এই সময়। আবু বকর জাবের
বিষণ্ণতা ভর করে থাকে সারাদিন
সকালবেলা দরজা খুলতেই বেশ কিছু খালাম্মা ও নানী বয়সের নারীর সাথে দেখা। দরজার ঠিক পাশে আর সিঁড়িতে বসা। সাধারণত এমতাবস্থায় আম্মুকে ডেকে দেই আমি। কিছু বুঝে উঠার আগেই আম্মুকে কেউ খালা আর কেউ আপা বলে জানালো তারা বেশ সুযোগ বুঝেই বাসায় ঢুকেছে। লকডাউনের শুরুর দিকে যদিও বাড়ির কাজ চলমান ছিল কিন্তু রমজানের ঠিক আগে আগে বাড়ি লকডাউন থাকায় লিফট একান্ত প্রয়োজন ছাড়া খোলা হয় না। তাই সকাল বেলা খুব গোপনেই এই মানুষজন সিঁড়ি বেয়ে আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে এসেছে। তাদের দাবী হলো তারা জেনেছে যে, আমরা ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছি। যাইহোক, আম্মু তাদেরকে একটু বলে কয়ে বিদায় করলেন। তারপর আমাকে বললেন এই কাহিনী।
আসলে দীর্ঘদিন সমাজকর্মের সাথে একটু আধটু সম্পর্কের সুবাদে আর ইতিবাচকভাবে মানবিক চিন্তা ও কাজকে প্রমোট করার একটা অভ্যাসের কারণে আল্লাহর রহমতে নানান সময় নানান উদ্যোগে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। এই করোনাকালে পূর্বের তুলনায় একটিভ থাকার সেই সুযোগটা হয়নি কেননা বছর খানেক ধরে একটু বেকায়দা লাইফ যাপন করতে হচ্ছে। তারপরেও আমার এই প্রতিবেশীদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা শুরু থেকেই ছিল।
কম করে হলেও প্রায় ২০-২৫ টি সংগঠন, ব্যক্তি এবং উদ্যোক্তাদের সাথে যোগাযোগ করেও তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি কিন্তু দু একজন ব্যক্তির সাথে আলাপ করে নিজে গিয়ে রিলিফ জোগাড় করে এনে একান্তভাবে বিপাকে পড়া মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারকে দেওয়ার কোশেশ হয়েছে। যাদের সংখ্যা হাতেগোনা। কমিশনার সাহেবকেও ইত্তেলা দিয়েছি। তিনিও সক্রিয় হয়েছেন সামর্থ্য অনুযায়ী।
আমার এলাকা বসিলা রোডে এখনও এই এলাকায় ডেভেলপমেন্ট চলমান তাই সকাল বেলা মুরগির আওয়াজ দিয়ে ঘুম ভাঙ্গে আর সন্ধ্যা হয় নানাবিধ ঝগড়া-ঝাটির শব্দে। আইসক্রিম বিক্রেতা, হরেকমালের হকার, রিকশাচালক এবং দিনমজুরদের বিশাল আবাস টিনশেডে। পুরো রোডের একটা লাইনে আমাদের বাড়িটাই একমাত্র। যার কারণে গরম অসহ্য হয়। আমদের বাসাটা আবার পশ্চিম দিকটায়। বাড়িওয়ালা সম্প্রতি পূর্বদিকের ফ্ল্যাটে হাত দিয়েছেন যদিও।
সুতরাং এমন একটা অভাবী মানুষের আধিক্যের এলাকায় বাজার সদাই করলেও বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হয়। সবাই তাকিয়ে থাকে। আর বরাবরের মতো আমার আম্মুর সাথে এদের একটা সম্পর্ক আছে। কথা প্রসঙ্গে আম্মু জানালেন- ইতোমধ্যে প্রায় ঘরে রক্ষিত চালের অর্ধেকের বেশী তাদেরকে দেয়া শেষ। আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। হাসলাম।
একদিকে আমি এদিক সেদিক থেকে ধার দেনা করে বেঁচে থাকার অবলম্বন জোগাড়ে দিনরাত এক করি আর ওদিকে আম্মু তার দয়ার হাত প্রসারিত করে চলছেন। আমার মাকে আমি বেশ কয়েক বছর আগেই ইলেকশন করার আইডিয়া দিয়েছিলাম। অন্তত মহিলা কমিশনার। কোন এলাকায় আমরা গেলে সে এলাকার মোটামুটি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষদের সাথে তার একটা সখ্যতা গড়ে উঠে। আল্লাহর রহমতে আপাদমস্তক বোরকাবৃত থাকার পরেও মানুষজন চেনে আর কেউ হয়তো না চিনেও অনেক সময় কেনাকাটায় বাকি ইত্যাদি দিয়ে দেয়।
এদিকে করোনাকালে কমিশনার সাহেবও আমাকে চিনে রেখেছেন। দ্বিতীয়বার আর যাইনাই কেন যেন মনে হলো এই রিলিফ প্যাকেজের হকদার আরো অন্য মানুষ আছে। চড়ুই পাখির মতো আমাদের আবাস। লক ডাউন থেকে বাসায় বন্দী। পারিবারিক ব্যবসার ধরন হলো- খেয়ে পড়ে থাকলে পরে হস্তশিল্পের নান্দনিকতা নিয়ে আলাপ। মধ্যবিত্ত শহুরে প্রবাসীদের জীবনে অসুস্থ্যতা একটা অভিশাপ। সঞ্চয় এবং সম্বল সবটাই চলে যায়। বাড়িওয়ালা চিরকুট দেন আর ডেকে ডেকে ভাড়া চান। অংকটা একেবারেই কম না। এমতাবস্থায় আল্লাহ যে সম্মান দিয়ে যাচ্ছেন তাই আলহামদুলিল্লাহ বলতেই হবে। মাথার উপরে থাকার একটা ছাদ তো আছে আর সুস্থভাবে নিরাপদে আছি। কষ্ট করে হলেও শহুরে প্রবাস জীবন চলছে। বাবা কষ্ট করে জমিদার। অবস্থা বেগতিক হলে সে সম্পদ বেচাকেনার ইচ্ছা রাখি তবুও একটা সম্মানজনক জীবনের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেই হয়।
বিষণ্ণতা ভর করে থাকে সারাদিন। তারাবি পড়াই এই মাথা নিয়েই। দোয়া করি যদি আল্লাহ নিতে চান ডেকে তবে ঋণ মুক্ত করে নেন যেন আর বাকি ভালো মন্দ কাজের ব্যাপারে তার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। আর যদি এই করোনাকাল গেলেও খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেন তবে যেন অমুখাপেক্ষিতার সাথে ঋণমুক্ত করে এবং পিছুটান ব্যাতিরেকে কিছু কাজ নিয়ে নেন তার এই গোলাম থেকে।
খুবই ছোট একটা জীবন পার করেছি। এতো বৈচিত্র্য এই জীবনে একা একা ভাবি। বিস্মিত হই। আর বর্তমান আবাসস্থলে আশার পর শুকরিয়ার হার একটু বেড়েই গেছে। আল্লাহ অনেক ভালো রেখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ!
লেখক : সমাজকর্মী