্গনকে অক্টোপাসের মত চেপে ধরেছে।অনেক বাঘাবাঘা ব্যক্তিরা এখন ধরাশায়ী। বিশেষ করে মওদুদী ফিতনা সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান না থাকার কারণে এবং ওর ভয়াবহতা কী সেটা না জানার কারণে আমাদের কিছু ভাই থোড়াই কেয়ার করেন। মোটেও সতর্ক হন না। এখনো তাদের জানা নেই মওদুদী ফিতনা কী? এখনও বলতে পারে না মওদুদী জামাতের আকায়েদ কী? ভুরি ভুরি কিতাব পড়ে এবং পড়ায়ে সবকিছু যেন জলে চলে যাচ্ছে। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য মওদুদী জামাতের ব্যাপারে মুখ খুলছেন না। অথচ মওদুদী সাহেবের ভ্রান্ত আকিদা এবং ঈমান বিধ্বংসী চিন্তাধারা সম্পর্কে আমাদের ওলামায়ে হক তথা আকাবিরে দেওবন্দ সতর্ক করেগেছেন।তারা বিভিন্ন লিখনী- বই- পুস্তকের মাধ্যমে মওদুদী সাহেবের ভ্রান্ত মতবাদ তুলে ধরেছেন।

মওদুদী সাহেবকে (যখন তার ভ্রান্ত আকিদা প্রকাশ পায়নি) প্রাথমিক অবস্থায় আমাদের দেওবন্দের আকাবিরগণই তার পরিচিতি সমাজের কাছে তুলে ধরেছিলেন। জাতির সামনে তাকে পরিচয় করে দিয়ে ছিলেন আমাদের পূর্বসূরী বুজুর্গানেদ্বীন। কিন্তু যখনই মওদুদী সাহেবের কলম বেপরোয়া গতিতে চলতে লাগল, আম্বিয়া আলাইহিমুচ্ছালাম এবং সাহাবাদের ব্যাপারে তানকিদ তথা সমালোচনা এবং মিথ্যারোপ শুরু করলেন, তখনই আমাদের ওলামায়েকেরাম তাকে সতর্ক করেছিল।কিন্তু মওদুদী সাহেব তার চিন্তাধারা থেকে ফিরে আসেন নি। বরং তার সেই ভ্রান্ত মতবাদের উপরে অটল থাকলেন। এ ব্যাপারে দেওবন্দের ওলামায়েকেরাম যেমন শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী( রহ,) মাওলানা ইউসুফ বানুরী( রহ,) মাওলানা শায়েখ জাকারিয়া কান্ধলভী ( রহ,)মাওলানা মানজুর নোমানী ( রহ,), মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী ( রহ,) মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ( রহ,) উনারা সকলেই তাদের লিখনীর মাধ্যমে মওদুদী সাহেবের ভ্রান্ত মতবাদ সম্পর্কে সতর্ক করে গেছেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তারা মওদুদী মতবাদকে ফেরাকে বাতেলা বলে আখ্যায়িত করেছেন। ঠিক ওই মত ও পথের অনুসারীও ছিলেন আমাদের বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরাম। তারাও মওদুদী সাহেবকে বাতিল বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

হাফেজ্জী হুজুর ( রহ,) শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক( রহ,) মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী ( রহ,), আল্লামা কাজি মু’তাসিম বিল্লাহ ( রহ,) মুফতি নুরুল্লাহ ( রহ,) মাওলানা আশরাফ আলী ( রহ,) মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করীম (রহ,) পীর সাহেব চরমোনাই। এসকল ওলামা মাশায়েখগণ মওদুদী সাহেবের ভ্রান্ত চিন্তাধারা সম্পর্কে জাতিকে সতর্ক করে গেছেন। তারা বিভিন্ন লিখনী এবং বক্তৃতার মাধ্যমে মওদুদীর অসারতা তুলে ধরেছিলেন।

মওদুদী মতবাদের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী কঠোর অবস্থানে ছিলেন আল্লামা কাজি মু’তাসিম বিল্লাহ ( রহ,) আল্লামা শামসুদ্দিন কাসেমী ( রহ,) এবং মুফতি নুরুল্লাহ ( রহ,)। বড় ভুমিকা রেখেছিল তাঁরা। বিন্দু পরিমাণ মওদুদীর ভ্রান্ত আকিদাকে ছেড়ে কথা বলেন নি। তাঁদের জীবদ্দশায় বহু বহাস- মুবাহাসা এবং লিখনী – বক্তৃতা করেছিলেন। দেশের বিভিন্ন জায়গাতে সেমিনার, সভা-সমাবেশে মওদুদী সাহেবের ভ্রান্তা চিন্তাধারা তুলে ধরতেন। এবং দালায়েলের মাধ্যমে তারা মওদুদী ভ্রান্ত জামাত বা গোমরাহ ফেরকা এ ব্যাপারে কঠোর  ছিলেন। এ জন্য এখনো দেখা যায়, কাজি মু’তাসিম বিল্রাহ ( রহ,) শামসুদ্দিন কাসেমী ( রহ,) এবং মুফতি নুরুল্লাহ ( রহ,) এর সোহবাতপ্রাপ্ত ছাত্রগণ মওদুদী মতবাদের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করে যাচ্ছেন। এখনো যারা ওই বাতিল ফেরকা নিয়ে কথা বলেন, দেখবেন! তারা ওই তিন আলেমের সংস্পর্শে গড়ে ওঠা।

ওই সকল আলেমগণ তারা মাদ্রাসার অভ্যন্তরে ছাত্রদের মওদুদী আকিদা সম্পর্কে বহাস-মুবাহাসা করাতেন। আরো যেসব ফেরকা আছে সেগুলো নিয়েও ছাত্রদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতেন। মাওলানা কাজি মু’তাসিম বিল্লাহ সাহেবকে সবচেয়ে সাহসী ভুমিকা রাখতে দেখা গেছে। তিনি যে কোন সভাতে মওদুদী সাহেবের ভ্রান্ত তাফসির নিয়ে কথা বলতেন। সলফে সালেহীনগণ কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন আর জনাব মওদুদী কী ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করেছেন সেটা মানুষের সামনে খুবই স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরতেন। যে কারণে দেখা যেত, মাওলানা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহকে কোন মওদুদী জামাত বা বেদআতী দেখলে তার পিলে চমকে উঠত। ওই ভ্রান্ত আকিদার কোন লোক ভয়ে কাজি সাহেবের সামনে আসত না।

বর্তমানে আমাদের ওই সকল ওলামাদের চেতনায় ছাত্রদের গড়তে ব্যর্থ হচ্ছি। কেননা রাজনীতির পোকা আমাদের মাথায় ঢুকেছে। আর সেটার ফায়দা হাসিলের জন্য ওই মওদুদীবাদীদের সাথে খলত- মলত হয়ে যাচ্ছে। হক-বাতিল মিলে একাকার। ওদের সাথে এক সঙ্গে রাজপথে, এক টেবিলে বৈঠক, একই সঙ্গে ওঠাবসা। যার কারণে মওদুদী ভ্রান্ত আকিদা জানা সত্বেও ওদের থেকে ফায়দা নেওয়ার জন্য কোন কথা বলা হচ্ছেনা। জেনেও না জানার ভান। যার দরুণ নিজেও মিশে যাচ্ছি ওদের সাথে আর আমাদের সন্তানেরাও ওদের চিন্তাধারা আঁকড়ে ধরছে।

দেখুন! উস্তাদ যেদিকে যায় ছাত্র সেদিকে যাবে। দলের নেতা যেদিকে যাবে তার কর্মীরাও সেদিকে যাবে। পীর যেদিকে মুরিদেরাও সেদিকে। এখন কোন উস্তাদ বা দলীয় প্রধান বা পীর সাহেব মওদুদী মতবাদের ব্যাপারে চুপ থাকে, বরং তাদের সাথে ওঠাবসা করে, তাহলে নিঃসন্দেহে তার অনুসারীগণ ওই ব্যাপারে কোন কথা বলবেনা।বরং দিনে দিনে তাদের ব্যাপারে দুর্বল হয়ে পড়বে। আর সেটাই হচ্ছে বর্তমানে। যখন কোন প্রতিষ্ঠানে মওদুদী মতবাদের ব্যাপারে আলোচনা না হবে। উস্তাদগণ ছাত্রদের সেভাবে যদি তৈরী না করেন তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ওই বাতিল ফেরকার ব্যাপারে কথা বলার কাউকে পাওয়া যাবেনা। বরং হক আর বাতিল মিলে একাকার হয়ে যাবে। 

আবার ওয়াজ মাহফিলের কিছু বক্তা এখন আর মওদুদী মতবাদ নিয়ে কথা বলেন না। মাহফিলে স্রোতা কমে যাওয়ার ভয়, দাওয়াত কম পাওয়ার ভয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয় আসার ভয়, ইত্যাকার চিন্তা করে এখন ওনারা ওয়াজের মাহফিলে বাতিল ফেরকা নিয়ে কথা বলছেন না। সবাই কিছুটা তেলতেলে ওয়াজ করেন। জেনে বুঝেও পাশ কেটে যাচ্ছেন। তাহলে মানুষ জানবে কোত্থেকে? শিখবে কোত্থেকে? মওদুদীর অসারতা নিয়ে আলেমরা যদি কথা না বলেন তাহলে কারা বলবে ?

এজন্য এখনই সময়। মাদ্রাসার উস্তাদ এবং ছাত্রদেরকে চেতনায় জেগে উঠতে হবে। বাতিল ফেরকা বিশেষ করে মওদুদী, কাদিয়ানী, শিয়া, বাহায়ী ইত্যাদি বাতিল ফেরকা নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা জরুরী। দালায়েলগুলো সকল ছাত্র- উস্তাদদের নখদর্পনে থাকতে হবে। মাদ্রাসার অভ্যন্তরে ফেরাকে বাতেলা নিয়ে বহাস-মুবাহাসা করতে হবে। যাতে সকল ছাত্র ভায়েরা উপকৃত হতে পারে। সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ডিবেট – মুনাজারা হওয়া চাই।তাহলে মজবুত আলেম তৈরী হবে।

কিন্তু আমরা হিন্দুস্তান-পাকিস্তান উলামাদের থেকে এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। ওনারা বাতিলের ব্যাপারে সবসময় কঠোর। কোন আপোস নেই তাদের। ওরা লিখনী, বক্তৃতা, এমনকি সঙ্গীতের মাধ্যমে ফেরাকে বাতেলার মুখোশ উম্মোচন করে যাচ্ছে। আমাদেরও উচিত হবে ওই ভাবে সামনে বাড়ানো।

আল্লাহ আমাদের সহীহ বুঝ দান করেন। আমিন।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *