ভূস্বর্গ কাশ্মীরের পথে-প্রান্তরে

ভূস্বর্গ কাশ্মীরের পথে-প্রান্তরে

  • তাহসিন ইসলাম 

“কাশ্মীরকে যদি তুমি চিনতে চাও—পাহাড়, বরফ ও প্রকৃতির বহুবর্ণিল স্বপ্ন থেকে তোমায় বেরিয়ে আসতে হবে। ঝিলাম ও লীডার নদী তোমায় বারবার ডাকবে। মুঘলদের তৈরি অপূর্ব বাগিচাগুলো তোমায় চুম্বকের মত টেনে নিয়ে যাবে। গুলমার্গ থেকে তুমি দেখতে পাবে হিমালয়ের মহত্ত্ব; পেহেলগামে দেখবে প্রকৃতির অসাধারণ লীলা-বৈচিত্র্য; নাগিন ডাল লেকের শিকারাগুলোকে তোমার কাছে মনে হবে জান্নাতের কিশতি; আর কাশ্মীরের মাটি ও বাতাস তো তোমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবেই । কিন্তু তারপরও তুমি যদি আসল কাশ্মীরকে জানতে চাও, তাহলে তোমাকে যেতে হবে মাটির আরও গভীরে । এবং যদি তোমার সেই আকাঙ্ক্ষা থাকে”— লাইনগুলো পড়েছিলাম বুলবুল সারোয়ারের ‘ঝিলাম নদীর দেশে’ বইতে। সেই থেকে মনের মধ্যে আকাঙ্খা জেগেছিলো কাশ্মির ঘুরার পাশাপাশি তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে ভালভাবে চেনার, জানার। কাশ্মিরের অপরূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা আমরা নানান বইতে বহুবার পড়েছি কিন্তু আমরা কি জানি এর পেছনের গভীর গোপন বেদনার ইতিহাস? যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা তাদের ভেতরের চাপা কষ্ট আর অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার বোবা আর্তনাদ! ঘুরাঘুরির পাশাপাশি সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এবার বেরিয়ে পরলাম কাশ্মিরের উদ্দেশ্যে।

কলকাতা থেকে সাতাল্লিশ ঘণ্টার রেলভ্রমনের পর রাত একটায় ট্রেন থামে জাম্মু স্টেশনে। এর আগে অবশ্য একদিনের লম্বা ব্রেক নিয়েছিলাম ধর্মশালায়। বিশ্বকাপে নিজ দেশের প্রথম ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম হিমাচাল প্রদেশ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। এবারে ভারত প্রবেশ করার এটিও অন্যতম একটি কারন। অনলাইনে টিকেট কেঁটে রেখেছিলাম মাসখানেক আগে। মিরপুরে বসে জীবনে অনেক ম্যাচ উপভোগ করেছি কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতা একেরারেই নতুন। লাইফে প্রথমবার বিদেশের মাটিতে খেলা দেখতে এসেছি। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। সব ধরনের ফর্মালিটিজ শেষ করে যখন মাঠে প্রবেশ করলাম মুখ দিয়ে সর্বপ্রথম একটা বাক্যই বের হলো, ওয়াও!! আমি হা করে কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। রংবেরঙের প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানো গ্যালারি। স্টেডিয়াম থেকে দেখা যাচ্ছে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সারিসারি বিশাল পাহাড়গুলো। যেন চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে স্টেডিয়ামটাকে। আকাশে মেঘের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। স্বচ্ছ ঝকঝকে নীল। শীতল আবহাওয়া। কড়া রোদের মাঝেও গরম তেমন একটা গায়ে লাগছে না

নিঃসন্দেহে এবারে বিশ্বকাপের সবচে সুন্দর স্টেডিয়াম এটি। কিন্তু বিপদে পরলাম খাবার অর্ডার দিতে গিয়ে। এক গ্লাস ঠান্ডা পানির দাম বিশ রুপি! অন্যান্য খাবারও কয়েক গুন বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অবশ্য এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সব স্টেডিয়ামেই এমন সিন্ডিকেটের সুব্যবস্থা আছে। এর আগেও মিরপুর স্টেডিয়ামে তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিলাম। সারাদিন পানি আর কোক খেয়েই কাটিয়ে দিলাম। আসলে টাইগাররা সেদিন এতো ভাল খেলছিলো, খাওয়া দাওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম একেবারে।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে বিশাল জয় নিয়ে সন্ধ্যায় আবার কাশ্মিরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। এতো টায়ার্ড লাগছিলো! ট্রেনে উঠেই গাঁ এলিয়ে দিলাম স্লিপার কোচের শক্ত বেডে। জাম্মু পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় মধ্য রাত। স্টেশনে নেমে দেখি ক্ষুধায় চোখে অন্ধকার দেখছি। চটজলদি হালকা খেয়ে নিলাম।

আমার কাছে ইন্ডিয়া ট্যুরের সবচে কষ্টদায়ক ব্যাপার হলো খাবারের কষ্ট। অরুচিকর আর ‘অখাদ্য’ খাওয়ার দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। শুরুতে যুক্ত হয়েছিলাম বাংলাদেশি এক গ্রুপের সাথে। কথা ছিল কাশ্মির এসে তাদের সাথে যোগ হওয়ার। কিন্তু পরে কোন এক কারনে তাদের থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। এই ভ্রমণের সবচে বড় প্রাপ্তি ছিল কাশ্মিরি এক পরিবারের সাথে তিন দিন থাকার অভিজ্ঞতা। কত কত গল্প জমা হলো এ কয়দিনে। ভাবলাম কাঁচা হাতের লেখায় সে গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা যাক।

‘পৃথিবীর পথে পথে ঘুরতে চাওয়া মানুষ ঘরে ফিরে এসে গল্প বলতে চায়, সিনেমা বানাতে চায়।’— কথাটার সাথে শতভাগ সহমত।

উবাইদ ভাইয়ের সাথে পরিচয় দেওবন্দের এক বন্ধুর মাধ্যমে। গতবার দিল্লি গিয়ে সেই বন্ধুর দেখা পেয়েছিলাম। কাশ্মিরে যাওয়ার ইচ্ছার কথা যখন তাকে জানালাম সে বলল, আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে কাশ্মিরের। একসাথে দেওবন্দে পড়েছি। প্রায়ই আমাকে যেতে বলে। তুমি চাইলে তার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেই, সে তোমাকে সাহায্য করতে পারে। আমি ভাবলাম তিন চার দিনের জন্য যেহেতু যাচ্ছি। অন্য কাউকে বিরক্ত করার কী দরকার? আমি নিজে নিজেই যতটুকু পারি ঘুরে দেখবো।

কিন্তু জাম্মু রেলস্টেশনে নামতেই নিঃসঙ্গতা পুরোপুরি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। হিন্দিতে মোটামুটি ‘পিএইচডি’ থাকায় ট্রেনে সেই একাকিত্ব টের পাওয়া যায়নি। সহযাত্রীদের সাথে গল্প আড্ডা দিতে দিতে সময় কেটে গিয়েছে। কিন্তু ট্রেন থেকে নামার পর নিজেকে বড় একা মনে হতে লাগলো।

শেষমেশ দেওবন্দের বন্ধু তানজিম ভাইয়ের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে উবাইদ ভাইকে ফোন দিলাম। উবাইদ ভাইও এক সময় দেওবন্দে পড়তেন। কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় দেওবন্দে আর পড়াশোনা শেষ করতে পারননি। কি এক জটিল রোগের ফাঁদে পরে এক সময় তার দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে যায়। এরপর তার মায়ের একটি কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হয় তার শরিরে। এখন মা ছেলে উভয়ে একটি কিডনি নিয়ে বেঁচে আছেন। গত তিন দিন কাশ্মিরে এই পরিবারের সাথে ছিলাম। বাব-মা আর দুই ভাইয়ের ছোট্ট সংসার। আমার দেখা অমায়িক একটি ফ্যামিলি এটি। বাবা সরকারি চাকরি করেন। ছোট ভাই ইয়ামিন শ্রীনগর তার নানু বাড়ি থেকে এক স্কুলে পড়াশোনা করছে আর উবাইদ ভাই কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হওয়ার পর থেকে ঘরেই অনলাইনের মাধ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রথম যেদিন তাদের বাড়িতে উঠি, কিছুটা সংশয় কাজ করছিলো এরকম হুটহাট অপরিচিত একজনের বাড়িতে ওঠা ঠিক হলো কিনা। কিন্তু যতই সময় গড়াচ্ছিলো মনে হচ্ছিল যেন আমি কোনো ঘনিষ্ঠ আত্নীয়র বাড়ি বেড়াতে এসেছি। কাশ্মিরিদের আতিথেয়তার অনেক খ্যাতি রয়েছে এবার তা নিজ চোখে দেখে এলাম। এ কয়দিনে ট্রেনের স্বাদহীন অখাদ্য খেয়ে খেয়ে অবসাদ চলে এসেছিলো, আল্লাহ সেই যন্ত্রণা থেকেও রেহাই দিলেন।

কাশ্মির ঘুরিয়ে দেখানোর সব দায়িত্বও উবাইদ ভাই নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। আমার কিছুটা অস্বস্তি লাগছিলো। এমনিতেই তিনি অসুস্থ মানুষ, তার উপর আমি আবার উড়ে এসে জুড়ে বসে উটকো ঝামেলা পাকালাম। কিন্তু তার আন্তরিকতা দেখে আমি আর না করতে পারলাম না। তিনি জানালেন, তোমার মত আমারও ঘুর‍তে ভালো লাগে। কিন্তু সময় সুযোগ না হওয়ার কারনে তেমন একটা বের হই না। তোমার কল্যাণে আমারও একটু ঘুরাঘুরি হলো।

 

(চলবে..)

লেখক, শিক্ষার্থী ও পরিব্রাজক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *