ভূস্বর্গ কাশ্মীরের পথে-প্রান্তরে, পর্ব-২

ভূস্বর্গ কাশ্মীরের পথে-প্রান্তরে, পর্ব-২

তাহসিন ইসলাম

গত পর্বের পর…

পরদিন  দুপুরের খাবার সেরে আমরা বের হলাম কেতার দারজ ভ্যালির উদ্দেশ্যে। এই নয়ানাভিরাম জায়গাটি কাশ্মিরের একদম শেষ প্রান্তে, কিছুদূর পরেই পাকিস্তান বর্ডার শুরু। উবাইদ ভাইদের নিজস্ব গাড়ি থাকায় যাতায়াত নিয়ে কোনো টেনশন নেই। তার বাবা সারাদিন ডিউটিতে থাকে আর মা থাকে বাসায় একা। তাই তাকেও আমাদের সঙ্গে নিয়ে নিলাম। আসলে ছেলের এমন অসুস্থতার পরে আন্টি সবসময় ছেলেকে নিয়ে টেনশন থাকেন। তাকে দূরে যেতে দিতে চান না। তাই উবাইদ ভাই বললো মা কেও সাথে নিয়ে নেই।

আমরা দেরি না করে বেড়িয়ে পরলাম। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে আমাদের গাড়ি সামনে এগোচ্ছে। প্রায় দশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল করে গাড়ি উঠে যাচ্ছে সেই পাহাড়ে। সিলেটের জাফলং কিংবা বান্দরবানের পাহাড়ী পথে আমি অনেকবার গিয়েছি। কিন্তু এই পাহাড়ের সাথে সেসব পাহাড়ের কোনো তুলনাই হয় না। “এ যেন তাজমহলের পাশে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল!”

সিলেটের জাফলং কিংবা বান্দরবানের পাহাড়ী পথে আমি অনেকবার গিয়েছি। কিন্তু এই পাহাড়ের সাথে সেসব পাহাড়ের কোনো তুলনাই হয় না। “এ যেন তাজমহলের পাশে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল!”

ওবাইদ ভাই খুব ভাল ড্রাইভিং পারায় এমন সরু রাস্তায়ও খুব স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। কিন্তু পেছন থেকে আন্টির রাগারাগির কারণে বারবার গাড়ির গতি নামাতে হচ্ছে তার। আন্টি তার ঝুলি থেকে বের করে কিছুক্ষণ পর পর আমাদেরকে আপেল কেটে খাওয়াচ্ছেন আর বাংলাদেশ সম্পর্কে নানান কিছু জিজ্ঞেস করছেন। আমিও খুব আগ্রহ ভরে নিজ দেশের কৃষ্টি-কালচার নিয়ে তাদের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠলাম। আর পথের দু’পাশে অবলোকন করছিলাম অপরূপ সৌন্দর্যের  লীলাভূমি পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গের উপমা এই ‘কাশ্মির’ ।

প্রায় তিন ঘণ্টা জার্নির পর আমরা পৌঁছে গেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। গায়ে মোটা  কাপড় থাকার পরও এতো ঠাণ্ডা লাগছিলো যেন কোনো বরফের দেশে চলে এসেছি। খানিকটা হাঁটার পর পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ পেলাম। উবাইদ বললেন পাশেই ঝর্ণা আছে। এটা তারই শব্দ। আমরা শব্দের উৎস ধরে হাঁটতে হাঁটতে একদম ঝর্ণার তলে পৌঁছে গেলাম। চোখের সামনে এমন সুন্দর ঝর্ণা দেখে মুগ্ধতা যেন কাটছেই না।

কেতার দারজ ভ্যালির পাথুরে ঝর্ণার পারে দাঁড়িয়ে

বড় বড় সাদা পাথরের উপর দিয়ে আপন মনে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ পানির নির্ঝরিণী। নির্জন এই জায়গায় শুধু পানির ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ। হাত দিয়ে পানি ছুঁতেই আঙুলগুলো যেন ঠাণ্ডায় জমে গেলো। ঝর্ণায় পাশেই কিছু ছেলেপেলে ক্রিকেট খেলছিলো। হঠাৎ তাদের বল সেই ঝর্ণার তলে এসে পড়লো। তারা বলটি তুলে নিয়ে আবার খেলা শুরু।

পাহাড়ের তলে ক্রিকেট খেলছে ছেলেপুলেরা

খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো তাদের সাথে আমিও ক্রিকেটে মেতে যাই। সময়ের অভাবে তা আর সম্ভব হয়ে উঠলো না। আমরা ঝর্ণার ঠাণ্ডা পানি দিয়ে অজু করে পাহাড়ের নীচে আছরের নামাজ পড়ে নিলাম। আনমনে দাঁড়িয়ে উপভোগ করলাম কাশ্মিরের সৌন্দর্য। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য। প্রভুর কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে এলো। এতো নিপুণ শৈল্পিকতায়, কী দারুণ করে তিনি এঁকেছেন এই পৃথিবীর ছবি। কী চমৎকার তাঁর শৈল্পিকতা, কী জাদুময়তা তাঁর রঙতুলিতে। তন্ময়তা যখন ভাংলো তখন প্রায় সন্ধ্যা। আন্টি আরো ভয় পাচ্ছিলেন এই সন্ধ্যার অন্ধকারে তার পুত্র ঠিকঠাক মত গাড়ি ড্রাইভ করতে পারবে কিনা। উবাইদ ভাই বারবার আন্টিকে অভয় দিচ্ছিলেন। তার ড্রাইভিং এর প্রশংসা করতেই হয়। যেভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে পাহাড়ি  রাস্তাগুলোর মোড় নিচ্ছিলেন, যেন অলিম্পিকের গোল্ড মেডেল জেতা কোনো কার রেসার।

পথেই মাগরিবের আজান হওয়ায় আমরা এক মসজিদের সামনে গাড়ি থামিয়ে নামাজ পড়তে গেলাম। নামাজ শেষে স্থানীয় এক লোক এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আপ কাঁহা সে হো? আমি উবাইদ ভাইকে দেখিয়ে দিয়ে বললাম মে উনকা মেহমান হু, বাংলাদেশ স্যা আয়া হু কাশ্মীর ঘুমনে ক্যা লিয়ে। লোকটি আমার কথা শুনে যে আন্তরিকতা দেখালেন সে মুহুর্তটি আজীবন মনে রাখার মত। তিনি আমাকে বল্লেন, আপ ইসকা মেহমান হো সামঝো আপ পুরা কাশ্মির কা মেহমান হো। তিনি  আমাদের বারবার চা নাস্তা করার জন্য পীড়াপীড়ি করলেন। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আমরা আর দেরি করলাম না। বেশি রাত হলে নাকি রাস্তায় আর্মিদের হয়রানির শিকার হতে হয়।

খুব অল্প সময় নিয়ে এবার কাশ্মীর এসেছিলাম। ফিরতি ট্রেনের টিকেটও কাটা হয়ে গেছে। উবাইদ ভাই বারবার আফসোস করে বলছিলেন, এতো দূর থেকে এসে মাত্র অল্প কদিন ঘুরেই চলে যাবে এটা কেমন কথা! টিকেট ক্যান্সেল করে দাও। আমি আবার তোমার টিকেট করে দিবো। কিন্তু বাসা থেকে বারবার ফেরার তাগিদ দেয়ায় সেটা আর সম্ভব হলো না। তাকে বললাম, এবার অল্প সময়েই যা দেখতে পারি দেখবো। পরেরবার বেশি সময় নিয়ে আসবো। কাশ্মীর ভুস্বর্গে এটাই তো শেষ আসা নয় ইনশাআল্লাহ।

উবাইদ ভাইরা বর্তমানে যেখানে থাকেন সেটি একটি ভাড়া বাসা। তাদের নিজেদের   বাড়ির নির্মাণ কাজ চলায় কয়েক মাসের জন্য এই বাড়িতে ভাড়া থাকছেন। সন্ধ্যা  বেলা ফেরার পথে আন্টি উবাইদ ভাইকে বললেন, আমাকে যেন তাদের নতুন বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখায়। ঘরে ফেরার আগে আমরা তাদের নির্মানাধীন বাড়িটি দেখতে গেলাম।  আন্টি কি আগ্রহ নিয়ে আমাকে তাদের ঘরগুলো ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন! তিনটি বড় বড় বেডরুম দুইটি বাথরুম আর বড় একটি কিচেনের অসাধারণ একটি বাড়ি। সামনে পেছনে বিশাল খালি জায়গা। বাড়ি হওয়ার পর সেখানে কেমন বাগান হবে, কী কী গাছ লাগাবেন সবকিছু আগে থেকে ভেবে রেখেছেন তিনি। আমাকে অবুঝ শিশুর মত পুরো বাড়ি ঘুরে দেখাতে লাগলেন। আমিও খুব মুগ্ধতা নিয়ে তাদের বাড়িটি দেখছিলাম। নিজেদের একটি বাড়ি নিয়ে সবারই কতরকম স্বপ্ন থাকে। সে মুহুর্তে নিজের মায়ের কথা মনে পরে গেলো।

উবায়েদ ভাইদের ভাড়া বাসা ও তাদের সুজকি অলটো গাড়ি

তাদের বাড়ি দেখে ঘরে ফিরতে ফিরতে ঘড়িতে প্রায় রাত দশটা। বাইরে প্রচণ্ড শীত। ঘরে এসে ফ্রেশ হয়েই কম্বলের নিচে ঢুকে গেলাম। কাশ্মিরিদের ঘরের আসবাবপত্র দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারি না। বেডরুমে অতিরিক্ত কোনো ফার্নিচার নেই। পুরো রুম জুড়ে মোটা কার্পেট বেছানো। রুমের কোণায় কোণায় কালারফুল কোষন রাখা। দেখতে খুব আকর্ষণীয় লাগে। শোয়ার জন্য তারা খাট ব্যাবহার করে না। ঘুমের সময় ফ্লোরে তোষক বিছিয়ে ঘুমায়, আবার সকালে ভাজ করে এক কোণায় রেখে দেয়।

কিছুক্ষণ পর উবাইদ ভাই এসে জিজ্ঞেস করলেন ক্রিকেট দেখা হয়? ধর্মশালায় ম্যাচ দেখে আসার কথা তাকে বলা হয়নি। ভেবেছিলাম তিনি কী না কী মনে করেন। এখন  দেখি তিনি নিজেই ক্রিকেটের অনেক বড় ভক্ত। আমাকে বললেন এবারে আহমেদাবাদে ভারত পাকিস্তানের ম্যাচ দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো। সাথি-সঙ্গী  পাইনি বলে আর টিকেট কাটা হলো না। ক্রিকেট বিষয়ক গল্প করতে করতে তার থেকে অনেক ইন্টারেসটিং বিষয় জানতে পারলাম। তিনি বলতে লাগলেন, তুমি কি জানো? কাশ্মিরে প্রায় সব মানুষ ক্রিকেটে পাকিস্তানকে সাপোর্ট করে! পাকিস্তান যখন কোনো ম্যাচ জিতে তখন এদিকে ঘরে ঘরে পাটাকা ফোটানো হয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কি আপনারা চান পুরো কাশ্মির পাকিস্তানের অংশ হয়ে যাক? উবাইদ ভাই বললেন, দেখো আমরা চাই কাশ্মীর কাশ্মিরই থাকুক। আমরা ভারতেরও অংশ হতে চাই না, পাকিস্তানেরও না। এখন আমরা যেমন ভারতের কাছে গোলামের মত আছি পাকিস্তানের অংশ হলে তারাও আমাদের গোলাম বানিয়ে রাখবে। আমরা চাই আজাদি।

আমরা চাই কাশ্মীর কাশ্মিরই থাকুক। আমরা ভারতেরও অংশ হতে চাই না, পাকিস্তানেরও না। এখন আমরা যেমন ভারতের কাছে গোলামের মত আছি, পাকিস্তানের অংশ হলে তারাও আমাদের গোলাম বানিয়ে রাখবে। আমরা চাই আজাদি।

আমাদের কোনোকিছুর অভাব নেই। দুই হাজার ষোলো সালের দিকে এক সময় কাশ্মিরের অবস্থা খুব ভয়াবহ ছিলো। ইন্ডিয়ান সরকার পুরো কাশ্মিরে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন। প্রায় নয় মাস ধরে এই লকডাউন চলে। তখনও আলহামদুলিল্লাহ কাশ্মিরের কোনো মানুষ না খেয়ে মারা যায়নি। কারন কাশ্মিরে যে পরিমাণ খাবার উৎপাদন হয়, আমাদের আর বাইরে থেকে খাবার আমদানি করা লাগে না। বরং আমরা প্রতি বছর বিভিন্ন জায়গায় খাদ্য রপ্তানি করি। আর প্রতিবছর কাশ্মিরের পর্যটন খাত থেকে শতশত কোটি টাকা আয় করে নেয় ইন্ডিয়ান সরকার। তাইতো কাশ্মীর নিয়ে সবার এতো কাড়াকাড়ি। সবাই যার যার স্বার্থের কারনে কাশ্মীর চায়। কিন্তু আমরা কী চাই সেটা নিয়ে কারো মাথাব্যাথা নেই। কাশ্মিরের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে আরো অনেক সময় ধরে আলোচনা হলো। জানা অজানা অনেক তথ্য জানতে পারলাম উবাইদ ভাইয়ের কাছ থেকে।

প্রসঙ্গ পাল্টে আমি আবার ক্রিকেটে ফিরে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম তাহলে ক্রিকেটে আপনাদের পাকিস্তানকে সাপোর্ট করার কারণ কী? তিনি বললেন, তারা আমাদের মুসলিম ভাই। সে হিসেবে অনেকে সাপোর্ট করে। পাকিস্তান বর্ডারও আমাদের খুব কাছে। তাদের চলাফেরা, আচার আচরণ আমাদের সাথে খুব মিলে। আর বর্তমান ইন্ডিয়ান সরকারের জুলুম নির্যাতনও এর একটা কারন হতে পারে। উবাইদ ভাই টপিক চেঞ্জ করে বললেন এক সময় আমিও খুব ভাল ক্রিকেট খেলতাম। আমাকে বিভিন্ন জায়গায় হায়ার করে নেয়া হতো। আমি পেস বোলিং এর পাশাপাশি ওপেনিং ব্যাটিংও করতাম। কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে খেলাধুলা সব ছেড়ে দিতে হলো।

তবে ক্রিকেটের প্রতি এখনো তার অগাধ ভালবাসা দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, আমি এখন ক্রিকেট ম্যাচ তেমন একটা দেখি না। কিন্তু কে জিতে কে হারে সেসব খবর নিয়মিত ঠিকই রাখি। তোমাদের সাকিব আল হাসান আমার খুব প্রিয় খেলোয়াড়। যেমন ব্যাটিং করেন তেমনই বোলিং। কিন্তু তোমাদের জন্য বড় আফসোস হয়। আজ পর্যন্ত কোনো আইসিসি ট্রফি জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ত্রিশ বছর যাবত ক্রিকেট খেলে একটা এশিয়া কাপ পর্যন্ত জিততে না পারা সত্যিই বেশ হতাশাজনক।

তোমাদের সাকিব আল হাসান আমার খুব প্রিয় খেলোয়াড়। যেমন ব্যাটিং করেন তেমনই বোলিং। কিন্তু তোমাদের জন্য বড় আফসোস হয়। আজ পর্যন্ত কোনো আইসিসি ট্রফি জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ত্রিশ বছর যাবত ক্রিকেট খেলে একটা এশিয়া কাপ পর্যন্ত জিততে না পারা সত্যিই বেশ হতাশাজনক।

একবার তো পাকিস্তানের সাথে জেতার একদম কাছাকাছি যেয়ে হেরে গেলো। তার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আসলেই তো! এতো বছর ধরে ক্রিকেট খেলে আমরা কী অর্জন করলাম? ক্রিকেট নিয়ে আমাদের এতো আবেগ! অথচ ক্রিকেটারদের কাছে এই আবেগের কোনো মূল্য নেই। দিনের পর দিন খারাপ খেলে যাচ্ছে, কোনো জবাবদিহিতা নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই হৃদয়টা ছেয়ে গেলো বিষন্নতায়। পরক্ষণেই উবাইদ ভাইয়ের বাবা নাস্তা নিয়ে এসে আমাদের সাথে গল্পে যোগ দিলেন। কাশ্মিরি রুটি আর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সেদিন পাকিস্তান আর শ্রিলংকার মধ্যকার জমজমাট ম্যাচ উপভোগ করছিলাম আমরা। মুহাম্মাদ রিজওয়ানের অসাধারণ এক ইনিংসে পাকিস্তান সেদিন তিনশো পয়তাল্লিশ রান চেজ করে জিতে যায়।

চলবে..

লেখক, শিক্ষার্থী ও পরিব্রাজক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *