পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : কভিডের ধাক্কা অনেকটা সামলে দেশের অর্থনীতি যখন কিছুটা স্বাভাবিক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছিল, তখনই পড়ে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। চোখ রাঙাতে থাকে মূল্যস্ফীতি। যার চাপ সামলাতে চিড়েচ্যাপ্টা নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের কাছে বছর শেষের ‘ভিলেন’ এই মূল্যস্ফীতি।
মূলত পণ্যের দাম বাড়ার প্রবণতার ওপর নির্ভর করে মূল্যস্ফীতির মাত্রা। চলতি বছরের এপ্রিল মাসেই দেশে মূল্যস্ফীতির অঙ্ক ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। মে, জুন, জুলাই মাসে তা ক্রমাগতভাবে বেড়ে আগস্ট মাসে গিয়ে পৌঁছায় ৯.৫২ শতাংশে, যা ছিল গত ১১ বছরের মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। তবে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে এই মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতির দিকে থাকলেও তা এখনো ৮.৫ শতাংশের ওপরে। ডিসেম্বর মাসের মূল্যস্ফীতির হিসাব এখনো দেয়নি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, দেশের বাজারে মূল্যস্ফীতি হয়েছে মূলত তিন কারণে। একটি হলো কভিড ও যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি; দ্বিতীয়টি হলো বৈশ্বিক ও দেশীয় প্রেক্ষাপটে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি; আর তৃতীয়ত বাজার অব্যবস্থাপনা।
তবে চলতি বছরের শেষ মাস ও নতুন বছরের প্রথম মাস থেকে মূল্যস্ফীতি কমবে বলে মনে করছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সম্প্রতি তিনি বলেন, ‘এখন মূল্যস্ফীতির হার নিম্নমুখী এবং মজুরিহার ঊর্ধ্বমুখী। এটা ভালো লক্ষণ। আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কমবে। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল হবে। তিনি আরো বলেন, ‘দেশে সবজির উৎপাদন গত কয়েক বছরে ছয় গুণ বেড়েছে। দেশি ফলের পাশাপাশি বিদেশি ফলের উৎপাদন ব্যাপক হারে বেড়েছে। সরবরাহ চেইন ভালো আছে। রেমিট্যান্সপ্রবাহ ভালোর দিকে মোড় নিচ্ছে। ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’
চলতি বছরের আগস্টে দেশের বাজারে পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন, অকটেনসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বেশ বড় অঙ্কে বাড়ানো হয়। এর বড় প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে। যদিও পরবর্তী সময়ে দাম কিছুটা সমন্বয় করে ২৯ আগস্ট সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারে পাঁচ টাকা কমানো হয়েছে। কিন্তু সেটি মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সার্বিক মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ছিল। জানুয়ারি মাসে ৫.৮৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ফেব্রুয়ারি মাসে দাঁড়ায় ৬.১৭ শতাংশে। গ্রাম-শহর সব জায়গাতেই এই মূল্যস্ফীতির গতি ঊর্ধ্বমুখী। বাড়তে বাড়তে আগস্ট মাসে এই মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯.৫২ শতাংশে। ২০২১ সালের আগস্টে যা ছিল ৫.৫৪ শতাংশ। এর অর্থ হলো ২০২১ সালে ১০০ টাকার যে সেবা বা পণ্য ১০৫.৫৪ টাকায় পাওয়া যেত, ২০২২ সালের আগস্টে সেই ১০০ টাকার সেবা বা পণ্য ক্রয় করতে খরচ হয়েছে ১০৯.৫২ টাকা।
রাজধানীর রিকশাচালক আব্দুল মজিদ বলেন, ‘অ্যাঁরা (আমরা) এত কিছু (মূল্যস্ফীতি) বুজবার পাই না। বুজবার পাই চাউলের দাম বাড়লে বাজার করতে বেশি টেকার (টাকা) দরকার হয়। আগে সকালে ভাত খাইয়্যা বাইর হইতাম, এখন রুটি খাইয়া বাইর হই। সব খাবারের বাড়তি দাম। ভাতের প্লেট এহন ১৫ টেকা। একবেলা ভাত খাইতেই লাগে ৫০ টেকা, আগে লাগত ৩৫ টেকা।’
বিবিএস বলছে, বছরের শুরুর মাসে শহরের ৫.৪৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি আগস্ট মাসে দাঁড়ায় ৯.১৮ শতাংশে। নভেম্বর মাসে তা কমে দাঁড়ায় ৮.৭০ শতাংশে। আর গ্রামীণ মূল্যস্ফীতি জানুয়ারিতে ৬.০৭ শতাংশ থেকে নভেম্বর মাসে দাঁড়ায় ৮.৯২ শতাংশে। আগস্টে যা ছিল ৯.৭০ শতাংশে।
পরিকল্পনামন্ত্রীর মতে, এই মূল্যস্ফীতি দেশের অভ্যন্তরীণ কারণে হয়নি। সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের নিজেদের কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে না। এটা আন্তর্জাতিক বিষয়। এর আগে করোনা মহামারির কারণে অনেকটা চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। পরে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আমাদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাশিয়া থেকে তেল কিনছে সবাই। ইউক্রেনও কিছু পণ্য রপ্তানি শুরু করেছে। পাশাপাশি প্রণোদনা প্যাকেজের মতো প্রধানমন্ত্রী দ্রুত কৃচ্ছ সাধন এবং আমদানি ব্যয় কমানোর ফলে ডলার ভয়ংকর রূপ ধারণ করেনি।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তেমন মূল্যস্ফীতি বাড়েনি। বিদেশে ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে পৌঁছেছে। আমাদের এখানে ৫ শতাংশ থেকে তা ৯ শতাংশে গেছে, খুব বেশি বাড়েনি। যদিও এই হিসাব প্রশ্নবিদ্ধ। ’ সামনের দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতি কমার জন্য প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাঠের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এবার আমনের ফলন ভালো। তবে দাম একটু বেশি, সেটা কৃষক পর্যায় থেকেই। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি সমনের দিনে কিছুটা কমতির দিকে থাকবে।’