বিশ মিনিটের গালমন্দ কিবা ভালবাসা

বিশ মিনিটের গালমন্দ কিবা ভালবাসা

  • য. সামনূন

তানবীর উদ্দীন মানজুর, আমার চাচা, যিনি তাঁর নামের মতোই ওপরকে আলোকিত করতেন হাসি-আনন্দে, আবার শব্দমূল ধারণ করে নিজেও থাকতেন আলোকিত, সদাপ্রফুল্ল। একই সাথে মহামহিমের প্রতি আকুল হৃদয়ে সমর্পিত।

আমার বড় হয়ে উঠার আগেই তিনি প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছিলেন আমেরিকায়। ফলে ছোটবেলায় আর তাঁকে কাছে পাইনি। তবে যেসব গল্প শুনে বড় হয়েছিলাম, সেসব গল্পের চেয়ে এ তথ্যই বেশি মুগ্ধকর ছিল যে, আমার সাধারণ শিক্ষিত ৯ চাচার মাঝে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে খোদাভীরু, সবচেয়ে বেশি আমলপ্রিয় মানুষ।

আমার বুঝ হওয়ার পর প্রথম যেবার দেশে আসলেন, মেজ ভাইয়ার সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না ভাতিজা তাঁর এত বড় হয়ে গেছে! দেশে আসলেন, বিয়ে করলেন, এবং আমাদের বৃহৎ পরিবারে এমন একজন সদস্যকে নিয়ে আসলেন, যিনি আমার জীবন-শিক্ষায় গভীর প্রভাব রেখেছেন।

আমার চাচী, যিনি আপাদমস্তক মাতৃত্বের শোভায় মণ্ডিত, তাঁর মাতৃসুলভ তদারকিতে জীবনের প্রায় একটি মাস আমি কাটিয়েছি। চাচা বিয়ে করে ফিরে গেলেন আমেরিকায়, এদিকে কিছুকাল বাদে আমার মা-বাবা আর বড় দুইভাই গেলেন রমজানে উমরার সফরে। বাসায় কেবল আমি ও আমার একমাত্র বোন, সাথে বেড়াতে আসা ভগ্নীপতি। ফলে আমাদের মায়ের ভূমিকায় হাজির হলেন আমার এই চাচী।

দুনিয়ার বুকে খুব কম পরিবারই আছে, যেখানে ভাইবোনের সম্পর্ক অম্লমধুর না হয়ে কেবল অম্লধর্মী কিংবা মধুর হয়। আমার আর আমার বোনের মধ্যকার সম্পর্কও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু বাজে ব্যাপারটি ছিল, শৈশব থেকেই আমি বদমেজাজের এক ভয়াবহ অভিশাপ বয়ে চলছি। ফলে আমার কিশোরবেলার দৈনন্দিনের ঝগড়াঝাঁটি প্রায়শ শেষ হতো অশ্রুবর্ষণে। আম্মা যদি থাকতেন, তবে দোষ যেপক্ষেরই থাকুক, একক দায় আমার উপর পড়তো এক অমোঘ নিয়তির মতো এবং সাধারণত উত্তম থেকে মধ্যম পর্যায়ের উত্তমমধ্যমের মাধ্যমে এর বিচারকার্য সমাধা হতো।

পরিবার-বিরহের শোকে হোক আর রমজানের গাম্ভীর্যে, কিছুদিন আমাদের নিরুত্তাপ কাটলো। তারপরেই আমরা পুরাতন রুটিনে ফেরৎ গেলাম। এর মাঝে একদিন আমার বাড়াবাড়িতে ‘বিচারক’ পর্যায়ে ঘটনাপ্রবাহ পৌঁছালো। কিন্তু চাচীর তো আর আম্মার সেই মুখস্ত রায়ে ধরাবাঁধা বিচার পদ্ধতি সম্পর্কে জানা ছিল না।

আমার নিঃসন্তান চাচী এমনভাবে ব্যাপারটা সামলেছিলেন যে, একমাত্র বোনকে বন্ধু বলেই পেয়েছি জীবনভর

তিনি আমাকে ডাকলেন, কোমল ভাষায় বুঝালেন। আমার চিন্তার জগতে একটা লাইন টেনে দিলেন, শিখলাম, ভাবাবেগের বহিঃপ্রকাশে কতটুকু পর্যন্ত যাওয়া যায়। শেষে বললেন, তুমি ওকে সরি বলো, ওর কাছে ক্ষমা চাও।

চাচীর এই কথা আমার তথাকথিত মেল ইগোতে শক্ত আঘাত হানলো। জিদ বজায় রেখে মার খেয়ে নাকের পানি চোখের পানি একাকার করে ফেলা যায়, কিন্তু ওপর পক্ষের কাছে নিচু হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ক্ষমাপ্রার্থনা করা কৈশোরের সেই উদগ্র বিকালে আমার কাছে পর্বতপ্রমাণ এক কঠোর শাস্তি বলে মনে হয়েছিল।

আজকাল প্রায়ই আমার সমবয়সী বাংলাদেশি ছেলেমেয়েদের বলতে দেখি, ছোটবেলার ‘সিবলিংস রাইভালরি’ ও এর সাথে পরিবারের সম্পৃক্ততা তাদের মনোজগতে এমন গভীর ছাপ রেখে গেছে যে, পরিণত বয়সে এসেও এর পরিণাম থেকে তারা মুক্ত হতে পারছেন না। কিন্তু আমার নিঃসন্তান চাচী এত চমৎকারভাবেই ব্যাপারটা সামলেছিলেন যে, বিরূপ মনোভাবের না হয়ে বরং একমাত্র বোনকে বন্ধু বলেই আমার মনে হয়েছে জীবনভর।

এই ধাক্কা আমাকে এতটাই শুধরে দিল যে, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য বদমেজাজের অধিকারী আমার মতো লোকদের; বিবেক-বুদ্ধির সাথে সুস্থ মস্তিষ্কে, প্রাপ্ত-বয়সকাল থেকে নিয়ে বার্ধক্য পর্যন্ত জিনিসপত্র ভাঙচুর করা বা ছুড়ে ফেলার অভ্যাস থাকলেও, আজ পর্যন্ত আমার এমন কোনো কর্মের খতিয়ান নেই। কোনোদিন তাঁকে বলা হয়নি, এর কৃতিত্ব শতভাগ আমার লীনা চাচীর। আল্লাহ তাআলা চাচীকে কবুল করে নিন। আমীন।

চাচার ডাক নাম ছিল ‘আবুন।’ কীভাবে এই নামটি এল, তা আর জানা হয়নি। দেখা-সাক্ষাতই তো হয়েছে জীবনে ক’দিন হাতে গুণে। কিন্তু রক্তের টান যে অদেখা সম্পর্ককে ছাড়িয়ে যায় বহুদূর, তা টের পেয়েছিলাম চাচার দেশে গিয়ে। ২০১৮ সালে বড় ভাইয়ার সাথে আমেরিকায় গিয়েছিলাম অল্প কয়েকদিনের জন্য। ফেরার তাড়া জানা থাকায় সেখানে থাকা দুই চাচার কেউ-ই জোর দেননি শত মাইল পেরিয়ে তাদের বাসায় বেড়াতে যেতে। কিন্তু ‘আবুন চাচ্চু’ যখন শুনলেন আমরা নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে বাফেলো শহরে গিয়েছি, তখন আর ব্যাপারটা এমন রইলো না।

সেদিন এক বাসায় রাতে দাওয়াত ছিল। এশার নামাযের প্রস্তুতি সারতে আমি গিয়েছিলাম টয়লেটে। বের হলে ভাইয়া আমাকে মোবাইলটা হাতে দিয়ে বললেন, ‘আবুন চাচ্চু কথা বলতে চেয়েছে।’ কল করলাম, তিনি রিসিভ করলেন এবং বকাঝকা শুরু করলেন, কেন আমি আসবো না তাঁর বাসায়?

শেষমেশ যখন বললেন, এখনই নিউইয়র্ক টু ডালাস বিমানের রিটার্ন টিকেট কাটতে, তিনি মূল্য পরিশোধ করে দিচ্ছেন; তখন কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখি ১৯ মিনিট ৪০ সেকেণ্ডের মতো হয়েছে। পরিবারের ছোট হওয়ায় জীবনেও মামা-চাচার বকাবাদ্য শুনতে হয়নি। এই প্রথম তাদের কারো কাছে বকা খেলাম তাও সেটা ঝাড়া বিশ মিনিট! ভাইয়া নিশ্চয় ইতোমধ্যেই এই পথ পার হয়ে এসেছিলেন, ফলে ফোন রেখে দেখি ভাইয়া আরেকজনের মোবাইলে ইতোমধ্যেই টিকেটের দরদাম দেখছেন।

দেখা গেল, পরবর্তী দুয়েকদিনের ভেতর নিউইয়র্ক—ডালাস আকাশপথে টিকেটের মূল্য আমাদের ঢাকা–নিউয়র্ক টিকেটমূল্যের সমান হয়ে যাচ্ছে প্রায়। এদিকে আমাদের হাতে সময়ও নেই একেবারেই। অতঃপর চাচাকে নানাভাবে বুঝিয়ে-শুনিয়ে, আরেকবার আমেরিকা আসলে ঢাকা থেকে সোজা টেক্সাস যাবো এই পাক্কা প্রতিশ্রুতি দিয়ে রক্ষা পেলাম।

আমার চাচা যে তখন খুব বিত্তশালী ছিলেন তা নয়, উল্টোটাই বরং সত্য বলা চলে। কিন্তু কেবল ভাতিজাকে এক নজর দেখার জন্য তিনি হাজার ডলার খরচ করতে যেতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি।

আমার এই চাচা, জনাব তানবীর উদ্দীন মানজুর (রহ.), গতকাল আমেরিকায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।

আমার বড় ফুফুও আমাদের ছেড়ে গেছেন দশদিন আগে। প্রায় দুই দশক পূর্বে আমার এই বড় ফুফা ইন্তেকাল করেছিলেন। তাঁদের পুত্র, আমার শ্রদ্ধেয় উস্তায ও ফুফাত ভাই মাওলানা হুসাইনুল বান্না সাহেব আমার ছাত্রজীবনে, বহুকাল আগে একদিন আমাদেরকে ‘আলেম’ হতে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, ‘এমন কোনো ওয়াক্ত নামায যায়নি; যে নামাযের পর তিনি তাঁর মরহুম পিতার জন্য ইছালে সওয়াব আর দুআ করেননি।’ এর আগে আমার নিঃসন্তান ছোট ফুফু ইন্তেকাল করেছিলেন, আমার এই চাচাও নিঃসন্তান ছিলেন, তাঁদের জন্য কে থাকবে আজ এজগতে প্রাত্যহিক এই মহাপুরস্কার নিয়ে?

পাঠক, আমার এই চাচা ও ফুফুদের জন্য আল্লাহর দরবারে খানিক দুআ করুন। আপনার প্রতিদান তো আল্লাহর কাছে

পাঠক, আপনার কাছে করজোড়ে নিবেদন, দুই মিনিট সময় ব্যয় করে, দুরূদ শরীফ, সূরা ফাতেহা আর তিনবার সূরা ইখলাস পাঠ করে, আমার এই চাচা ও ফুফুদের জন্য আল্লাহর দরবারে খানিক দুআ করুন। আপনার প্রতিদান আল্লাহর কাছে। আল্লাহ তাঁদের সবাইকে ক্ষমা করুন, জান্নাতে আ‘লা ইল্লিয়্যীনে স্থান দিন। আমীন।

চাচার সাথে আমার শেষ যেদিন সাক্ষাৎ হয়, সেদিন বলেছিলেন ২০২৫ সালে চাচীকে নিয়ে হজ্জ আদায় করবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সম্ভবত রেজিস্ট্রেশনও করেছিলেন। এর আগে উমরাও আদায় করেছেন। আমি আমার হজ্জের অভিজ্ঞতা তাঁকে জানাচ্ছিলাম। কথাপ্রসঙ্গে মসজিদুল হারামের এক ইমাম সাহেবের একটা দুআর ভিডিও আমাকে শুনালেন, নিজেও শুনলেন। বললেন, প্রায় প্রতিদিনই তিনি এই দুআ শোনেন। অর্থ তো বুঝেন না, কিন্তু আল্লাহর প্রতি যে সমর্পণ তা উপলব্ধি করতে পারেন। যতবার শোনেন, নিজের অজান্তে চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

আজ দুনিয়ার সবকিছু ছাপিয়ে এই দৃশ্যটাই আমার চোখে ভাসছে— শীতের এক নিরব সন্ধ্যা, বৈদ্যুতিক পাখার কোনো আওয়াজ নেই, পাশের সোফায় বড় চাচা সারাদিনের ক্লান্তিতে গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন, সবকিছু কেমন যেন থেমে আছে কোনো এক ঘোরলাগা আবহে। ‘আবুন চাচ্চু’র মোবাইলে তখন মোহময় কণ্ঠে কা‘বার ইমাম সাহেব একনাগাড়ে কেঁদে কেঁদে দুআ করে যাচ্ছেন, আর চাচ্চুর চোখ থেকেও ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম, তাঁর সৃষ্টিকর্তা, যাঁর কাছে তাঁকে একদিন ফিরতে হবে, সেই খোদা তাআলার ভয়ে, ক্ষমার আশায় আর ঈমানের দৃপ্ততায়।

 

লেখক : সহকারী সম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *