বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই
মহিউদ্দীন খান তানজীম ❑ একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। আমি তখন ‘নাহবেমীর’ (সপ্তম শ্রেণী) জামাতে পড়ি। পত্র-পত্রিকা পড়ার নেশা ছিল খুব।তাই যখন ছুটিতে বাসায় আসতাম, বাসার পাশে রাস্তার ওপারে মুদির দোকানটাতে যেতাম পত্রিকা পড়তে। দোকানদার ভাই একাউন্টিং এ মাস্টার্স করেছেন। ওনি রুশো, দস্তয়ভস্কি, তলস্তয়, ভলতেয়ারের বেশ ভক্ত। এঁদের সাহিত্যের মুগ্ধ পাঠক। নিয়মিত প্রাচ্যবিদদের বই-টই দেদারসে মুতালা করেন। ফলে ওনি কিছুটা সংশয়বাদী হয়ে পড়েন ইসলামের উপর। যা একদমই আমার জানা ছিল না।একদিন কথাচ্ছলে আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা বলো তো, আয়েশাকে মুহাম্মদ এত অল্প বয়সে বিয়ে করলেন কেন?’
আমি জীবনের প্রথম এমন প্রশ্ন শুনে একদম ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাই। তাও আবার প্রতি শুক্রবারে একই কাতারে আমার সাথে জুমার নামাজ আদায় করেন যিনি, এমন একজন মুসলিমের মুখে! কোনো উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। আমি তখনো বুঝতে পারিনি, এগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের হাতিয়ার। সশস্ত্র ক্রুসেড পরবর্তী সময়ে ইহুদী-খ্রিষ্ট অক্ষশক্তি বিশ্বব্যাপী চলমান মুসলিম জাগরণকে স্তব্দ করার মানসে বহুমাত্রিক গৃহীত পদক্ষেপের অন্যতম এটি।এরা মুসলিমদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে কখনোই জয়ী হতে পারেনি। ৪৮৯-৬৯০ হিজরী (১০৯৫-১২৯১ ইং)পর্যন্ত পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে শুধু পশ্চাদ্ধাবিতই হয়েছে।
ইহুদীগোষ্ঠী ও খ্রিস্টজগত মুসলমানদের শক্তির উৎস অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়। গোটা দুনিয়ায় ৩শ’য়ের অধিক গবেষনা ইন্সটিটিউট ও বুদ্ধিবৃত্তিক ফোরাম (Think Tank)গঠিত হয়। তাদের বোধগম্য হলো, মুসলিমজাতিকে ততদিন পর্যন্ত পরাজিত করা সম্ভব না, যতদিন না আমরা তাদের ঐক্য, ঈমানি চেতনাবোধ ও জিহাদ স্পৃহাকে নস্যাৎ করবো। শুরু হলো Ideological crusade (আল গাযভুল ফিকরি) বা বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই। বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই হচ্ছে, ‘কাফের সম্প্রদায় বেসামরিক অস্ত্রের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে তাদের অনুগত করতে এবং তাদের আকিদা-বিশ্বাস, চিন্তা-ভাবনা, সভ্যতা-সংস্কৃতি পরিবর্তনের জন্য যে যুদ্ধ করে।’ (ফিকরী ওয়া নযরিয়াতি জং) ইউরোপে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রুসেডের প্রতিষ্ঠাতা সেন্ট লুইস মুসলিমদের বিরুদ্ধে সফলতার জন্য তার অন্তিমমুহুর্তে চারটি সুপারিশ পেশ করেন।
১। মুসলিম শাসকদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করা।
২। মজবুত ঈমানওয়ালা গোষ্ঠীকে দূর্বল রাখা।
৩। মুসলিম সমাজে অশ্লীলতা,অর্থনৈতিক অপচয়ের বিস্তার ও চারিত্রিক পতন ঘটানো।
৪। Gaza থেকে Antakya পর্যন্ত ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।(বর্তমান ফিলিস্তিন, ইসরাইল, শাম এর অন্তর্ভূক্ত।)
বুদ্ধিবৃত্তিক এ লড়াইয়ে মুসলমানরা পরাজিত হয়ে গেলো । তারা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে মুমিন মুমিনের ভাই চেতনাবোধকে হারিয়ে ফেলল। ফলস্বরূপ যখন আফগানে, ইরানে, মানুষ মরে তখন আমরা বলি, ‘আরে, আমাদের কেউ তো আর মারা যাচ্ছেনা।’
যখন মানবতার মুক্তির গ্যারান্টি ইসলামপ্রতিষ্ঠার কথা উঠে, তখন মসজিদে আমার পাশেই যে ভাই সিজদা দিয়ে ‘সুবহা’না রাব্বি আল-আ’লা’ তাসবীহ জপে, সে রাষ্ট্র থেকে ইসলামকে আলাদা করার স্লোগান তুলে। যখন আমাদের মা-বোনেরা ইসলামী অনুশাসন মেনে পরকাল অর্জনের চেষ্টায় মত্ত থাকার কথা,ঠিক তখনই তারা দেহ প্রদর্শনের স্বাধীনতা নিতে রাস্তায় মিছিল করছে। এগুলো দেখে ইসলামবিদ্ধেষীরা নিশ্চই বিজয়ের হাসি হেসেছে বেশ কয়েকবার।
এখনই আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। মাজলুমের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আছে। সে বাতাসকে আর ভারী করতে দেওয়া যায়না। তবে আজকে যারা মুসলমানদের পরাজয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে,তাদেরও জেনে রাখা উচিত; তাদের এই হাসির রেখা অচিরেই মিলিয়ে যাবে। পুরো পৃথিবীজুড়ে মানুষ পাশ্চাত্যের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আবারো ইসলামমুখী হতে শুরু করেছে। ইউরোপ -আমেরিকায় দিন দিন মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পিউ রিসার্চের জরিপ বলছে, ২০৭০ সাল এর মধ্যে ইসলাম হবে পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্ম। হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খৃষ্টান, ধর্ম যেখানে কালের বিবর্তনে পিছলে পড়েছে, ইসলাম সেখানে স্বগৌরবে যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে।
হ্যা, আমাদের কমতি অনেক।অস্বীকারের জো নেই। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর সাথে সম্পর্ক গড়ার পাশাপাশি আমাদের চৈন্তিক জড়তাও কাটিয়ে উঠা প্রয়োজন। বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি, মিডিয়া, রাজনীতিকে হেলা করার পরিবর্তে আমাদের লুপে নেওয়া উচিত। বিগত দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে ১২৫০ বছর পর্যন্ত যে মুসলিম জাতির হাতে সুরক্ষিত ছিল বাইতুল মুকাদ্দাস, সেটি আবারো মুসলমানদের করতলগত হবে সে দিন হয়তো খুব বেশী দূরে নয়। ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে পূর্বেল্লিখিত ঘটনা দিয়েই ইতি টানতে চাই। পরবর্তীতে একবার ছুটিতে যখন বাড়ীতে এসে পত্রিকা পড়ার জন্য দোকানে গেলাম, তখন দোকানদার ভাইকে বললাম, ‘আচ্ছা ভাই, আয়েশা রাযি.-কে এত অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার কারণে ওনি শারীরিক বা মানুষিকভাবে কষ্ট পেয়েছিলেন, ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত এমন কোন কথা কি আপনার জানা আছে?’
ওনি বললেন, ‘না।’
বললাম, ‘তাহলে এর বিপরীত তথা ওনাদের সংসার ছিল সুখী, সম্পর্ক ছিল মধুর-এমন কিছু কি জানা আছে?’
ওনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’
আমি বললাম, ‘তো যিনি স্বয়ং স্ত্রী, অভিমান,হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখে যিনি সর্বদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গী ছিলেন,তার যখন মৃত্যু অবধি কোন আপত্তির কথা জানা যায়না, সেখানে আপনি-আমি প্রশ্ন উত্তাপন করার কী অধিকার রাখি? আর ব্যক্তি-স্বাধীনতায় অমন হস্তক্ষেপ কতটুকু বিবেকসিদ্ধ?’
সেদিন থেকে আজ অবধি ওনার মুখে কোন জবাব আমি পাইনি। আর মহাপ্রলয় পর্যন্ত কোন সদুত্তর পাবো না যে এটাও নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায় ।
লেখক: শিক্ষানবিশ, দাওরায়ে হাদীস,ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা। ফাজিল, শায়েস্তাগঞ্জ মডেল কামিল এম এ মাদ্রাসা, হবিগঞ্জ।