ভাষা ও আমাদের অনুভূতি

ভাষা ও আমাদের অনুভূতি

কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক, মানজুম উমায়ের ও যাকারিয়া ইদরিস
আমরা যেভাবেই কথা বলি, সেটাই কিন্তু ভাষা। তরজমা করলে বা সংজ্ঞায়িত করতে গেলে নানাভাবে করা যেতে পারে। মনের ভাব প্রকাশের ভঙ্গিই ভাষা। তা কণ্ঠধ্বনির মাধ্যমে হোক বা অন্য কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গর ইশারার মাধ্যমে হোক। ভাষার সংজ্ঞা প্রদানে ড. রামেশ্বর বলেন, মানুষের বাকযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত কতকগুলো ধ্বনিগত ভাব সংকেত বা প্রতীক সমষ্টির নাম। []
ভাষার সংজ্ঞা প্রদানে Henry Sweet বলেন : Language is the expression of ideas by means of speech-sounds combined into words. Words are combined into sentences, this combination answering to that of ideas into thoughts.

fvlvweÁvbx Edgar. H. Sturtevant e‡jb : ÒA language is a system of arbitrary vocal symbols by which members of a social group Co-operate and interect.

মানুষ সামজিক জীব। এজন্য তাকে অন্য মানুষের সাথে ভাব বিনিময় করতে হয়। এভাবে বিনিময়ের জন্য যে সব সংকেত প্রতীক ব্যবহৃত হয় তাই ভাষা, এভাবে বিশ্লেষণ করলে ভাষার চারটি মূল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়: ক. এ কতগুলি ধ্বনির সমষ্টি, খ. এ ধ্বনি কণ্ঠনিঃসৃত, গ. এটি একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ ব্যবস্থা, ঘ. এ ধ্বনিগুলো বস্ত্ত বা ভাবের প্রতীক।
ভাষার সংজ্ঞা প্রদানে আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ বলেন, ভাষা হচ্ছে মানুষের ভাব বিনিময় ও প্রকাশের প্রতীকী প্রত্যয় বিশেষ। এটি ধ্বনি ও ইশারা ও ইঙ্গিত উভয়কেই অন্তর্ভূক্ত করে। তবে পারিভাষিক অর্থে কারো কণ্ঠনিঃসৃত অর্থবোধক ধ্বনিকেই ভাষা নামে অভিহিত করা হয়।

সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোগ্যতা তার ভাষা। অন্যান্য জীবেরও ভাষা আছে, কিন্তু তার তুলনায় মানব-ভাষার বৈচিত্র্য, গভীরতা আর বহুমাত্রিক শ্রেষ্ঠত্ব অপরিমেয়। ভাষার মাধ্যমেই অনাদিকাল ধরে মানুষ তার অভিজ্ঞতা-জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে; গড়ে তুলতে পেরেছে গৌরবময় সমুন্নত সভ্যতা। পারস্পরিক যোগাযোগ থেকে শুরু করে মানবজীবনের সর্বস্তরে ভাষা, প্রধানত মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মহিমা তাই বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।

জ্ঞানের চূড়ান্ত ও মৌলিক প্রকাশ ঘটে ভাষায়। যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক জ্ঞান অর্জনের তাৎপর্যপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ভাষার মধ্যেই প্রতিফলিত হয়। প্রাত্যহিক যোগাযোগে যেমন, তেমনি জ্ঞানচর্চা, আত্ম-আবিষ্কার, যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা, ইতিহাস-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা সবকিছুরই অন্যতম মৌলিক মাধ্যম বস্তুত ভাষা। বিশেষ করে দেশপ্রেমের ধারণাটি ভাষার সাথে ওৎপ্রোতভাবে বিজড়িত। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার জাতির লোকদের মাতৃভাষাতেই প্রেরণ করেছি।’ [সূরা ইবরাহীম : আয়াত ৪]। এর কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, যেন তারা রাসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য এবং কী নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন তা বুঝতে পারে।’ [তাফসিরে ইবনে কাসির : ৪/৪৭৭ ও মুসনাদে আহমাদ : ৫/৫৮৫]

স্পষ্ট বুঝা গেল, নিজে বুঝা এবং বুঝানোর জন্য ভাষা অভিন্ন হওয়া চাই। এ রীতি আল্লাহ কর্তৃক প্রবর্তিত। এর বিরুদ্ধাচরণ আল্লাহর রীতির বিপক্ষে অবস্থানের নামান্তর। যেমন হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের কাছে যাবূর কিতাব তার মাতৃভাষা ইউনানী বা (আরামাইক) ভাষায়, মূসা আলাইহিস সালামের কাছে তাওরাত ইবরানী বা হিব্রু ভাষায়। এটাও তাঁর মাতৃভাষা। এভাবে ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে তাঁর মাতৃভাষা সুরিয়ানি বা সিরিয়ার ভাষায় ইনযিল কিতাব ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে মাতৃভাষা আরবি ভাষায় আল-কুরআন প্রেরণ করা হয়। এসব আসমানী কিতাব যদি মাতৃভাষায় নাযিল না করতেন তবে এগুলো নাযিলের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতো।
এ ছাড়া মনের আকাক্সক্ষা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে নিবেদন করতে হলেও মাতৃভাষা ব্যতীত সম্ভব হয় না। মনের আকুতি প্রকাশ করে বিনতিপূর্বক প্রার্থনায় মন ও আত্মার মাঝে এক স্বর্গীয় অনুভূতি তৈরি হয়। বান্দার আর্তি আল্লাহর কাছে কবুল হওয়া না হওয়ার দোলায় দুলেও মাতৃভাষায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পেরে সাময়িক জাগতিক শান্তির ছোঁয়া পায়। বঙ্গবাণী কবিতায় আবদুল হাকিম তাই যথার্থই বলেছেন,

‘যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আগে নিরঞ্জন’
অনুরূপ স্বদেশী ভাষা কবিতায় রামনিধিগুপ্ত বলেছেনÑ
নানান দেশের নানান ভাষা
বিনে স্বদেশীভাষা মিটে কি আশা।

পৃথিবীর যে কোন ভাষাভাষীর কাছে মাতৃভাষার আকর্ষণ বেশি, মাতৃভাষার মর্যাদা অতুলনীয় অনুপম। যে কারো কাছে মাতৃভাষাই শ্রেষ্ঠ এবং মাতৃভাষা চির অহঙ্কার ও গৌরবের। লাল সবুজের বাংলাদেশে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাভাষা। পৃথিবীর বিপুলসংখ্যক মানুষ আজ বাংলা ভাষাভাষী। অন্যতম আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার বিষয়টি বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে আজ আর কল্পনামাত্র নয়, বরং এর বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত কার্যকারণ রয়েছে। জাতি-রাষ্ট্র-ভাষা এই তিনের মেলবন্ধনে বাংলাদেশই বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষা সুবিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে, ধারণা করা যায়। মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার গৌরব যেমন ঐকান্তিকভাবে আমাদের, তেমনি সে গৌরবের সমগ্রপ্রসারী প্রতীক সুমহান একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে মানব সভ্যতার অহংকারেরও অংশ।

বিশ্বখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, পৃথিবীতে ২৭৯৬টি ভাষা প্রচলিত আছে। তবে ভাষার প্রকৃত পরিসংখ্যান আজও নির্ণীত হয়নি। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের সংরাগ চিরকালীন। বর্ণিল পৃথিবীকে আরো স্বাপ্নিক ও আলোকিত করতে বাংলাভাষার প্রতি আমাদের মমত্ববোধ যে কোনো ভাষার চেয়ে বোধ করি বেশি। দেশমাতৃকার জন্য আত্মত্যাগ ও প্রাণোৎসর্গের ঘটনা জানা থাকলেও কোনো জাতি তার মাতৃভাষার জন্যে জীবনকে বিসর্জন দিয়ে শাহাদাতের মর্যাদা নিয়েছে এমন নযীর ইতিহাসে নেই।

অপরিসীম গুরুত্বের সাথে মাতৃভাষাকে স্মরণ করে ইসলাম। মাতৃভাষা শিক্ষা ও বিকাশে ইসলামের রয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। আল্লাহ তাআলা নবী রাসূলদের কাছে যুগে যুগে যেসব আসমানী কিতাব প্রেরণ করেছেন, তা তাঁদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় প্রেরণ করেছেন। এছাড়া মাতৃভাষা চর্চা বা বিশুদ্ধভাবে কথা বলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুপম সুন্নাত। যেসব গুণ মানুষের ব্যক্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে তার মধ্যে বিশুদ্ধ ভাষণ ও সুস্পষ্ট উচ্চারণ অন্যতম। শ্রোতাদের ওপর বক্তব্যের প্রভাব অনস্বীকার্য। জনগণকে মাতৃভাষায় বিশুদ্ধ ও সুন্দর উচ্চারণে বোঝানো দরকার। নেতৃত্বের একটা বিশেষ গুণ হলো সুন্দরভাবে বক্তব্য দেওয়ার দক্ষতা। ভাষার ওপর দখল থাকলে শ্রোতার ওপর বক্তব্যের প্রভাব অনেক বেশি হয়।

দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি সর্বপ্রকার জ্ঞান-গরিমা, ইসলামি সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যাপক প্রচার, প্রসার ও পরিচিতি মাতৃভাষা চর্চার ওপর নির্ভরশীল। যে বিধিবিধান বা ধর্মীয় অনুশাসন মানবজাতিকে আল্লাহর পথে, সত্য ও ন্যায়ের পথে এগিয়ে নেয় এবং জীবনকে আসমানীজ্ঞানের আলোকে আলোকিত করে, সেই বিশাল জ্ঞানভা-ার পবিত্র কোরআন ও হাদিসসহ অন্য বহু মূল্যবান ধর্মীয় গ্রন্থ মাতৃভাষা বাংলায় অনুবাদ হওয়ায় আজ আমরা জ্ঞানের নবদিগন্তে এগিয়ে চলেছি। পরস্পরের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করা, সৎকাজ করা এবং অন্যায় থেকে বিরত থাকা বা বাধা প্রদান করা, ধর্মের বিধিবিধান প্রতিপালন করা, আন্তধর্মীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা কেবল মাতৃভাষার মাধ্যমেই সম্ভব।
১৬ কোটি জনতা আপনার সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আপনার ভাষণ শোনার জন্য। ইংরেজি ভাষা তারা বুঝে না। আপনি ইংরেজিতে বা অন্য কোনো ভাষায় তাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিচ্ছেন। তাহলে এ হবে প-শ্রম। কারণ তারা সংখ্যায় বেশি। আপনি যদি তাদের বুঝানোর ইচ্ছে করে থাকেন তাহলে যেকোনো মূল্যে তাদের মায়ের ভাষা, রক্তস্নাত বাংলা ভাষা আপনাকে আয়ত্ত করতে হবে। যে অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন ওই অঞ্চলের ভাষা আপনাকে আয়ত্ত করতে হবে। এটিই বাস্তবানুগ কথা। জোর করে অন্য ভাষা গিলতে তাদের বাধ্য করবেন; তা হবে না। এ উপলব্ধি থেকে পৃথিবীর বহু দেশের ইসলাম প্রচারকগণ স্বদেশীয় ভাষা-সাহিত্যে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখলেও আমরা বাংলাভাষাভাষী মাতৃভাষায় এখনো অনগ্রসর।

বিশ্ব বরেণ্য আলেম আল্লামা ইউসুফ কারজাভি ও সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীসহ আরও অনেকে এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ১৬ কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হওয়ার পরও ভাষা জ্ঞানের দৈন অবস্থার দরুণ আমরা ইসলাম প্রচারকগণ তথা আলেম সমাজ তাদের হৃদয়ে স্থান পাচ্ছি না। আমাদের অনগ্রসরতার এটাই বড় প্রমাণ।

ভাষার এক অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে দ্বীন ও ইলম প্রচার ও দাওয়াতের। তাফসীরে ইবনে কাসীরের প্রথম খ-ের ৬৭ পৃষ্ঠায় আছেÑ ‘ইসলাম ধর্মের প্রতি আহ্বানকারী হলো সবার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।’ আর যুক্তির দাবি, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হবেন আদর্শবান ও অনুসরণযোগ্য। চরিত্র-মাধুর্য, ভাষা-সাহিত্যে এবং সার্বিক লেন-দেনে তিনি হবেন অনুকরণীয়। তাই দেখা যায়, সব ভাষাবিদ, সাহিত্যিক ও সুপ-িত নত শিরে স্বীকার করেছেন নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শ্রেষ্ঠত্ব। কোমল চরিত্র ও অন্যান্য বিষয়ের মতো তার ভাষাগত শ্রেষ্ঠত্ব এবং সাহিত্যালঙ্কারগত অলৌকিকত্বের স্বীকৃতিও দিয়েছেন তারা সর্বযুগে সর্বকালে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবগোত্রে জন্ম নিয়েছেন। তার ভাষা আরবি। পার্শ্ববর্তী অনারবীয় অঞ্চলে যখন তিনি দূত পাঠাতেন, তাদেরকে তাদের নিজ নিজ ভাষায় অনুবাদ করে কুরআন বুঝানো হতো।[মায়ালিমুত তানযিল : ৪/৩৩৫]
এখানে বুঝতে হবে, কুরআন নির্দিষ্ট একটি ভাষায় অবতীর্ণ হওয়া আর অন্য ভাষায় অনূদিত হয়ে উপস্থাপিত হওয়াটাই সঙ্গত। এতে বিকৃতি-বিবর্তন ও ঝগড়া-বিতর্কের কোনো অবকাশ থাকে না। পক্ষান্তরে যদি সব ভাষায় আলাদা আলাদাভাবে অবতীর্ণ করা হত তাহলে আঞ্চলিক ভাষাবিদগণ এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিতেন। তখন তা আর অবিকৃত থাকত না। [ফাতহুল কাদির : ৪/১২৭]। এ থেকে প্রতীয়মান হয় প্রচারের সুবিধার্থে বহুবিধ ভাষার ব্যবহার, অনুবাদ সাহিত্য বা ইসলামের মূল আরবি ভাষাকে ভিন্ন ভাষায় উপস্থাপন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত রীতির অংশ।

দাওয়াতি ময়দানে আমরা অহরহ এ অভিযোগের মুখোমুখি হই যে, ইসলাম যারা প্রচার করছেন তাদের ভাষা অনুন্নত। তাদের অনুবাদ-রচনায় সাহিত্যরস বা ভাষাগত সৌন্দর্য অনুপস্থিত। তারা আধুনিক প্রচার-মাধ্যম ও তথ্য-প্রযুক্তি থেকে অনেক দূরে। এ কারণে শিক্ষিত, সাহিত্যজ্ঞ ও সুশীল সমাজ ইসলামি বই-পুস্তক পড়েন না। বসেন না তাদের আলোচনার আসরে। বিশুদ্ধ, সাবলীল, সময়োপযোগী গ্রহণযোগ্য ভাষায় ইসলাম প্রচারে সক্ষম হলে আমাদের নির্ণয় করতে সহজ হবে, কে বিদ্বেষপ্রসূত আর কে ভাষা না বুঝার কারণে আগ্রহ থাকার পরও ইসলাম কবুল করছেন না, ইসলাম মানছেন না। এতে দাওয়াতি তৎপরতা চালানো অনেক সহজ ও ফলপ্রসূ হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষা শহীদদের মূল্যায়ন ও আমাদের করণীয়

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুন বাংলাভাষা আন্দোলন রক্তঝরা, অগ্নিক্ষরা এক মহান স্মৃতি বিজড়িত একটি দিনের নাম। যা যুগে যুগে সারা বিশ্বের মানবসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। ইতিহাসের সে অধ্যায় রচিত হয়েছিল এ পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) কিছু অকুতোভয় যুবক সালাম, রফিক, জববার ও বরকতের মত আরো অনেক যুবকের তাজা রক্তের বিনিময়ে। মাতৃভাষা বাংলাভাষা, যে ভাষার সাথে এ দেশের মানুষের নাড়ির সম্পর্ক। সে ভাষায় কথা বলা তথা মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় তাঁরা নিজেদের মহামূল্যবান জীবন নির্দিধায় বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাদের এ আত্মদানকে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন যে, তারা শহীদ কি-না?

উল্লেখ্য যে, মহান আল্লাহ্ রাববুল আলামীনের একক সাবভৌমত্ব, শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাত ও শেষ বিচারের দিনসহ পরকালীন অন্যান্য বিষয়র প্রতি অকুণ্ঠ চিত্তে নিজের আন্তরিক বিশ্বাসের মৌখিক ঘোষণাদান এবং রিসালাতের মাধ্যমে মহানবী সা.-এর কাছে প্রেরিত আল্লাহ্ প্রদত্ত মানবজীবনের বিধান সমাজ জীবনের সর্বস্তরে বাস্তবায়নের সংগ্রামে ইসলাম বিরোধী শক্তির হাতে মৃত্যু বরণ করাকেই শহীদ বলে।

মাতৃভাষা ব্যবহার করার অধিকার মানুষের সৃষ্টিগত তথা জন্মগত অধিকার। কারণ মহান আল্লাহ্ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং সাথে সাথে তাকে তার ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তাআলা বলেন, দয়াময় আল্লাহ্। তিনিই শিক্ষা দিয়াছেন কুরআন। তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে। [সূরা আর রহমান : আয়াত ১-৪]

আলোচ্য আয়াতের মাধ্যমে জানা যায় যে, মানুষ সৃষ্টির সাথে ভাষার এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাই মাতৃভাষা মানুষের একটি সৃষ্টিগত অধিকার। তাই কেউ যদি এ অধিকার ছিনিয়ে নিতে চায় তার প্রতিরোধ করা অপরিহার্য। আর এ প্রতিরোধে কেউ নিহত হলে ইসলামের দৃষ্টিতে সে শহীদের মর্যাদা পাবে। তবে শর্ত হলো, তাদেরকে প্রকৃতভাবে এমন মুসলমান হতে হবে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিহত হয়। এখানে আরো একটি প্রশ্ন থেকে যায় আর তা হলো, যারা নাস্তিক তারাও ভাষা আন্দোলনে নিহতদেরকে শহীদ বলে থাকেন, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের ব্যাখ্যা ভিন্নরূপ বলে মনে হয়। কেননা তারা তো আল্লাহ্ ও পরকালকেই বিশ্বাস করেন না। তাই শহীদ বলতে ইসলামের সেই শহীদ মনে করাটা বাঞ্ছনীয় নয়। তাই এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারীদের নিকট শহীদ অর্থ হলো স্বরণীয় অনুকরণীয় মডেল মনে করা। প্রকৃতপক্ষে এ বিষয়ে যেমন রয়েছে পারিভাষিক জটিলতা, তেমনি রয়েছে নিহত ব্যক্তির উদ্দেশ্য ও অবস্থাগত অস্পষ্টতা। সুতরাং যিনি যে ধরনের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, তিনি সে অনুসারেই ভাষার জন্য শহীদ হওয়া সম্পর্কে মূল্যায়ন করবেন। আর এটাই হওয়া স্বাভাবিক।

আমরা বাংলাদেশের অধিবাসী, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। আমরা আজ মাতৃভাষায় কথা বলি। এর পেছনে এসকল শহীদদের অবদানই সর্বাগ্রে। কাজেই এ ভাষা শহীদদের প্রতি আমাদেরও কিছু করণীয় রয়েছে। তাই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় যেসকল অকুতভয় মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিল তারা যদি ইসলামী শহাদাতের শর্তগুলো পূরণ করে থাকেন, কুর’আন-হাদীসের আলোকে তাদেরকে আমরা জান্নাতবাসীই বলব। তাদের নাজাতের ব্যাপারে আল্লাহই সর্বজ্ঞাত। অন্যথায় তাদের ভিতর যদি সে রকম শর্তাবলী অনুপস্থিত থেকেও থাকে, তবুও তারা যেহেতু আমাদের অধিকার আদায়ের জন্যেই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন সুতরাং মুসলমান হিসেবে তাদের জন্য আমাদের কর্তব্য হলো আল্লাহর কাছে মাগফিরাত তথা ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া। কেননা, এটি একটি সদকায়ে জারিয়ার মত। আর এ সম্পর্কে হাদীসের একটি বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, যদি কেউ কোন সদকায়ে জারিয়ার মত সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাহলে যত প্রাণী তা থেকে উপকৃত হবে, সে ঐসকল মানুষের নেকীর একটি অংশ পেয়ে যাবে।[ মুসলিম শরিফ]

অবশ্য কোন কোন ধর্ম ও সমাজে গান বাজনর মাধ্যমে তাদের দেব-দেবীদেরকে স্মরণ করে থাকে এবং এর মাধ্যমে তারা তাদেরকে খুশী করার চেষ্টা করে। সেটা তাদের ধর্মীয় ব্যাপার। আমরা মুসলমান, আমাদের ধারণা মতে শহীদরা পরকালে অবস্থান করছেন। তাই যে সকল কাজ-কর্ম তাদের উপকারে আসে সে সকল কাজই বেশি বেশি করা।
আমাদের তাই আজ সময় এসেছে সকল শাখার সকল মানুষের মধ্যে মাতৃভাষা, মাতৃভূমি এবং মানুষের প্রতি উপযুক্ত দরদ ও অঙ্গীকার যেন গড়ে তুলতে পারি। আর্থ-সামাজিক প্রতিপত্তি আমাদের কাউকে যেন এমন মূঢ়তায় তাড়িত না করে যে, আমরা মাতৃভাষার মহিমার প্রতি অবজ্ঞা করে বসি কিংবা আচরণে উন্নাসিকতা দেখাই। মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা মানুষকে দেশপ্রেম এমনকি মানবপ্রেমের প্রেরণা থেকেও বিচলিত করে আত্মকেন্দ্রিক-স্বার্থপর করে তুলতে পারে। দ্বীনের ক্ষেত্রে বাংলাভাষা প্রয়োগের সুফল পেতে হলে সর্বশ্রেণি-পেশার প্রতিষ্ঠিত মানুষদের মতো আলেম-ওলামাদেরও বাংলা ভাষায় প্রণিধানযোগ্য দখল থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

মাসিক পাথেয়, ফেব্রুয়ারি ২০১৮

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *