- শেখ নাঈমুল ইসলাম
গোটা বিশ্ব আজ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইল ইতিহাসের জঘন্যতম নর-সংহার চালাচ্ছে। ইসরাইলের মানবতা-বিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে বিশ্ব মোড়লরা আজ মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।
স্বজনের রক্তে রঞ্জিত নিষ্পাপ শিশুর আর্তনাদ যেমন আজ বিশ্ব-মোড়লদের মানবতা উদ্রেক করে না ঠিক তেমনি এই বঙ্গদেশেও আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এমন রক্তের হোলি খেলা চলেছে, তখনও তারা নির্বিকার ছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষকে তখন গাজার চাইতেও নির্মম নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এত অল্প সময়ে এত বড় জেনোসাইডের নজির মানব-ইতিহাসে নেই। পার্থক্য শুধু ধর্মের। আজ ফিলিস্তিনে ইহুদীরা মারছে আরব মুসলমানদের আর পঞ্চাশ বছর আগে এই দেশে বাঙালী মুসলমানদের হত্যা করেছে পাকিস্তানি পাঞ্জাবী মুসলমান। সেদিনও বিশ্ব মোড়ল অনেকেই বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি। বরং পাকিস্তানি নরপিশাচ সেনাবাহিনীকে আরও বাঙালী মুসলমান নিধন করতে সহযোগিতা পাঠিয়েছিলো।
আজ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। পঞ্চাশ বছর আগে এই দিনে আমারা পাকিস্তান নামক অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তি সংগ্রাম শুরু করেছিলাম। বাংলাদেশের স্বাধীন দিবসে দাড়িয়ে বিশ্বের আরেক স্বাধীনতাকামী জাতির মুক্তি আলোচনার দাবী রাখে। বাংলাদেশ এবং ফিলিস্তিনের তুলনামূলক আলাপ জরুরী।
বিগত সত্তর বছরের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছেনা। এর অন্যতম প্রধান কারণ একজন অবিসংবাদিত নেতার অনুপস্থিতি। একটি জাতির মুক্তিসংগ্রামের জন্য সর্বপ্রথম একজন ক্যারিশমাটিক নেতার প্রয়োজন হয়। যিনি তার ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে গোটা জাতীকে জাগিয়ে তোলেন। হ্যামিলনের বাঁসিওয়ালার মত মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গোটা জাতি মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাধীনতার সোপানতলে প্রাণ উৎসর্গ করে। বাঙ্গালি জাতির সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধুর মত এমন একজন নেতা বাংলাদেশ পেয়েছিলো কিন্তু ফিলিস্তিনের দুর্ভাগ্য তাদের মধ্য দিয়ে এত বছরেও বঙ্গবন্ধুর মত একজন অবিসংবাদিত নেতা তৈরি হয়নি। যাও একজন তৈরি হয়েছিলো ইয়াসির আরাফাত কিন্তু তিনি গোটা জাতিকে প্রভাবিত করতে পারেননি। অসলো চুক্তির দ্বারা তিনি তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় বড় সমস্যা যে বিষয় সেটি হলো রাজনৈতিক বিভাজন। হামাস আর ফাতাহের মধ্যকার বিরোধ। সামান্য যেটুকু ভূখণ্ড নিজেদের আয়ত্তে রাখতে পেরেছে তার ভিতরেও নানা দল উপদলে বিভক্ত। ছোট ফিলিস্তিন দুই দল দ্বারা শাসিত। এই জাতীয় অনৈক্য নিয়ে কোন রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রামে বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আওয়ামীলীগ একদিকে যেমন জাতীয় ঐক্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র দুই দিকেই নেতৃত্ব দিয়েছে ফলে স্বাধীনতা সংগ্রাম গতি লাভ করেছে এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফল এসেছে।
বাঙ্গালি জাতির সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধুর মত এমন একজন নেতা বাংলাদেশ পেয়েছিলো কিন্তু ফিলিস্তিনের দুর্ভাগ্য তাদের মধ্য দিয়ে এত বছরেও বঙ্গবন্ধুর মত একজন অবিসংবাদিত নেতা তৈরি হয়নি।
বিশ্বের ক্ষমতাধর সুপার পাওয়ার কোন রাষ্ট্রের সহযোগিতা আদায় করতে না পারা ফিলিস্তিনের আরেকটি ব্যর্থতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম গতি পেয়েছে এবং তরান্বিত হয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সার্বিক সহযোগিতায়। এই সহযোগিতা তৎকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আদায় করতে পেরেছিলো। ভারতের সহযোগিতা আদায় করার দ্বারা আরেক সুপার পাওয়ার রাশিয়ারও সমর্থন আদায় হয়েছে ফলে ব্রিটেন, চায়না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল বিরোধিতা এমনকি মার্কিনীদের সপ্তম নৌবহর যাত্রা কোনকিছুই কাজে আসেনি। ফিলিস্তিনের সমস্যা তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দ কোন সুপার পাওয়ার রাষ্ট্রের সাথে মজবুত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়া। আমেরিকা ও ব্রিটেন যখন ইসরাইলকে অস্ত্র দিয়ে ঋণ দিয়ে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে সেখানে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এন্টি আমেরিকার বেল্টকে নিজেদের স্বাধীনতার কাজে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে।
ফিলিস্তিনি নেতাদের প্রবাসে থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করা বুমেরাং হয়েছে। পিএলও দীর্ঘকাল যাবত প্রবাসে থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করেছে যার ফলে আন্দোলনে গতি আসেনি। বর্তমানেও ফাতাহ শুধু দেশের ভেতর রাজনৈতিক সরকার গঠন করে বসে আছে ওদিকে গাজার নিয়ন্ত্রণ হামাসের হাতে তারা সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করছে প্রবাসে থেকে। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিকে তাকালে দেখতে পাই রাজনৈতিক নেতারা প্রবাসী সরকার গঠন করে ভারত থেকে গোটা বিশ্বে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সংগ্রাম করেছে অর্থ ও অস্ত্রের জোগান দিয়েছে জনমত গঠনে সচেষ্ট থেকেছে অপরদিকে দেশের ভিতর মুক্তিবাহিনী প্রবলভাবে যুদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আওয়ামীলীগ একদিকে যেমন জাতীয় ঐক্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র দুই দিকেই নেতৃত্ব দিয়েছে ফলে স্বাধীনতা সংগ্রাম গতি লাভ করেছে এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফল এসেছে।
আমরা যদি সার্বিকভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাই গত সত্তর বছরের আন্দোলন সংগ্রামে সুদূর পরিকল্পনা, জোরালো নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা, জাতীয় ঐক্য, কুটনৈতিকতা, সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এই সকল বিষয়ে চরম শৃঙ্খলাহীনতা এবং অপরিকল্পিত সংগ্রাম চোখে পড়ে। ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রাম যতটা না কৌশলী তার চেয়ে অনেক বেশি আবেগাশ্রিত। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আবেগের চাইতে অনেক বেশি কৌশলী হতে হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিলিস্তিনের অনেক কিছু নেবার আছে, শিখবার আছে। হয়তো তাদের নেতৃবৃন্দ আরও শিখবে জানবে, আগুনে পুড়ে খাটি সোনা হবে। এই অভাগা সোনার বাংলার মত আকসার সোনালি গম্বুজেও স্বাধীন ফিলিস্তিনের পতাকা উড়বে। এই সবুজ শ্যামল বাংলার মত ফিলিস্তিনি পাহাড় উপত্যকাও জলপাই গাছের সবুজে সবুজাভ হয়ে উঠবে। শিশুরা সমস্বরে গেয়ে উঠবে
আমার জন্মভূমি আমার জন্মভূমি
গৌরব ও সৌন্দর্য, মাহাত্ম্য ও দ্যুতি
তোমার পাহাড়ে তোমার পাহাড়ে
*
লেখক, সমাজ বিশ্লেষক