স্বাস্থ্য । ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
ব্রেস্ট টিউমারে আতঙ্ক নয়, সচেতনতা চাই
বর্তমানে ব্রেস্ট টিউমার সম্পর্কে মহিলারা ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠেছে। এর জন্য দরকার গণসচেতনতা। টিউমার হলো দেহ কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এটা কখনো Benine বা অক্ষতিকর আবার কখনো Malignant বা ক্যান্সার রূপে দেখা দেয়। প্রতিনিয়ত আমাদের দেহে পুরনো কোষ ধ্বংস হয়ে কোষ বিভাজনের মাধ্যমে নতুন কোষ তৈরি হয়। ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ : কমবেশি সব মহিলাদের স্তনেই লাম্প থাকে। এর মধ্যে কয়েকটি ক্যান্সারাস ও কয়েকটি নন-ক্যান্সারাস। এই ব্রেস্ট লাম্পগুলো অনেক সময় আন্ডারআর্ম বা কলার বোনের তলাতেও দেখা যায়। এছাড়া স্তনবৃন্তের আশপাশেও এই ধরনের লাম্প থাকে যেগুলো টিপলে শক্ত লাগে এবং অবস্থান পরিবর্তন করে না। এমন কিছু দেখলে অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। কোনো রকম রস কশ নেই স্তনে, তবু ইচিং বা চুলকানির মতো অনুভূতি হচ্ছে, এমন কিছু কিন্তু ক্যান্সারের লক্ষণ।
অনেক সময় এর সঙ্গে নিপল থেকে হালকা হালকা রস? নিঃসৃত হয়, স্তনের ত্বকেও কিছুটা পরিবর্তন আসে। তাই চুলকানির মতো কিছু হলে নিজে থেকে কোনো ক্রিম বা লোশন লাগাবেন না। আগে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলবেন। স্তনে টিউমার থাকলে তা আশপাশের ব্রেস্ট টিস্যুগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং তার ফলে স্তনে একটা ফোলা ফোলা ভাব দেখা যায়। এরই সঙ্গে স্তনে লাল ভাবও থাকে। স্তনে হাত দিলে বা চাপ দিলে ব্যথাও লাগে। কাঁধ এবং ঘাড়ের ব্যথাও ব্রেস্ট ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে কারণ এই ক্যানসার স্তন থেকে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে শরীরের এই অংশগুলোতে। এই সমস্ত জায়গায় ব্যথা হলে সাধারণের পক্ষে জানা সম্ভব নয় তা মাসল পেইন নাকি ক্যান্সারের কারণে ঘটছে। তাই পরীক্ষা করে নেয়াই ভালো। স্তনের আকার এবং সাইজ পরিবর্তনও এই ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। সচরাচর এই বিষয়টি পার্টনারের চোখেই বেশি পড়ে। তেমন কিছু শুনলে বিষয়টি উড়িয়ে দেবেন না। নিজেই আয়নার সামনে স্তনটি পরীক্ষা করুন এবং ক্যান্সারের পরীক্ষা করিয়ে নিন। স্তনে লাম্প সব সময় বড় আকারের হয় না। ছোট ছোট ফুসকুড়ির মতো লাম্পও দেখা যায় স্তনবৃন্তের আশপাশে। অন্তর্বাস পরে থাকার সময় যদি ঘর্ষণ অনুভব করেন, বিছানায় শোওয়ার সময় যদি ব্যথা লাগে তবে চিকিৎসকের কাছে যেতে দেরি করবেন না।
ব্রেস্টফিডিং করছেন না অথচ স্তনবৃন্ত থেকে অল্প অল্প দুধের মতো জলীয় পদার্থ নিঃসরণ হচ্ছে এমনটা দেখলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যাবেন। এটি ব্রেস্ট ক্যান্সারের অন্যতম বড় লক্ষণ। অনেক সময় স্তনবৃন্ত থেকে রক্ত পড়তেও দেখা যায়। স্তনবৃন্ত হলো স্তনের অসম্ভব সংবেদনশীল অংশ। যদি দেখেন যে স্তনবৃন্ত স্পর্শ করলেও তেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে না বা একেবারেই অনুভূতিহীন হয়ে গেছে তবে তা ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। স্তনবৃন্তের ত্বকের তলায় ছোট ছোট টিউমার তৈরি হলেই এমনটা হয়। স্তনবৃন্ত চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া, বেঁকে যাওয়া বা স্তনবৃন্তের শেপ অসমান হয়ে যাওয়া ক্যানসারের লক্ষণ, বিশেষ করে যদি ব্রেস্টফিডিং না চলাকালীনও এই বিষয়গুলো চোখে পড়ে। সঙ্গীকে বলুন ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে। সামান্য সন্দেহ হলেই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। স্তনের উপরের ত্বক খসখসে হয়ে যাওয়া, অনেকটা কমলালেবুর খোসার মতো, ক্যান্সারের প্রাথমিক স্টেজের লক্ষণ। দিনের মধ্যে একটা সময় তাই ভালোভাবে স্তনটি পর্যবেক্ষণ করা উচিত। যে কোনো লক্ষণ চোখে পড়লেই দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং পরীক্ষা করান।
স্তন ঝুলে যাওয়ার কারণ : শারীরিক গঠন ফিট না থাকলে মন খারাপ হতেই পারে। নারীর ক্ষেত্রে এই মন খারাপের কারণ হতে পারে স্তন ঝুলে যাওয়া নিয়ে। অল্প বয়সেই অনেক নারীর স্তন ঝুলে যাওয়ার সমস্যায় পড়তে হয়। এর অনেকগুলো কারণও আছে। তবে কারণ ও সমাধান জানা থাকলে এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
শরীরের গঠনের তারতম্যের কারণে স্তন ঝুলে যেতে পারে। শরীর মোটা থেকে চিকন বা চিকন থেকে মোটা হওয়ার কারণে স্তন ঝুলে যেতে পারে। অনেক সময় অতিরিক্ত ব্যয়ামও স্তন ঝুলে যাওয়ার একটি কারণ।সন্তান জন্মদানের কারণে অর্থাৎ প্রসূতিকালীন স্তনের আকার বড় হয়ে যাওয়ার কারণে স্তন ঝুলে যায়। আবার স্তন অতিরিক্ত বড় ও ভারী হওয়ার কারণেও ঝুলে যেতে পারে।বয়সের কারণে স্বাভাবিকভাবেই স্তন ঝুলে যায়। অপ্রতুল স্তন-সার্পোটের কারণেও স্তন ঝুলে যায়। ধূমপানের চামড়ার স্থিতিস্থাপকতা দুর্বল করে দেয় যা স্তন ঝুলে যেতে সাহায্য করে।
স্তন যদি ঝুলে গিয়েই থাকে, তাহলে তাকে ফিট রাখার উপায়ও আছে। জেনে নিন কয়েকটি উপায়:সঠিক ব্রা ব্যবহার: আপনি অবশ্যই এমন ব্রা পরুন যা আপনার স্তনকে সম্পুর্ন সাপোর্ট দেয়। লক্ষ রাখতে হবে আপনার ব্রা অবশ্যই আপনার সাথে সাবলীল ভাবে চলতে পারে- অর্থাৎ চলার সময় আপনার ব্রা লেইস যেন কাঁধ থেকে খসে না পড়ে অথবা বন্ধনি অতিরিক্ত টাইট কিংবা অতিরিক্ত লুজ না হয়। যখন ব্রা সাইজ নেবার জন্য মাপতে যাবেন, অবশ্যই খেয়াল রাখবেন আপনার পুরাতন ব্রা পরনে থাকতে হবে এবং সে অবস্থায় স্তনের ঠিক নিচে মাপ নিচ্ছেন।
ঘরে বসে স্তন পরীক্ষা
গোসলের সময় : গোসলের সময় ভেজা চামড়ার উপর আঙুল ছবির মতো চ্যাপ্টা করে ধীরে ধীরে চালনা করতে হবে। বাঁ দিকের স্তনের জন্য ডান হাত ও ডান দিকের স্তনের জন্য বাঁ হাত ব্যবহার করতে হবে। দেখতে হবে কোনো চাকা, গুটি বা শক্ত দলার মতো কিছু অনুভূত হয় কি না।
আয়নার সামনে: প্রথমে হাত দু’পাশে থাকবে, তারপর হাত দুটি সোজা করে মাথার উপর তুলতে হবে। এবার সতর্কভাবে লক্ষ্য করে দেখতে হবে যে, স্তনবৃন্ত বা অন্য কোনো অংশ ফুলে আছে কি না অথবা কোনো অংশে লালচে ভাব বা টোল পড়া অংশ আছে কি না।
এবার কোমরে হাত দিয়ে কোমরে চাপ দিতে হবে। এখন ডান ও বাম স্তন দুটোই ভালোভাবে দেখতে হবে। কোনোরকম অস্বাভাবিক পরিবর্তন চোখে পড়ে কি না। তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা প্রয়োজন, খুব কম নারীরই দুটো স্তন দেখতে একই রকম হয়। প্রতিনিয়ত এই পরীক্ষা করলে স্তনের স্বাভাবিক অবস্থা বোঝা যাবে ও অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন হলে তা চোখে পড়বে।
মাটিতে শুয়ে : মাটিতে অথবা বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়তে হবে। এরপর ডান স্তন পরীক্ষার জন্য ডান দিকে ঘাড়ের নিচে একটি বালিশ বা ভাঁজ করা কাপড় দিয়ে উঁচু করতে হবে এবং ডান হাত মাথার পেছনে রাখতে হবে। এবার বাম হাতের আঙুলগুলো চ্যাপ্টা করে ডান স্তনের উপর রাখতে হবে।
ঘড়ির কাঁটা ঘোরার দিকে চক্রাকারে হাত ঘোরানো শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে বলে রাখা জরুরি, স্তনের নিচের অংশ কিছুটা শক্ত মনে হতে পারে। এটা স্বাভাবিক বিষয়। এভাবে চক্রাকারে হাত ঘুরে আসার পর স্তনবৃন্তের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এক ইঞ্চি অগ্রসর হবার পর একইভাবে চক্রাকারে আবার স্তন পরীক্ষা করতে হবে। সবশেষে স্তনবৃন্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনীর মধ্যে ধরে চাপ দিতে হবে এবং দেখতে হবে কোনো কিছু নিঃসরিত হয় কি না।
এই পরীক্ষাগুলো করবার সময় যদি স্তনে কোনো ধরনের শক্ত চাকা, গোটা বা দলা অনুভূত হয় অথবা স্তনের বোঁটা হতে কিছু নিঃসরিত হয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
ঘরে বসেই স্তন পরীক্ষা : এভাবে মাসে অন্তত দুবার ঋতুচক্রের নির্দিষ্ট সময়ে প্রত্যেক নারীর স্তন পরীক্ষা করা উচিত। নিয়মিতভাবে নিজের স্তনের যেকোনো অস্বাভাবিক চাকা বা টিউমার শনাক্ত করার জন্য হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখার এই পদ্ধতিকে বলা হয় সেলফ ব্রেস্ট এক্সাম। এই সেলফ ব্রেস্ট এক্সামই পারে স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে।
হোমিওসমাধান : রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় আধুনিক ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে কোনো ধরনের অস্ত্রোপচার ও কষ্টকর থেরাপি ছাড়াই সুস্থতা লাভ করা সম্ভব এবং রোগীর লক্ষণগুলো সংগ্রহ করে সঠিক ওষুধ নির্বাচন করতে পারলে তাহলে ব্রেস্ট টিউমার ও জরায়ু টিউমার চিকিৎসা হোমিওতে চিকিৎসা দেয়া আল্লাহর রহমতে সম্ভব।
লেখক : কো-চেয়ারম্যান, হোমিওবিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
ইমেইল : drmazed689@gmail.com