- আশরাফ উদ্দীন রায়হান
হাওরের বুক চিড়ে সর্পিল গতিতে আঁকাবাঁকা পিচঢালা রাস্তা বেয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। চোখজুড়ানো পরিচ্ছন্ন পথের দু পাশে হাওরের অথৈ জলরাশি। ভরদুপুরের সূর্য তখন মধ্যগগনে। তীব্র বিকিরণের চোখধাঁধানো সূর্যরশ্মি হাওরের তরঙ্গায়িত জলরাশিতে সোনালি প্রদীপ হয়ে যেন জ্বলছে আর নিভছে। চিকমিক-ঝিকমিক করছে পানির ঢেউ।
ঢেউয়ের ওপরে ভাসমান পালতোলা নৌকাগুলো হেলছে আর দুলছে। স্পিডবোটের গতি যেন বন্দুকের গুলি! পথের দু পাশে পানির ওপরে টঙ; খাবার-দাবারের ব্যবস্থা। সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের মিলনমেলা এই বালিখোলা। তাই তো আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার উপচে-পড়া ভীড়ের মাঝে তিল ধারণের ঠাঁই নেই এখানে।
বালিখোলায় আমার যাওয়াটা ছিল পুরাই কাকতালীয় ব্যাপার। ২০১৯ সালের কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ি তখন। কুরবানী ঈদের ছুটিতে বাড়িতে সময় কাটাচ্ছি। ঘোরাঘুরির জন্য মোক্ষম মানুষ মামুন ভাইয়ের আকস্মিক প্রস্তাবেই রাজি হয়ে যাই। অবশেষে আমিনুল ভাই, রাসেল ভাই, মামুন ভাই, মিজান ভাই আর আমি পাঁচজনে মিলে গেলাম কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার বালিখোলা নামক দৃষ্টিনন্দন জায়গাটিতে।
বাঙালির অ্যাসথেটিক সেন্স বা সৌন্দর্যবোধ কতটুকু কী, তার যথার্থতা নির্ণয় করতে হলে প্রয়োজন গবেষণার। আমার মনে হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ অতীতে বাঙালির ছিল বা ছিল না; কিন্তু হালে আমাদের মধ্যে নৈসর্গিক বা নয়নাভিরাম যেকোনো দৃশ্যপটের প্রতি অতীব আগ্রহ পয়দা হয়েছে। সত্যি বলতে কি, আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে প্রকৃতির মোহনীয় রূপের প্রতি অতিশয় দুর্বল!
যা হোক, বালিখোলায় গিয়ে দেখি জাহাঙ্গীর ভাই, নিলয় আর ফয়সাল আমাদের জন্যে অপেক্ষমাণ। তারা তিনজনই পানিতে নামার জন্য প্রস্তুত। নিলয় আমাদেরকে জলদি পানিতে নামার জন্যে পীড়াপীড়ি শুরু করলো। মিজান ভাই ছাড়া বাকি সাতজন নামলাম পানিতে। পানিতে নামার কোনো চিন্তা-ভাবনা মোটেও ছিল না। লুঙ্গি-গামছা কিছুই আনিনি; পানিতে নামব কী করে!? আমাকে বলা হলো পাঞ্জাবি আর টুপিটা খুলেই নেমে যাও। তাই করলাম। পরনে হাফ হাতা গেঞ্জি আর পাজামা। পানিতে নামলাম সাতজন।
হাঁটুপানি থেকে ঊরু সমান। তারপরে কোমরপানি। এরপরে বুকপানি। অনেকটা জায়গাজুড়েই এরকম গভীরতা। কিন্তু দূর ভাটি থেকে ভরা বর্ষার যে তীব্র স্রোত নিত্য খেলা করছে পানিতে, সেখানে বলপ্রয়োগ ছাড়া স্থির দাঁড়িয়ে থাকাটা কঠিনই বটে। আমি পানির ব্যাপারে এমনিতেই ভীতু প্রকৃতির। তারপরেও অন্যদের দেখাদেখি কিছুটা ছেলেমানুষী করে পানিতে নেমে মজা করেছি। ফয়সাল আর নিলয় হঠাৎ করে একটি গর্তে পড়ে গেল! কাবুকাবু অবস্থা! অনেকটা ভড়কেই গেল ওরা। আমিনুল ভাই, রাসেল ভাই আর মামুন ভাই অনেকটা দূরে সাঁতরিয়ে এসেছেন। শ্যাম্পু দিয়ে আমরা মাথার চুল আর দাড়ি মেসাজ করেছি।
স্মার্টবয় নিলয় ছবি তুলল বেশ কতগুলো। মওকা বুঝে নিজেরও কয়েকটা ক্লিক নিয়ে নিলাম। মামুন ভাই আর নিলয়ের স্পিডবোটে চড়ার আগ্রহ থাকলেও, শেষাবধি সময় স্বল্পতাই তা আর হয়ে ওঠেনি। বালিখোলাস্থ মসজিদটিতে সালাতুল আসর আদায় করে নিলাম।
গোধূলী লগ্ন হয়ে আসছে। আকাশটাও পিঙ্গল। পথের দূরত্ব কমবে আর ভেজা কাপড়গুলো শুকাবে, এই ভাবনায় আমরা ফের গাড়িতে চেপে বসলাম।
- লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী