ফেসবুক লাইভে ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা কি ঠেকানো যেত? কী বলছে পুলিশ?

ফেসবুক লাইভে ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা কি ঠেকানো যেত? কী বলছে পুলিশ?

‘এই ঘটনায় আবারো স্পষ্ট হল বাংলাদেশের সমাজ ও পরিবারে মানসিক স্বাস্থ্য কতটা উপেক্ষিত।’

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : আটান্ন বছর বয়সী আবু মহসিন খান প্রায় ১৭ মিনিট ধরে ফেসবুক লাইভে তার কষ্টের কথা বলেছেন। সে সময় বহু মানুষ সেই লাইভ দেখছিলেন।

জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে একটি কলও এসেছিল বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।

এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন এই মৃত্যু ঠেকানো যেত কিনা? তার এভাবে আত্মহননের পথ বেছে নেয়া যেন বহু মানুষের মনস্তত্ত্বের গভীরে নাড়া দিয়ে গেছে।

জরুরি সেবায় কলটি কখন গিয়েছিল?

ফেসবুক থেকে লাইভ ভিডিওটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে গত রাতেই। তবে ইউটিউব এবং ফেসবুকে এর কপি কেউ না কেউ বারবার আপলোড করে দিচ্ছে।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে লাইভ চলাকালীন দশ মিনিটের মাথায় আবু মহসিন খান বলেছেন এই পৃথিবীতে তার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করছে না।

তিনি ১২ মিনিটের পর এসে তার আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদর্শন করেন।

৯৯৯ জরুরি সেবা শাখার পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার জানিয়েছেন গত রাত নয়টা ছয় মিনিটে তাদের কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য চেয়ে একটি কল আসে। যিনি কলটি করেছেন তিনি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়েছেন এবং ঢাকার বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা বলে জানিয়েছেন। আমরা কলটি অ্যাটেন্ড করি এবং এর কয়েক মিনিট-সর্বোচ্চ তিন চার মিনিটের মধ্যেই ধানমন্ডি থানায় কলারের সাথে কথা বলিয়ে দেই। সাধারণত আমরা এভাবেই রেসপন্স করি।

তবে যেহেতু ফেসবুক লাইভটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে, তাই এর ঘটনাক্রম নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় বলে পুলিশ জানাচ্ছে, অর্থাৎ ফেসবুক লাইভ শুরু হওয়ার কত মিনিটের মাথায় ৯৯৯ নম্বরে ফোন কল যায় তা স্পষ্ট নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান খন্দকার ফারজানা রহমান বলেছেন, পশ্চিমা দেশে বিভিন্ন শহরে যাচাই করে দেখা হয়, জরুরি সেবা বিভাগে কল আসার পর সাহায্য পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগে। সেই সময়টুকু কমানো যায় কিনা। এসব বিষয় হয়ত এখন আমাদেরও যাচাই করার সময় এসেছে।

পুলিশের প্রথম দলটি কখন পৌছায়?

তবে ৯৯৯-এর কলটি ফেসবুক লাইভ চলাকালীন এসেছিল নাকি ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর সেটি নিশ্চিত নয় বলছে পুলিশ।

এই ঘটনায় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ থেকে ফোন পাওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে সবচেয়ে আগে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন ধানমন্ডি থানার উপ পুলিশ পরিদর্শক দেব লাল সরকার।

তিনি জানিয়েছেন, আমি ধানমন্ডি তিন নম্বর রোডে ডিউটিতে ছিলাম। আনুমানিক সোয়া নটার দিকে, আনুমানিক বলতে হবে, এই সময় রেডিও বার্তায় জানতে পারি খুব জরুরি ভিত্তিতে ধানমন্ডি সাত নম্বর রোডের এক বাড়িতে যেতে হবে। আমি সাথে সাথেই রওয়ানা দিয়েছিলাম।

তিনি জানিয়েছেন, ৩ নম্বর সড়ক থেকে আরো দু’জন পুলিশ সদস্য নিয়ে তিনি মৃত মহসিন খানের বাসায় গিয়ে দেখতে পান বাড়ির সামনে পাঁচ ছয়জনের ছোট একটি জটলা। তারা আমাকে বলে দিলো লিফটের কততে (কত তলায়) যেতে হবে। ওপরে গিয়ে দেখি ফ্ল্যাটের সামনে ওইরকম আরো কয়েকজন দাঁড়ানো। তারা ফেসবুক লাইভ দেখে এসেছে বলে জানায়। ততক্ষণে উনি কাজটি করে ফেলেছেন।

মৃত আবু মহসিন খানের বাড়ি ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার যে রাস্তায়, তার পরের রাস্তাতেই ধানমন্ডি থানা।

এই ঘটনাটি ঠেকানো যেত কিনা, জরুরি সেবায় কল পাওয়ার পর ঘটনাস্থলে যেতে কতটা সময় নেয়া হয়েছে, এসব নিয়ে পুলিশ নিজে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন ধানমন্ডি থানার সহকারী কমিশনার আব্দুল্লাহ আল মাসুম। রাতেই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন তিনি। ফেসবুক থেকে লাইভ ভিডিওটি যেহেতু সরিয়ে ফেলা হয়েছে, তাই আমরা বুঝতে পারছি না ঘটনার সময়কাল আসলে কখন। কোন সময়ে তিনি লাইভ শুরু করেন আর ট্রিপল নাইনে কলটি কখন আসে। তবে আমরা খুব দ্রুতই রেসপন্স করি, কারণ খুব কাছেই আমাদের একটা টহল দল ছিল। ঠেকানো যেত কিনা সেটা আমরাও যাচাই করছি।

তিনি জানিয়েছেন, আগেই দরজায় কাগজ টাঙিয়ে রাখা ছিল, যাতে টাইপ করে লেখা ছিল দরজা খোলা আছে। ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢোকার কথা লেখা ছিল। তিনি সাদা কাপড় রেখে গেছেন নিজেকে দাফন করার জন্য। কোন কবরস্থানে দাফন হবে সে অনুরোধও করে গেছেন।

পুলিশ জানিয়েছে, তার লাশের পাশে টাইপ করে প্রিন্ট নেয়া কাগজে সই করা নোট পাওয়া গেছে। সেখানেও তিনি একই ধরনের কথা লিখেছেন।

১৬ মিনিটের ফেসবুক লাইভ

ফেসবুক লাইভে গুছিয়ে শান্ত গলায় ১৬ মিনিটের বেশি সময় কথা বলেছেন আবু মহসিন খান। কথা বলার সময় তিনি সুস্থির ছিলেন। তার চোখের চশমার কাঁচ ঝাপসা দেখাচ্ছিল। নিজের পরিচয় দিয়ে শুরু কথা করেন। পরিবারের কয়েকজন সদস্যের প্রতি তিনি সংক্ষুব্ধ সেটি তার কথায় প্রকাশিত হয়েছে।

ব্যবসায় কীভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন সেটি তিনি বিস্তারিত তুলে ধরেন। কথার মাঝে তিনি অনেকবার ছোট বড় বিরতি নেন।

তার গলার স্বর বুজে আসছিল মাঝে মাঝে। দুইবার কলেমা পড়েছেন, বিড়বিড় করে সুরা পাঠ করেছেন।

যে পিস্তলটি ব্যাবহার করে তিনি নিজের প্রাণ শেষ করে দেবেন সেটি যে বৈধ তাও তিনি নিশ্চিত করেন ফেসবুক লাইভে সেটির লাইসেন্স প্রদর্শন করে।

ফেসবুক ফলোয়ারদের কি কিছু করার ছিল?

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই বিষয়ক খবরের নিচে একজন লিখেছেন, তার ফ্রেন্ড লিস্টে কি একজনও ছিল না যে ওই সময়ের মধ্যে তাকে বিরত করার জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতো?

আর একজন লিখেছেন, উনি শুরুতেই ধারণা দিলেন, কেউ কি তখন একটা কল করতে পারতো না।? কমেন্ট করলো পরিচিত লোকজন, অথচ ১৫ মিনিটে কেউ কিছু করলো না? মানুষ কি বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে?

পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয়েছে তিনি এর আগেও বিষাদমূলক পোস্ট দিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান খন্দকার ফারজানা রহমান বলেছেন, ফেসবুক লাইভের সময় তাকে বারবার ফোন করে ডিসট্র্যাক্ট করা যেত। কিন্তু পুরো সময়ে তাকে কেউ ফোন করেনি। আমি খুবই অবাক হচ্ছি যে ফোন কল এসেছে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। যা লাইভে শোনা গেছে। বিশ্বের বহু দেশে সুইসাইড বিষয়ক আলাদা কল সেন্টার থাকে, হেল্প-লাইন থাকে, আলাদা টাস্ক ফোর্স থাকে। মানুষজনও ফেসবুক লাইভে এরকম কিছু দেখলে দ্রুত খবর দেয়।

তিনি বলছেন, এই ঘটনায় আবারো স্পষ্ট হল বাংলাদেশের সমাজ ও পরিবারে মানসিক স্বাস্থ্য কতটা উপেক্ষিত।

সূত্র : বিবিসি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *