- আমিনুল ইসলাম কাসেমী
আমি চিনিনা মাওলানা মাহফুজ আহমাদ সাহেবকে। শুনেছি তিনি নাকি ইংলান্ডে থাকেন। বাংলাদেশে সিলেটে জামেয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা এর শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে ইংল্যান্ড প্রবাসী। তবে অনলাইনে তার একটা বক্তৃতা শুনে অভিভূত হলাম। হৃদয় ভরে গেল। তার প্রতি অনেক ভালবাসা জন্মালো। মুলত তিনি ওলামায়ে দেওবন্দের বিশ্বব্যাপি ঐতিহ্য-অবদান যেভাবে তুলে ধরেছেন সেটা প্রত্যেক মানুষের দিলে রেখাপাত করবে।
এর আগে পাকিস্তানের আল্লামা তাকি উসমানী দামাতবারাকাতুুম এর ” সফর দর সফর” কিতাবে পড়েছিলাম কীভাবে ওলামায়ে দেওবন্দ বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে আছে। তাদের ঐতিহ্য-অবদান কত বিস্তৃত সেটা ওই কিতাব থেকে কিছুটা অনুমেয় হয়েছিল। আজকে মাওলানা মাহফুজ আহমেদ ( ইংল্যান্ড) তার বক্তৃতায় অনেক অজানা বিষয় জানা গেল। ইউরোপ এর দেশ সমূহে কীভাবে দ্বীনি পরিবেশ তৈরী হয়েছে? সেখানে কীভাবে দ্বীনি মাদ্রাসা গড়ে উঠল? বর্তমান ইউরোপের বিভিন্ন জায়গাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, সেখানে গেলে মনে হয় না এটা ইউরোপ বরং এই উপমহাদেশের দ্বীনি মারকাজের মত অবস্হা। তবে কীভাবে সৃষ্টি হল এমন পরিবেশ? কাদের অবদান?
মাওলানা মাহফুজ আহমাদ সাহেব বলেন, ইংল্যান্ডে মুসলমানের সংখ্যা শতকরা ৬ ভাগ। ওদিকে ফ্রান্সে মুসলমানের সংখ্যা ইংল্যান্ড থেকেও অনেক বেশী।সেখানে শতকরা ৯ ভাগ মুসলমান বাস করে। তবে ফ্রান্সে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য হওয়া সত্বেও আজো সেখানে ইংল্যান্ডের মত দ্বীনি পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। বরং দ্বীনি তাহযিব-তামাদ্দুন থেকে অনেক পিছে। এর কারণটা কী?
তিনি বলেন, ফ্রান্সে যেসব মুসলমান এসেছে তারা অধিকাংশ, মরক্কো, আলজেরিয়া, এসমস্ত অঞ্চলের। তারা ফ্রান্সে গিয়ে কোন দ্বীনি মারকাজ গড়ে তুলতে পারেন নি। বরং নিজেদের ঈমান হেফাজত নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। ওদিকে ইংল্যান্ডে যারা মুসলমান এঁরা এই ভারত উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশ, ভারত,পাকিস্তান বংশদ্ভুদ। এঁরা দেওবন্দী নেসবাতের তথা দেওবন্দী ওলামায়ে কেরাম। এসকল মুসলমান এবং ওলামায়ে কেরাম ইউরোপের যেখানেই গিয়েছেন সেখানে নিজের ঈমান হেফাজতের পাশাপাশি মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। মানুষকে দ্বীনি শিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন।
ইংল্যান্ডের বহু জায়গাতে দাওরায়ে হাদীস মাদ্রাসা আছে, সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর হাজারো আলেম তৈরী হয়ে দ্বীনি খেদমতে ছড়িয়ে পড়ছেন। সারা ইউরোপে দ্বীনের প্রচার- প্রসার ঘটাচ্ছে। যেকারণে ইংল্যান্ড একটা আধুনিক রাষ্ট্র হওয়ার পরেও সেখানকার ওলামা-মাশায়েখদের মেহনতে একটা দ্বীনি পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়।
সেখানে গেলে বোঝা যায় না আমি ইউরোপে আছি। তিনি এ প্রসঙ্গে তুরস্কের একজন বড় আলেম, যিনি বর্তমান এ বিশ্বের অন্যতম হাদীস বিশারদ , তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ওলামায়ে দেওবন্দ যেখানে যায়, সেখানে মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয়। সে হিসাবে ইংল্যান্ডে যত ওলামায়ে কেরাম গিয়েছেন, সকলেই মসজিদ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে সেখানে দ্বীনি পরিবেশ কায়েম করেছেন। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে যেসব মুসলমান ইংল্যান্ডে গিয়েছে তারা কেউ এমন দ্বীনি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি।
আরো মজার বিষয় শোনালেন মাওলানা মাহফুজ সাহেব, দারুল উলুম দেওবন্দের সূর্যসন্তান, শাইখুল ইসলাম সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী ( রহ.) এর সাহেবজাদা, ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী ( রহ.) এর অবদানের কথা। যিনি ইউরোপের প্রতিটি দেশ, প্রতিটি শহর সফর করেছেন। আর তিনি বক্তৃতার মাধ্যমে মুসলিমদের বারবার উৎসাহ দিতেন মাদ্রাসা এবং মুসলিম প্রাইভেট স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য এবং তিনি বহু মাদ্রাসা ও স্কুল সেখানে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিভিন্ন শহরে তাঁর একই বক্তব্য ছিল, তোমরা মাদ্রাসা এবং মুসলিম স্কুল গড়ে তোলো। যে কারণে ইংল্যান্ডের প্রায় সব শহরে মাদ্রাসা এবং প্রাইভেট স্কুল গড়ে ওঠেছে। ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী ( রহ.) এর মেহনতে আজ ইংল্যান্ডের বুকে দ্বীনি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী ( রহ.) ইংল্যান্ডের বিভিন্ন মজলিসে, বিভিন্ন সেমিনারে এভাবে বক্তৃতা করেছেন, ‘তোমরা এক বেলা খাবে আরেক বেলা অনাহারে থাকবে। যে বেলা অনাহারে থাকবে সেটার পয়সা জমা করে তোমাদের ছেলে মেয়েদের মাদ্রাসা এবং প্রাইভেট স্কুলে পড়ানোর চেষ্টা করবে।’ কেননা ইংল্যান্ডে সরকারি স্কুল -কলেজে ফ্রি পড়ানো হয়। এমনকি দুপুরের খাবার স্কুল থেকে দেওয়া হয়। কিন্তু মাদ্রাসা এবং প্রাইভেট স্কুলে পড়ালে অনেক খরচ। সেখানে সরকারের কোন সহযোগিতা নেই। একটা উন্নত দেশে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পড়াতে সাধারণ পরিবারের জন্য হিমশিম খেতে হয়। সে কারণে ফেদায়ে মিল্লাত এক বেলা অনাহারে থেকেও মাদ্রাসা এবং মুসলিম প্রাইভেট স্কুলে সন্তানদের পড়াতে বলেছিলেন।
ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী এর মেহনত কাজে লেগেছে পুরোপুরি। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে ইংল্যান্ডে এখন প্রচুর পরিমাণে মাদ্রাসা এবং স্কুল গড়ে ওঠেছে। যেকারণে আজ ইংল্যান্ডের বাতাসে দ্বীনি আবহাওয়া বিরাজ করছে। একটি দ্বীনি ফেজা কায়েম হয়েছে।
আমাদের বাংলাদেশেও ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী সফর করতেন, তাঁর মুখ থেকে এমন বক্তব্য শুনতাম। আমার তো স্পষ্ট মনে আছে, সেই নব্বই দশকে ঢাকা জামেয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে ফেদায়ে মিল্লাত বক্তৃতা করেছিলেন, সেখানে তিনি বারবার খৃষ্টান মিশনারীর মোকাবেলায় ইসলামিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছিলেন। ফেদায়ে মিল্লাতের সেই পরামর্শ অনুযায়ী সর্বপ্রথম “ইকরা বাংলাদেশ” স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়। তাঁর রুহানী তাওয়াজ্জুহ এবং দুআ থেকেই বাংলাদেশে আলেমদের নেতৃত্বে স্কুল শুরু হয়। যেটার শাখা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতে ছড়িয়ে পড়ে।
ইকরা বাংলাদেশ ছাড়াও আরো বিভিন্ন নামে আলেমদের পরিচালনায় স্কুল চালু হতে থাকে। এটার মূল পরামর্শ দাতা এবং কারিগর ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী।
মোটকথা ওলামায়ে দেওবন্দের অবদান বিশ্বব্যাপি। পৃথিবীর এমন কোন জায়গা নেই যেখানে দেওবন্দী আলেমগণ যায়নি। আর যেখানে তারা গিয়েছেন সেখানেই আলেমগণ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। মানুষের হেদায়েতের আলোকবর্তিকা হিসাবে কাজ করেছেন। একটা এলাকার অন্ধকার এবং কুংস্কার পরিবেশ থেকে ইসলামী ভাবধারা, ইসলামী সভ্যতা- সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন।
এজন্য আমরা যেখানেই যাব সেখানেই ওলামায়ে দেওবন্দের বিস্ময়কর কীর্তি দেখতে পাব। পৃথিবী জুড়ে মানুষের মাঝে তারা মিশে আছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে তাওহিদের বাণী প্রচার করেছেন। একটা বিরাম-বিশ্রামহীন জামায়াত ওলামায়ে দেওবন্দ।
এঁরা নিজেদের নিয়ে শুধু চিন্তা করেনি। বরং সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে মানুষের সংশোধনের চিন্তা তারা করে গেছেন। তার জন্য তাদের মেহনত এবং কঠিন অধ্যাবসা ও পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাদের এমন অধ্যাবসায়ে বিশ্বব্যাপি এক তাহরিক-আন্দোলন শুরু হয়েছে। যে আন্দোলনের ফসল এখন পুরো দুনিয়াতে লক্ষ্য করা যায়।
আল্লাহ ওলামায়ে দেওবন্দের মেহনতকে কবুল করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট