মো. আব্দুল লতিফ বকসী : দেশের উন্নয়নের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিনিয়োগ। অর্থনীতির গতি সঞ্চালনের জন্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ বেশ কিছুদিন ধরেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কাজ করে যাচ্ছে। বিনিয়োগবান্ধব নীতি, বিনিয়োগের স্থান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, দক্ষ ও সুলভ কর্মীবাহিনী এবং সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট(এফডিআই) আকৃষ্ট করতে প্রয়োজন বিশেষ উদ্যোগ। সরকারের আন্তরিক সহযোগিতার মনোভাব থাকলেও অন্যান্য বিষয়গুলো বাংলাদেশে সহজ ছিল না। বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ এবং সময়োপযোগি সিদ্ধান্তের কারণে দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। দেশের সিংহভাগ মানুষ এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। জনসংখ্যা, কলকারখানা বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে চাহিদা। তারপরও ২০১৮ সালের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় চলে আসবে। নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার এবং এলএনজি আমদানির ফলে দেশে গ্যাস সংকট নেই। বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। এতে করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে উৎসাহী হচ্ছে।
শিল্প বিকাশ এবং বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন উপযুক্ত স্থানে ১০০টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলা হচ্ছে। সরকার বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি এ্যাক্ট-২০১০ নামে একটি আইন পাশ করেছে। এতে করে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেশের আইন মোতাবেক সংরক্ষণ করা হয়েছে। বিনিয়োগে আর কোন জটিলতা নেই। স্পেশাল ইকোনমিক জোনগুলোতে কার্যক্রম শুরু হলে দেশের রপ্তানিতে বিপ্লব ঘটে যাবে। বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে দশটি স্পেশাল ইকোনমিক জোনের উন্নয়ন কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।
দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট(এফডিআই) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা বিদেশি বিনিয়োগকারীগণ খুবই গুরুত্বের সাথে দেখেন। ২০০৪ সালে বাংলাদেশে এফডিআই ছিল ২৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৮ সালে এফডিআই ছিল ৭৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এফডিআই-এর প্রবৃদ্ধি কম থাকলেও বর্তমান সরকারের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের কারণে তা এখন বাড়ছে। গত ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে দেশে এফডিআই ছিল ২০০৩.৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিগত ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪৫৪.৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এ হার ক্রমে আরো বাড়বে, কারণ দেশে এখন বিনিয়োগের পরিবেশ ভালো, কমমূল্যে বাংলাদেশে দক্ষ শ্রমিক পাওয়া যায়। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সমস্যা নেই। সবমিলিয়ে এখন বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত স্থান বাংলাদেশ। চায়নার চামড়াসহ অনেক সেক্টরের বিনিয়োগকারী এখন বাংলাদেশে শিল্প গড়ে তোলার চিন্তা করছেন। কারণ চীনে এখন শ্রমিকের মুজরি ও পণ্য উৎপাদনের ব্যয় বেড়েই চলেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চায়নায় পণ্য উৎপাদন করে কমমূল্যে বাজারজাত করা সম্ভব হবে না। সংগত কারণে চায়না চিন্তা করছে বাংলাদেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে এখানে পণ্য উৎপাদন করে সারাবিশ্বে রপ্তানি করবে।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য নানা প্রনোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। প্রশাসনিক জটিলতা এড়ানোর লক্ষ্যে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয় কাজ সহজ করতে “ওয়ান স্টপ সার্ভিস ডেস্ক” চালু করা হয়েছে। যাতে করে বিনিয়োগকারীদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অনুমতি, লাইসেন্স, গ্যাস সংযোগ, বিদ্যুৎ সংযোগ, পরিবেশগত ছাড়পত্র ইত্যাদির জন্য সংশ্লিষ্ট অফিসে দীর্ঘদিন সময় দিতে না হয়।
বিনিয়োগের জন্য সকল সেবা এক স্থান থেকেই দেওয়া হচ্ছে। ট্যাক্স হলিডে, কাস্টমস ডিউটি, ইনকাম ট্যাক্স, রিপেট্রিয়েশন, ফ্রি ফ্লো এফডিআই অর্থাৎ বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগে কোন লিমিট নেই, ব্যাকোয়ার্ড লিংকেজ সুবিধা, লোকাল সেল, সাব-কনটাক্টিং, স্ট্যাম্প ডিউটি হ্রাস, ভ্যাট হ্রাস, রপ্তানিতে কাস্টমস ডিউটি হ্রাস, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে শর্ত শিথিল, ডাবল ট্যাক্সেশনে ছাড়, এক্সপার্টদের বেতনের ওপর ইনকাম ট্যাক্স হ্রাস, কাস্টমস বন্ডে সুবিধা প্রদান, সহজ ফরেন কারেন্সি (এফসি) লোন সুবিধা, নন-রেসিডেন্টদের ফরেন কারেন্সি (এফসি) একাউন্ট সুবিধা, শেয়ার হস্তান্তরের সুবিধা, এক্সপার্ট নিয়োগের জন্য সহজেই ওয়ার্ক পারমিট প্রদানসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুই সহজ করে দেওয়া হয়েছে বিনিয়োগকারীদের জন্য।
এক কথায় বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকার বাংলাদেশে বিনিয়োগের সীমা তুলে দিয়েছে, যেকোন সময় লাভসহ বিনিয়োগকারী তার মূলধন ফিরিয়ে নিতে পারবেন, পণ্যের কাঁচামাল ও পণ্য আমদানি-রপ্তানি সহজ করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সরকার বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ করেছে। যাতে শিল্পে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করতে পারে, বিনিয়োগ যাতে লাভজনক হয় সে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এছাড়া বাংলাদেশে এখন ১৬ কোটির বেশি মানুষের বাস। পণ্যের স্থানীয় বাজারও বিশাল। অনেকগুলো কারণেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে এসেছে।
বিনিয়োগের আহ্বানে সারা দিয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীগণ স্পেশাল ইকোনমিক জোনে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে এসেছে। ইতোমধ্যে চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, জাপান, কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ন ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। ভারত বাংলাদেশের মংলা ও কুষ্টিয়াতে দুইটি ইকোনমিক জোনে বিনিয়োগের জন্য এমওইউ স্বাক্ষর করেছে গত ২০১৫ সালের ৭ জুন, চায়না সরকার অনুমোদিত সিসিসিসি এবং চায়না হারবোর ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লি. নামে দুইটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের ইকোনমিক জোনগুলো উন্নয়নের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
বাংলাদেশের বৃহৎ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান মোমেন গ্রুপ গজারিয়ায় ২১৬ একর জমিতে বিনিয়োগ করার জন্য এমওইউ স্বাক্ষর করেছে, দেশের বড় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পাওয়ারপ্যাক মোংলায় ইকোনমিক জোনে বিনিয়োগের জন্য ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট এমওইউ স্বাক্ষর করেছে, দেশের বৃহৎ চামড়া পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বে গ্রুপ বে ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার জন্য গাজিপুরে ৬৫ একর জমির উপর শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে। পর্যায়ক্রমে জমির পরিমাণ আরো বাড়বে। এতে একলাখের বেশি মানুষ কাজ করার সুযোগ পাবেন।
আশিয়ানা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার জন্য ৫০.৮ একর জমিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে, দেশের বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপ ময়মনসিংহে ১০০ একর জমির ওপর শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর এমওইউ স্বাক্ষর করেছে। চট্টগ্রামের মিরেশ^রাইতে ২০০ একর জমির ওপর এলপিজি প্লান্ট নির্মাণের জন্য ২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর ওমেরা পেট্রোলিয়াম নামে একটি প্রতিষ্ঠান এমওইউ স্বাক্ষর করেছে। নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও-এ ও মেঘনা ঘাটে ২৪৫ একর জমির ওপর মেঘনা ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার জন্য এমওইউ স্বাক্ষর করেছে।
এতে বিনিয়োগ হবে ১৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং কর্মসংস্থান হবে বিপুল সংখ্যক মানুষের। সিসুয়ান সিল্করোড ইকোনমিক বেল্ট ইনভেস্টমেন্ট এন্ড করপোরেশন চেম্বার অব্ কমার্স বাংলাদেশ ইকোমিক জোন অথরিটির সংগে এমওইউ স্বাক্ষর করেছে। মিরেশ্বরাই ইকোনমিক জোনে সিসুয়ান ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নির্মাণ করবে ৯৮৮.৫০ একর জমিতে। এখানে বিনিয়োগ হবে ১.৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এখানে পাওয়ার, ইলেক্ট্রিসিটি, নিউ এনার্জি অটোমোবাইল, মটরসাইকেল, কৃষি যন্ত্রপাতি, পশুখাদ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের মিরেশ^রাই ও ফেনিতে ৩০ হাজার একর জমির ওপর স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার।
এছাড়া সরকারি ব্যবস্থাপনায় শ্রীহট্রো ইকোনমিক জোন, মিরেশ^রাই ইকোনমিক জোন, মোংলা বাগেরহাট ইকোনমিক জোন, সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় গোহিবা ইকোনমিক জোন, সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক এবং নাফ (জালিয়ার দ্বীপ) ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।
চলমান কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে আশা করা যায় ২০৩০ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে ২৬তম অর্থনীতির এবং ২০৫০ সালে ২২তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। দেশের রপ্তানি দ্রুত বাড়ছে গত বছর ৪১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালে ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কাজ করে যাচ্ছে। তৈরিপোশাকের পাশাপাশি সরকার ঔষধ, আইটি, ফার্নিচার, জাহাজ, কৃষিজাতপণ্য, চামড়াজাত পণ্য এবং অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।
রপ্তানি উৎসাহিত করতে নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশের প্রথম ধাপ সফলতার সাথে অতিক্রম করেছে। ২০২৪ সালে পূর্ণাঙ্গ ভাবে উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বিশ্ববাণিজ্য প্রতিযোগিতায় সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে একথা বলা যায়।
০৯.১০.২০১৮