বাজারে চলছে পেঁয়াজের ঝাঁঝালো দামের অন্যায্য অস্থিরতা

বাজারে চলছে পেঁয়াজের ঝাঁঝালো দামের অন্যায্য অস্থিরতা

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম: আগাম মুড়িকাটা পেঁয়াজও প্রায় একই হারে বেড়ে গতকাল প্রতি কেজি ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। যদিও গত শুক্রবার কৃষকরা দেশি পেঁয়াজ ও আমদানিকারকরা ভারতীয় পেঁয়াজ পাইকারি বিক্রি করেছেন ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। সেই হিসাবে কৃষক ও আমদানিকারকের সঙ্গে গতকালের বিক্রির ফারাক ১০০ টাকার বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৮৫ হাজার ৩২৭ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল তিন লাখ ২৯ হাজার ১২১ টন।

এবার দুই লাখ ৫৬ হাজার ২০৫ টন বেশি আমদানি হয়েছে। আর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে ছয় লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন হয়েছে। এ অবস্থায় বাজারে সংকট থাকার কথা নয়।

ঘুরেফিরে পেঁয়াজের ঝাঁজ

পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দামের ভোগান্তি এবারই প্রথম নয়। আগাম সতর্কতা ছাড়া ২০১৯ ও ২০২০ সালে যথাক্রমে ২ ও ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। তখন প্রতি কেজি পেঁয়াজ কিনতে ৩০০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়েছিল। ওই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়। এমনকি দ্রুত বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য উড়োজাহাজে করে অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়েছিল।

দেশে বেশির ভাগ পেঁয়াজ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। তখন সমুদ্রপথে চীন, মিসর, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল। ওই সময়ে সরকার গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ ও মৌসুমি পেঁয়াজ যথাযথভাবে সংরক্ষণের কথা বলেছিল।

সাবেক বাণিজ্যসচিব ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এবার ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দিলেও সরবরাহ বন্ধ করেনি। সরকারি পর্যায়ে এখন আমদানির সুযোগ রেখে দিয়েছে ভারত। তবু দেশের ব্যবসায়ীরা বাজারে সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা অতিমুনাফালোভী হওয়ায় ভোক্তারা এমন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন।

গোলাম রহমান বলেন, এসব অসৎ ব্যবসায়ীদের বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। পাশাপাশি রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার প্রভাবমুক্ত থাকতে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ জন্য পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধি, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

সারা দেশে পাইকারি বাজারে অস্থিরতা

পেঁয়াজের দামের এই অস্থিরতা পাইকারি মোকাম থেকে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। নিষেধাজ্ঞার খবরে স্থলবন্দরগুলোর আড়ত থেকে দেশি পেঁয়াজের মোকাম খ্যাত পাবনা, ফরিদপুর ও রাজশাহীর আড়তগুলোয় একযোগে দাম বেড়ে যায়। যদিও দেশি পেঁয়াজের সঙ্গে এই বিধি-নিষেধের সম্পর্ক নেই।

বৃহস্পতিবার ঢাকার বাইরের পাইকারি আড়তে ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। কিন্তু গতকাল পাবনা বড় বাজারের পাইকারী ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, মৌসুমের শেষ সময়ের মজুদ পুরনো পেঁয়াজ এখনো বাজারে আসছে। পুরনো পেঁয়াজের কেজি এখন ১৭০-১৮০ টাকা ও নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজ ১২০-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর হিলি স্থলবন্দরে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৯০ টাকা বেড়েছে।

রাজধানীর শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মাজেদ বলেন, ‘কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কারসাজি করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বাজারে নতুন পেঁয়াজের সরবরাহ ব্যাপকভাবে বাড়বে, তখন এমনিতেই পেঁয়াজের দাম কমে আসবে।’

আব্দুল মাজেদ বলেন, ‘দেশি পেঁয়াজ না থাকায় গত বৃহস্পতিবার ভারতীয় পেঁয়াজ পাইকারিতে কেজি ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। শনিবার পাইকারিতে ভারতীয় পেঁয়াজ কেজি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।’

কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজের আড়তদার মো. জালাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে জানান, শনিবার পাইকারিতে দেশি পেঁয়াজ ১৮০ থেকে ২০০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি করেছেন তিনি। গত দুই দিনে তাঁদের আড়তে সব ধরনের পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৬০ থেকে ৭৫ টাকা বেড়েছে।

এক দিনে ১১৩ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা

পেঁয়াজের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ঢাকাসহ সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গতকাল সারা দেশে ৫৭টি বাজারে অভিযান চালিয়ে ১১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ছয় লাখ ৬৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। বাজারে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। এর পরও কোনো ব্যবসায়ী মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।

সুযোগ রেখে নিষেধাজ্ঞা

দেশে মৌসুমের শেষ সময়ে পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা নতুন নয়। তবে এবার নিষেধাজ্ঞা কিছুটা ব্যতিক্রমী। আমদানিকারকদের জন্য বিধি-নিষেধ থাকলেও কোনো দেশের সরকার অনুরোধ করলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রপ্তানির সুযোগ দিতে পারবে-রপ্তানি নীতিতে এমন পথ খোলা রাখা হয়েছে।

দেশটির স্থানীয় বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রতি টন পেঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য ৮০০ ডলারে বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আগামী বছরের ৩১ মার্চ অর্থাৎ আরো তিন মাস বহাল রাখবে ভারত। ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেডের দপ্তর থেকে বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে একটি আদেশ জারি করা হয়। এর আগে পেঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য ৮০০ ডলারে বেঁধে দিয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর উল্লেখ করে গত ২৮ অক্টোবর আদেশ জারি করেছিল ভারত।

ভারতের ডিজিএফটির জারি করা আদেশ অনুযায়ী, এরই মধ্যে যাঁরা পেঁয়াজ আমদানির এলসি করেছেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা আদেশ জারির আগেই পণ্য জাহাজীকরণ শুরু করেছেন, তাঁরা পেঁয়াজ আনতে পারবেন। শিপিং বিল জমা দিলে এবং সংশ্লিষ্ট জাহাজ বন্দরে ভিড়লে বন্দর কর্তৃপক্ষ এ ধরনের চালান অনুমোদন করবে।

আদেশে আরো বলা হয়, পেঁয়াজের চালান এই আদেশ জারির আগেই যদি ক্রেতাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় এবং পণ্য বন্দরে ঢুকে সংশ্লিষ্ট কাস্টমস দপ্তরের ইলেকট্রনিক সিস্টেমে নিবন্ধিত হয়ে যায়, তখনো রপ্তানির সুযোগ থাকবে। বন্দরের এসব প্রক্রিয়ার সুবিধা আগামী ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বহাল থাকবে।

আগাম প্রস্তুতি নিয়েও বাজার সামলাতে পারেনি

ভারতের কড়াকরিতে গত আগস্টে কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ভারত ছাড়াও আরো ৯ দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। ওই সময় পর্যন্ত ১৩ লাখ ৭৩ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তখন চীন থেকে দুই হাজার ৪০০ টন, মিসর থেকে তিন হাজার ৯১০ টন, পাকিস্তান থেকে ১১ হাজার ৮২০ টন, কাতার থেকে এক হাজার ১০০ টন, তুরস্ক থেকে দুই হাজার ১১০ টন, মিয়ানমার থেকে ২০০ টন, থাইল্যান্ড থেকে ৩৩ টন, নেদারল্যান্ডস থেকে চার টন ও ইউএই থেকে তিন টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টন। চাহিদার ৮০ শতাংশ পেঁয়াজ দেশেই উৎপাদিত হয়। তবে উৎপাদিত পেঁয়াজের এক-চতুর্থাংশ পচে নষ্ট হওয়ার কারণে প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ লাখ টন আমদানি করতে হয়। আমদানি করা পেঁয়াজের ৯৫ শতাংশই আসে ভারত থেকে। ভারত বিধি-নিষেধ দিলেই কেবল মিয়ানমারসহ বিকল্প দেশ থেকে আমদানি করা হয়।

পরিস্থিতি বদলের উদ্যোগ

দেশে উৎপাদন বাড়াতে চলতি অর্থবছরে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের নাবি জাতও (লেইট ভ্যারাইটি) আবাদ করতে দুই দফায় ৩১ কোটি ২০ লাখ টাকার প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। দেশের ৩৬ হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে এই প্রণোদনার আওতায় বিনা মূল্যে বীজ, সার এবং শ্রমিক মজুরি হিসেবে নগদ দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়।

দাম বেঁধে দিয়েও কাজ হচ্ছে না

বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো পেঁয়াজসহ তিনটি কৃষিপণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল সরকার। বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী, দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ৬৪-৬৫ টাকা। কিন্তু নিয়মিত বাজার অভিযানের পরও ওই দাম কার্যকর করতে পারেনি সরকার। এখন নতুন পরিস্থিতিতে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা ক্রেতারা আরো চাপে পড়বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *