ভোলার গ্যাস বিশেষ ট্রাকে করে শিল্পে সরবরাহ শুরু

ভোলার গ্যাস বিশেষ ট্রাকে করে শিল্পে সরবরাহ শুরু

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রাকৃতিক গ্যাস সংকোচন বা সিএনজিতে (কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস) রূপান্তর করে তা শিল্প প্রতিষ্টানে সরবরাহ শুরু হলো। দক্ষিণের দ্বীপ জেলা ভোলার গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলন করা এই গ্যাস বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংকোচনের মাধ্যমে সিলিন্ডারে ভরে বিশেষ ট্রাকে করে বৃহস্পতিবার (২০ ডিসেম্বর) থেকে বস্ত্র খাতের একটি কারখানায় সরবরাহ করা হয় আনুষ্টানিকভাবে।

পর্যায়ক্রমে সীমিত পরিসরে অন্যান্য কারখানাতেও সরবরাহ করা হবে এই গ্যাস। এই গ্যাসের প্রতি ঘনমিটারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৭ টাকা ৬০ পয়সা। আর পাইপলাইন থেকে এখন সরাসরি শিল্প গ্যাস পাচ্ছে ৩০ টাকায়। ৩ হাজার পিএসআই চাপে প্রতি সিলিন্ডারে গ্যাস আসবে ৩৫০০ ঘনমিটার।

বৃহস্পতিবার (২০ ডিসেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে সিলিন্ডারে ভরে সিএনজি আকারে এই গ্যাস সরবরাহের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, দেশের ইতিহাসে এভাবে গ্যাস সরবরাহের এটি প্রথম ঘটনা। সিলিন্ডারের পাশাপাশি ভোলার গ্যাস বাইরে আনতে বরিশালের সঙ্গে একটি পাইপলাইন করা হবে। এরপর তা খুলনার শিল্পাঞ্চলে সরবরাহ করা হবে। উত্তরাঞ্চলের রংপুরে পাইপলাইন হয়েছে আমরা সেখানেও শিল্পে গ্যাস দিতে পারব। গ্যাস সরবরাহের চিন্তা আছে। রংপুর পর্যন্ত ইতোমধ্যে গ্যাস পাইপলাইন চলে গেছে।

দাম বেশি প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এত বেশি চাহিদা এখন আর সেই প্রশ্ন কেউ করছে না। ভোলা-বরিশাল পাইপলাইন করতে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা লাগবে। পাইপলাইনের টাকা সরকার দেয় তাই কেউ সেটি হিসাব করে না। জমির দাম পাইপের দাম কেউ বিবেচনায় নেয় না। শুধু গ্যাসের দাম হিসেব করা হয়। পাইপের দাম বিবেচনা করলে এই দাম খুব বেশি না।

উদ্বোধনী অনুষ্টানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. নুরুল আলম বলেন, দিনে এখন ৫০ লাখ ঘনফুট সরবরাহ করা হবে। ভোলার গ্যাস কেবল শুরু, আরও বাড়াতে হবে। এলএনজি যেমন বড় জাহাজে আসে তেমনি আনতে হবে। শিল্পের বিকাশ জরুরি, এ জন্য সম্পদ মাটির নিচে না রেখে যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তাই আরও বেশি কূপ খনন করে দেশে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা জোরদার করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘এলএনজি আমদানি করছি অনেক বেশি দামে। আমদানিটাকে কমাতে পারি তাহলে সাশ্রয় হয়। সিলেটে তেল পেয়েছি, সেটাও ফেলে রাখবো না, সিলেটে আরও তেল পাওয়া যাবে।’

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘আমাদের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। আর সরবরাহ হচ্ছে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে। চাহিদা মেটাতে নানা উপায়ে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে। নতুন নতুন কূপ খনন করে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। এলএনজি আমদানি বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে গ্যাস আনার চিন্তা করা হচ্ছে। এলএনজি আমদানি বাড়াতে আরও দুটি এলএনজি টার্মিনাল চালু হবে।’

‘আমদানির বাইরে দেশের মধ্যে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। ৪৬টি কূপ খননের যে কাজ চলমান রয়েছে সেটির লক্ষ্য বাড়িয়ে ৪৮ করা হয়েছে। ওই প্রকল্পে ৯টি কূপ খনন করা হয়েছে তাতে ৭টিতে গ্যাস পেয়েছি। এতে করে ১২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে। ২০২৬-২৮ সালের মধ্যে আরও ১২০টি কূপের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছি। আমরা আশা ৭০-৭৫টি কূপের লোকেশন চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। এরমধ্যে কমপক্ষে ৫০-৬০টি কূপ খনন করা হবে। ২০২৬ সালের পূর্বেই সব কাজ শেষ করে ২০১৬ সালে কূপ খনন শুরু করতে চাই,’ যোগ করেন তিনি।

ভোলা থেকে গ্যাস সরবরাহের কাজটি করছে বেসরকারি কোম্পানি ইন্ট্রাকো। প্রতিষ্টানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ আলী বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে আগে থেকেই গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। বর্ষাকাল, বৈরী প্রকৃতিসহ নানা কারণে আনুষ্টানিকভাবে সরবরাহ শুরু করতে একটু দেরি হয়েছে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন পিএলসির চেয়ারম্যান এইচ এম হাকিম আলী।

তিনি বলেন, আমাদের দেশ যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, গাড়ির মধ্যে সিএনজি দেওয়া হলো তখন সমালোচনা হয়েছিল। এখন কিন্তু সেই সিএনজি নিয়ে আর সমালোচনা নেই। এখানেও প্রথমে সমালোচনা হচ্ছে, পরে আর থাকবে না।

ভোলার গ্যাস সিএনজি করে আনতে চলতি বছরের মে মাসে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে ইন্ট্রাকো। চুক্তি সূত্রে জানা গেছে, ইন্ট্রাকো সরকারের কাছ থেকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ১৭ টাকায় কিনে ৪৭ টাকা ৬০ পয়সায় বিক্রি করবে। ভালুকা-গাজীপুরের জ্বালানিসংকটে ভোগা কারখানাগুলো গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। মূলত তিতাস গ্যাস কোম্পানির আওতাধীন গ্রাহকদের মধ্যে এ গ্যাস বিতরণ করা হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোলা থেকে সিএনজি করে আনা গ্যাস পাইপলাইনের গ্যাসের তুলনায় অনেক ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। তাই উচ্চমূল্যের এই গ্যাস শিল্প-কারখানার মালিকরা ব্যবহারে কতটুকু আগ্রহ দেখাবেন, সেটা নিয়ে যেমন চ্যালেঞ্জ রয়েছে তেমনি পরিবহনের ক্ষেত্রেও নানারকম ঝুঁকি রয়েছে।

জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাসের পরিমাণ যথেষ্ট মনে না হলেও, এতে করেও গ্যাস সংকটে থাকা কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠানকে সাময়িক স্বস্তি দেওয়া যাবে। কারণ এই পরিমাণ গ্যাস দিয়ে ক্যাপটিভ জেনারেটরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।

ভয়াবহ গ্যাস সংকটের কারণে জ্বালানি-নির্ভর শিল্পগুলোর ব্যাপক অসন্তোষের ফলেই সরকার ভোলার দুটি গ্যাসক্ষেত্রের উদ্বৃত্ত গ্যাস ব্যবহারের পরিকল্পনা নেয়। এই দুটি গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমমসিএফ) হলেও, উৎপাদন হয় ৮০ থেকে ৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট করে। এ কারণে, ভোলা ও শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের আটটি কূপের প্রায় ১২০ এমএমসিএফ বাড়তি সক্ষমতা অব্যবহৃত রয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, দরকারি পাইপলাইন ও সঞ্চালক অবকাঠামোর অভাবে জ্বালানি সংকটের ভুক্তভোগী শিল্পাঞ্চলে ভোলার উদ্বৃত্ত গ্যাস আনতে পারছে না সরকার।

সূত্র: দেশ রূপান্তর

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *