ভূস্বর্গ কাশ্মীরের পথে-প্রান্তরে, পর্ব-৩

ভূস্বর্গ কাশ্মীরের পথে-প্রান্তরে, পর্ব-৩

  • তাহসিন ইসলাম

গত পর্বের পর

পরদিন সকাল সকালে নাস্তা সেরে আমরা বের হয়ে গেলাম কাশ্মিরের প্রসিদ্ধ জায়গা ‘দুধপাত্রি’র উদ্দেশ্যে। উবাইদ ভাই  জানালেন, গত তিন মাসে এখানে নাকি প্রায় নয় কোটি পর্যটক ভিজিট করেছেন। শুনে সেখানে যাওয়ার আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো। প্রথমে আমরা যাবো কাশ্মিরের রাজধানী শ্রিনগরে, সেখান থেকে ছোট ভাই ইয়ামিন এবং তাদের নানুকে সাথে করে নিয়ে আমরা যাবো দুধপাত্রির দিকে৷ জায়গাটা বেশ নয়ানাভিরাম তাই আন্টি ভাবলেন এতো সুন্দর জায়গায় যেহেতু যাচ্ছি ছোট ছেলে আর মাকেও সাথে করে নিয়ে যাই।

শ্রিনগর যেতে যেতে দুপুর প্রায় বারোটা বেজে গেলো। এর মধ্যে কয়েক জায়গায় থামলাম আমরা। এক জায়গায় থেমে  কাশ্মিরের ভুট্টা খেলাম। জিনিসটা বেশ মজার ছিলো। শ্রিনগর পৌঁছে উবাইদ ভাই এক রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন। এসে  জানতে পারলাম এটা নাকি তার খালুর রেস্টুরেন্ট। তার খালুর সাথেও সাক্ষাত হলো। উবাইদ ভাই বল্লেন আমরা দুপুরের  খাবার এখানে খেয়ে তারপর গন্তব্যের দিকে যাবো। একটু পর ছোট ভাই ইয়ামিন এবং তার নানি চলে এলেন। দুপুরে  জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হলো। আমার জন্য এখানকার বিখ্যাত দুম্বার কাবাব এবং ফ্রাইড রাইস আনা হলো। সাথে চিকেন বিরিয়ানিও ছিলো। এর আগে কখনো দুম্বার মাংস খাইনি। সেদিনই প্রথম খেলাম। যদিও আমার কাছে স্বাদটা তেমন আহামরি লাগেনি। তবে তারা সবাই খুব তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছিলো।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা চললাম দুধপাত্রির উদ্দেশ্যে। এবার ড্রাইভিং করছে ছোট ভাই ইয়ামিন। তার পাশের সিটে   বসা আমি। সে বড় ভাইয়ের চাইতে পাকা ড্রাইভার। তার সাথেও খুব অল্প সময়ে খাতির জমিয়ে ফেললাম। সে এবার ক্লাস টেনে পড়ছে। বয়সে আমার থেকে ছোট হবে। সে আমাকে জানালো কাশ্মিরে পড়াশোনা শেষ করে বাংলাদেশে এম্বিবিএস করার ইচ্ছা আছে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে পড়াশোনার খরচ কম হওয়ায় এখান থেকে নাকি অনেক মানুষ এম্বিবিএস করতে বাংলাদেশে পারি জমায়। এই ব্যাপারটা আমার জানা ছিলো না। পরে জানতে পারলাম বাংলাদেশের বড় বড় পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে নাকি কাশ্মিরিদের জন্য আলাদা কিছু কোটা বরাদ্দ থাকে। বাংলাদেশ নিয়ে তার সাথে আরো অনেক গল্প হলো। পেছনের সিটে উবাইদ ভাই, তার মা আর নানু বসেছেন। অনেক দিন পর প্রিয় নানুকে কাছে পেয়ে আড্ডায় মেতে উঠলেন তারাও। কাশ্মিরের আঞ্চলিক ভাষায় দখলদারিত্ব না থাকায় আড্ডার বিষয়বস্তু ধরতে পারছিলাম না। কিন্তু তাদের উৎফুল্লতা টের পাচ্ছিলাম ঠিকই। অনেক দিন পর আমরা নানু বাড়ি গেলে যেমন নানুর সাথে আড্ডা জুড়ে দেই ঠিক সেরকম অনুভূতি।

গন্তব্যে পৌঁছার কিছুদুর আগে আমরা এক আপেল বাগানের সামনে থামলাম। ইয়ামিন বলল, তার এক বন্ধুর বাসা নাকি   এখানে। তাকে আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। তার বাসা এদিকে হওয়ায় এখানকার সব তার জানাশোনা আছে। তাই আমাদের জন্য ঘুরতে সুবিধা হবে। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। চোখের সামনে সুবিশাল আপেল বাগান। ডালে ডালে ঝুলছে রক্তলাল রসালো আপেল। উবাইদ ভাইকে আগেই জানিয়েছিলাম এর আগে কখনো গাছ থেকে আপেল পেরে খাইনি।  আমাকে যেন কোনো আপেল বাগানে নিয়ে যাওয়া হয়। উবাইদ ভাই বললেন, এখানে তোমার আপেল খাওয়ার স্বাধ মিটিয়ে নাও। যত ইচ্ছা আপেল পেরে খাও। কোনো বাধা নেই। একটু পর ইয়ামিনও আসলো। আমাকে বলল তোমার ফোনটা দাও   আমি তোমাকে ছবি তুলে দেই। জীবনে বহুবার আপেল খেয়েছি কিন্তু সেদিন জীবনে প্রথম গাছ থেকে আপেল ছিঁড়ে খেলাম, সে এক অন্যরকম ভাল লাগা!

গাছ থেকে আপেল পারার মুহুর্তে

উবাইদ ভাই বললেন, তোমার যেমন গাছ থেকে আপেল পেরে খাওয়ার শখ আমাদেরও গাছ থেকে আম পেরে খাওয়ার খুব শখ। এদিকের মানুষ আম খুব পছন্দ করে। কিন্তু এদিকে আম সবচে কম পাওয়া যায়। আর যখন পাওয়া যায় তখন খুব চওড়া মূল্যে বিক্রি হয়৷ সবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্য থাকে না। ইয়ামিন মজা করে বলল, পরেরবার যখন আবার কাশ্মির আসবে বাংলাদেশ থেকে আমাদের জন্য আম নিয়ে এসো। শুনেছি ওদিকে নাকি আম খুব সস্তায় পাওয়া যায়। আমি বললাম, আমি যেমন তোমাদের কাশ্মিরে এসে নিজ হাতে আপেল পেরে খেলাম, তোমাদেরও দাওয়াত রইলো বাংলাদেশে এসে নিজ  হাতে আম পেরে খাওয়ার। আমাদের রাজশাহীর আম খেলে সারাজীবন সে আমের স্বাদ মুখে লেগে থাকবে।

আপেল বাগানে আমরা তিনজন ( বাঁ থেকে- আমি, উবাইদ ভাই ও ইয়ামিন)

গন্তব্যে পৌঁছাতে দুপুর প্রায় সাড়ে তিনটা বেজে গেলো। অনেক্ষন গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে বিরক্তি এসে গিয়েছিলো। ইয়ামিনের বন্ধু ফিরোজ আমাকে বলল, তোমার ফোনের ক্যামেরা অন করো৷ এখন আমরা দুধপাত্রি এলাকায় ঢুকে গেছি। এখানকার রাস্তাগুলো অসাধারণ। তোমার ভাল লাগবে। আমি ক্যামেরা অন করলাম। একটু পরেই তার কথার সত্যতা  প্রমাণিত হলো। আমার সামনে প্রতিভাত হলো নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক অনাবিল ভূ-চ্ছবি। আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে আমরা   সামনে এগোচ্ছি। রাস্তার দুই পাশে বিস্তৃত সবুজ মাঠ। ঘাসগুলো সব সমান্তরাল হওয়ায় দেখতে আরো আকর্ষণীয় লাগছিলো। মাঠের মধ্যে কিছু ঘোরা ঘাস খাচ্ছে। এর কিছুদুরেই বরফের টুপি পরে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল পাহাড়গুলো। এখনো পুরোপুরি বরফ পরতে শুরু করেনি। কিছুদিন পরেই বরফে পুরো পাহাড় ঢেকে যাবে। ফিরোজ জানালো এখানে নাকি বিভিন্ন সময় বলিউড চলচ্চিত্রের শুটিং হতে দেখা যায়। আমাদের গাড়ি পাহাড়ি রাস্তা ধরে উপরে উঠতে লাগলো। যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। যেন আমরা পৃথিবির একদম শেষ প্রান্তে চলে এসেছি।

‘আকাশ ছডায়ে আছে নীল হ’য়ে আকাশে-আকাশে’

গাড়ি থেকে নামলাম। রাস্তার পাশেই কিছু পিকনিক স্পট দেখতে পেলাম। ঘাশের উপর অনেকখানি জায়গা জুড়ে রঙিন চাদর বেছানো। এর পাশে চুলায় তৈরি হচ্ছে কাশ্মিরি রুটি আর গাহওয়া। উবাইদ ভাই বললেন, কাশ্মিরের সবচে প্রসিদ্ধ জিনিস  হচ্ছে গাহওয়া। এই জিনিস টেস্ট না করলে তোমার কাশ্মিরে আসাই বৃথা। গাহওয়া অনেকটা চায়ের মতই। কিন্তু এর  ফ্লেভারটা একটু আলাদা। এর মধ্যে তারা বিভিন্ন পদের বাদাম ছিটিয়ে জিনিসটাকে আরো অনন্য করে তোলা হয়।

বিকেলের রোদে গাহওয়া খাওয়ার মুহুর্তে

নাস্তার  পর্ব শেষ করে আমরা সামনে এগোচ্ছি। এখন অফ সিজন থাকায় ট্যুরিস্ট খুব একটা নেই। কোনো কলেজ থেকে একঝাঁক তরুণ তরুণী এসেছে পিকনিকে। তারাই পুরো এরিয়া দখল করে রেখেছে বলতে গেলে। সামনে এগোতেই দেখা গেলো    পাহাড়ের বুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঝর্ণার জলধারা। বয়ে যাচ্ছে বড় বড় পাথরের মাঝখান দিয়ে। কিছু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে সারিসারি পাইন গাছ। ইয়ামিন বলল, পাহাড়ের উপর থেকে নাকি আরো সুন্দর ভিউ পাওয়া যাবে। আমরা তিনজন মিলে তিনটি ঘোরা ভাড়া করে ফেললাম। প্রায় আধাঘণ্টা ঘোরায় চড়ে আমরা উঠে গেলাম পাহাড়ের একদম চুড়ায়।

‘ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে; ফিরে এসো হৃদয়ে আমার’

 

 

ঘোড়ার পিঠে পাহাড়ের পানে

ক্রমশ..

 

লেখক, শিক্ষার্থী ও পরিব্রাজক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *