পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম: পৃথিবীর ভূত্বকের নিচে আধা-তরল আবরণে ভেসে থাকা ভূত্বকের বৃহৎ অংশগুলো “টেকটোনিক প্লেট” নামে পরিচিত। এই প্লেটগুলোর নড়াচড়ার সময় প্রতি দুই প্লেটের মাঝের জায়গায় ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়। এই ঘর্ষণের আশেপাশের এলাকায় চাপ সৃষ্টি করে। এর চূড়ান্ত অবস্থায় একটি সিসমিক তরঙ্গ প্রবাহিত হয়, যা প্লেটগুলোর সংঘর্ষ সংলগ্ন এলাকাজুড়ে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করে। এর প্রচণ্ডতায় ঘনবসতিপূর্ণ বিশেষ করে বড় বড় স্থাপনা সম্বলিত জায়গাগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জাপান
ভূমিকম্প এলাকা হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ একটি দেশ জাপান। ভূমিকম্প ছাড়াও আগ্নেয়গিরি এবং উষ্ণ প্রস্রবণের জন্য রীতিমত প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বলা যেতে পারে জাপানকে। এটি ভৌগলিকভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয়, ফিলিপাইন, ওখটস্ক এবং ইউরেশীয় প্লেট; এই চারটি টেকটোনিক প্লেটের সীমানায় অবস্থিত।
এই সীমান্তগুলোকে ঢেকে রাখা সামুদ্রিক পরিখা ও খাদের বিশাল জলাশয় ঘিরে রয়েছে জাপানী দ্বীপপুঞ্জকে। প্যাসিফিক রিং অফ ফায়ার হিসেবে পরিচিত প্রশস্ত এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পের শিকার হওয়া দেশটি জাপান।
১৯৯০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে জাপানে মোট ৯৪টি ভূমিকম্প হয়েছে। এগুলোর মধ্যে একুশ শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পের মধ্যে রয়েছে ২০১১-এর তোহোকু ভূমিকম্প ও সুনামি। ৯ থেকে ৯.১ মাত্রার এই ভূ-কম্পনে প্রাণহানি ঘটেছিল ১৯,৭৫৯ জন মানুষের। ২০১৬-এর কুমামোটো ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে মৃত্যু সংখ্যা ছিল ২৭৩ জন।
তুরস্ক
তুরস্কের অধিকাংশ এলাকা আনাতোলিয়ান প্লেটে অবস্থিত। উত্তর এবং পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্ট দুটির সীমানায় অবস্থানের কারণেই মূলত দেশটি ভূমিকম্পপ্রবণ। এছাড়া দেশের পশ্চিম অংশজুড়ে রয়েছে এজিয়ান সাগরে সম্প্রসারিত টেকটোনিক অঞ্চল। ইউরেশীয়, আফ্রিকান এবং আরব প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষের প্রভাবও পড়ে এই মধ্য-এশিয়ার দেশটির ওপর।
১৯৯০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে তুরস্ক ৫৮টি ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়েছে। ২০২৩-এর ৭ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত ভূমিকম্পটি ছিল ৭.৮ মাত্রার, যেখানে ৫৯,২৫৯ জন মানুষ মারা গিয়েছিল। ২০২০-এর এজিয়ান সাগর থেকে সৃষ্টি হওয়া ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল ১১৯ জন মানুষ।
ইরান
গোটা ইরান জুড়ে বড় বড় বেশ কয়েকটি ভূতাত্ত্বিক ফল্ট লাইন রয়েছে। আরবীয়, ভারতীয় এবং ইউরেশীয় সবগুলোর টেকটোনিক প্লেটের সীমানার উপর রীতিমত বসে রয়েছে গোটা দেশটি।
মূলত এখানকার যেকোনো এক জোড়া প্লেটের ভূমিকম্পগুলো খুব হালকাভাবে অনুভূত হয়। কিন্তু এই মৃদু কম্পন থেকে ধীরে ধীরে যেকোনো একটি প্লেট বেঁকে যেতে শুরু করে। এভাবে যখন অনেকগুলো জোড়া সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন প্রতি প্লেটের বেঁকে যাওয়া বিধ্বংসী রূপ নেয়।
১৯৯০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে রেকর্ডকৃত ভূমিকম্পের সংখ্যা ১০৮টি। ২০১৭-এর ইরান-ইরাক ভূমিকম্পটি ছিল ৭.৩ মাত্রার, যা ৬৩০ জন মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়েছিল। ২০০৩-এর ৬.৬ মাত্রার ব্যাম ভূমিকম্প প্রাণহানি ঘটিয়েছিল ৩৪,০০০ মানুষের।
চীন
চীনের কিছু অংশ পড়েছে ইউরেশীয়, প্রশান্ত মহাসাগরীয় এবং ভারত মহাসাগরের প্লেটগুলোর মিলিত স্থানে। আর কিছু অংশ পড়েছে ইউরেশীয়, ফিলিপাইন এবং ভারতীয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে। উপরন্তু, চীনের অনেক পার্বত্য অঞ্চল রয়েছে যেখানে হরহামেশাই ভূমিধ্বসসহ অন্যান্য ভূতাত্ত্বিক ঝামেলা দেখা যায়। এই সবকিছু সামগ্রিকভাবে চীনের ভৌগলিক অবস্থানকে প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ করে তুলেছে।
১৯৯০ থেকে ২০২২ সাল নাগাদ দেশটি মোট ১৮২টি ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়েছে। ২০০৮-এর সিচুয়ান ভূমিকম্পটি রিক্টার স্কেলে ৭.৯ মাত্রা পর্যন্ত উঠেছিল। প্রলয়ঙ্করী এই দুর্যোগ কেঁড়ে নিয়েছিল ৮৭,৫৮৭ জন মানুষের প্রাণ। ২০১০-এর ৬.৯ মাত্রার ইউশু ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল ২,৬৯৮ জন মানুষ।
ফিলিপাইন
জাপানের পরেই প্যাসিফিক রিং অফ ফায়ারের সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশটি হচ্ছে ফিলিপাইন। এখানকার ইউরেশীয়, ফিলিপাইন সাগর এবং ইন্দো-অস্ট্রেলীয় প্লেটের মিলনস্থলটি ফিলিপাইন মোবাইল বেল্ট বা তাইওয়ান-লুজন-মিন্ডোরো মোবাইল বেল্ট নামে পরিচিত। পুরো ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জকে ঘিরে থাক এই টেকটোনিক অঞ্চলটি দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত হয়েছে মোলুকা সাগর এবং পূর্ব ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত।
বিগত তিন দশকে ফিলিপাইন ৫২টি ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়েছে। ২০২২-এর লুজন ভূমিকম্পটি ছিল ৭ মাত্রার। এতে ১.৮৮ বিলিয়ন ফিলিপাইন পেসো (৩৬২ কোটি বাংলাদেশি টাকারও বেশি) [১ ফিলিপাইন পেসো = ১.৯৩ বাংলাদেশি টাকা] মূল্যের সম্পদ বিনষ্ট হয়েছিল।
২০১৩ সালে একটি ভূমিকম্প হয়েছিলো বোহোল, সেবু এবং সিকুইজোর সেন্ট্রাল ভিসায়াস প্রদেশে। ৭.২ মাত্রার এই ভূমিকম্পের কারণে ২২২ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল।
ইন্দোনেশিয়া
ফিলিপাইনের মতো ইন্দোনেশিয়াও রিং অফ ফায়ারের মধ্যে অবস্থিত। ভারতীয়-অস্ট্রেলীয়, ইউরেশীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয়; এই তিনটি প্রধান টেকটোনিক প্লেটের সীমানার মধ্যে দেশটির অবস্থান। ফল্ট লাইনের পাশাপাশি ঘন ঘন আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাত এখানকার ভূমিকম্পের প্রধান কারণ।
গত তিন দশকজুড়ে ১৬১টি রেকর্ড সংখ্যক ভূমিকম্প দেখেছে দেশটি। ২০১৮-এর ৭.৪ মাত্রার ভূমিকম্প এক ভয়াবহ সুনামির সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। এখানে ৪,৩৪০ জন লোক মারা যায় এবং পুরো পালু শহরের অর্ধেক জনসংখ্যা বাস্তুচ্যুত হয়ে যায়। ২০০৪-এর ভারত মহাসাগরীয় ভূমিকম্প এবং সুনামিতে মারা গিয়েছিল ২,২৭,৮৯৮ জন মানুষ। ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৯.১ থেকে ৯.৩।
ইতালি
রুক্ষ পর্বতশ্রেণী, নিষ্ক্রিয় আগ্নেয়গিরি এবং উপকূলীয় সমভূমিতে পূর্ণ ইতালির নিচে রয়েছে একাধিক ফল্ট লাইন। সেগুলো হলো- ইউরেশীয়, এজিয়ান সাগর, অ্যাড্রিয়াটিক, আফ্রিকান এবং আনাতোলিয়ান প্লেট। অ্যাপেনাইন পর্বতমালার ফল্টগুলো সমগ্র ইতালিকে ঘিরে রেখেছে।
এছাড়া সিসিলি এবং ক্যালাব্রিয়া কাছাকাছি জায়গায় আফ্রিকান প্লেট ইউরেশীয় প্লেটের নীচের দিক ঘেঁষে চলে গেছে। এই ঝুঁকিপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থান ইউরোপীয় দেশটিকে ভূমিকম্পসহ নানা বিধ্বংসী দুর্যোগের দিকে ঠেলে দেয়।
ইতালিতে আঘাত হানা সবচেয়ে বিধ্বংসী ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯০৮ সালের মেসিনা ভূমিকম্প। ৭.১ মাত্রার এই ভূমিকম্পে দুই লাখের কাছাকাছি মানুষ মারা গিয়েছিল। ১৯৮০ সালের ইরপিনিয়া ভূমিকম্পটি ছিল ৬.৯ মাত্রার, যেখানে ৪,৯০০ জন মানুষ মারা গিয়েছিল।
পাকিস্তান
পাকিস্তান ভূতাত্ত্বিকভাবে ইউরেশীয় এবং ভারতীয় উভয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। বেলুচিস্তান, খায়বার পাখতুনখোয়া এবং গিলগিট-বালতিস্তান প্রদেশগুলো পারসীয়(ইরানী) মালভূমিতে ইউরেশীয় প্লেটের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। সিন্ধু, পাঞ্জাব এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর প্রদেশগুলোর অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় প্লেটের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে।
মূলত ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং আরবীয়- এই তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সন্ধিস্থলে থাকার কারণেই দেশটিতে শক্তিশালী ভূকম্পন দেখা যায়। বিশেষ করে ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেটগুলো শামান ফল্ট বরাবর একে অপরের উপর দিয়ে ঘেষে যাওয়ার সময় ধ্বংসাত্মক কম্পন সৃষ্টি করে।
২০০৫-এ আজাদ কাশ্মীর ও বালাকোট ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, যেখানে ৮৭,৩৫১ জন লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। ২০১৩ আওয়ারানের বেলুচিস্তানে হয়েছিল ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্প, যা ৮২৫ জন মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
পেরু
নাজকা এবং দক্ষিণ আমেরিকান প্লেট; এই দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ হয় পেরুর উপকূল বরাবর। এসময় সমুদ্রের নাজকা প্লেট দক্ষিণ আমেরিকান প্লেটের নীচে নেমে আসে। সংঘর্ষের এই জায়গাটি পেরু-চিলি সাবডাকশন জোন নামে পরিচিত।
দক্ষিণ আমেরিকান প্লেট প্রতি বছর ৭৭ মিলিমিটার করে নাজকা প্লেটের উপর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এই টেকটোনিক কার্যকলাপ বহু বছরের, আর সে কথাই প্রতিনিয়ত জানান দিচ্ছে ইনকা সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ।
২০০৭ সালে ৮ মাত্রার পেরু ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল ৫৯৫ জন মানুষ। ২০০১ সালে দক্ষিণ পেরুর ভূমিকম্পটি ছিল ৮.৪ মাত্রার, যেখানে প্রাণহানি হয় ১৪৫ জন লোকের।
ভারত
ভারত এবং ইউরেশীয় প্লেটের সীমানা বরাবর অবস্থিত এই দক্ষিণ এশীয় দেশটি। ভারত প্লেট প্রতি বছর আনুমানিক ৪ সেন্টিমিটার করে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়। এ সময় এর সংঘর্ষ ঘটে ইউরেশীয় প্লেটের দক্ষিণ প্রান্তের সঙ্গে। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম প্লেট সংঘর্ষ অঞ্চলের মধ্যে একটি।
সমগ্র ভারতের প্রায় ৫৮% স্থলভাগ ভূমিকম্পপ্রবণ। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে কাশ্মীর, পশ্চিম ও মধ্য হিমালয়, উত্তর ও মধ্য বিহার, উত্তর-পূর্ব ভারতীয় অঞ্চল, কচ্ছের রণ এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ।
গত তিন দশকের মধ্যে ভারতে ৫৭টি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। তন্মধ্যে ২০০১-এর গুজরাট ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৭ এবং এতে মৃতের সংখ্যা ছিলো ২০,০৮৫ জন। ২০১১ সালে ৬.৯ মাত্রার সিকিম ভূমিকম্পে ন্যূনতম ১১১ জন লোক মারা গিয়েছিল।
পরিশিষ্ট
পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি ভূমিকম্পপ্রবণ দেশের ধ্বংসলীলা প্রতিবেশি এলাকাগুলোতেও প্রসারিত হতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার আশপাশ থেকে দ্রুত সরে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তবে প্রতিরোধ হিসেবে জাপানের ভূ-কম্পন সহনীয় স্থাপনা ব্যবস্থাকে অনুসরণ করা যেতে পারে। বাকি দেশগুলো এখনও ভূমিকম্প পরবর্তী ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। বিশেষত চীন ও ভারতের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলো বেশি পরিমাণে ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়। তাই বিগত ভূমিকম্পের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর শিগগিরই নিজেদের প্রস্তুত করা জরুরি।
সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন