মওদুদীবাদীরা দেওবন্দী মাদ্রাসাগুলোর প্রতি বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে

মওদুদীবাদীরা দেওবন্দী মাদ্রাসাগুলোর প্রতি বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী

মওদুদীপন্থী সংগঠন এবং তার সমর্থিত কতিপয় আলেম ও ওয়ায়েজগণ কওমী মাদ্রাসার চরম বিরোধী। যুগে যুগে সেগুলোর বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। এমন এমন স্পর্শকাতর ঘটনা তারা ঘটায়েছে, যেগুলো দ্বারা বোঝা যায়, এদেশের দেওবন্দী তথা কওমী মাদ্রাসাগুলো তারা চায় না। বরং এগুলো কীভাবে বন্ধ করে দেওয়া যায় তার নীলনকশা তৈরী করতে থাকে।

এজন্য মওদুদী সমর্থক আলেম, ওয়ায়েজ এবং তাদের সংগঠনের কর্মিদের অন্তরে যেন মহর মারা। মানে ‘চোরে শোনেনা ধর্মের কাহিনী’। যতই ওদেরকে বলা হচ্ছে, হেফজখানার বিরুদ্ধে বিষোদগার বন্ধ করুন, কিন্তু কোনো আওয়াজ তাদের কর্ণকুহুরে পৌছায় না। বরং সংঘবদ্ধভাবে দ্বীনি শিক্ষার বিরুদ্ধে ফেতনা ছড়াচ্ছে। আর যিনি অপরাধ করেছেন, তার পক্ষে আদাজল খেয়ে সাফাই গেয়ে যাচ্ছেন।

ইতিপূর্বে দেশের উম্মুল মাদারিস খ্যাত হাটহাজারী মাদ্রাসাতে তারা হামলা চালায়েছিল। সেই আশির দশকের অত্যন্ত লোমহর্ষক ঘটনা ছিল সেটা। যে ঘটনা সেসময়ে সারাদেশের মানুষ নিন্দা জানিয়েছিল। একটা দেশসেরা দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে নগ্ন হামলা জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছিল তখন। তারা হাটহাজারী মাদ্রাসাতে বিশৃংখলা ঘটিয়ে বন্ধ করার পায়তারা করেছিল। যে ঘৃন্যতম কাজ কোন সচেতন মানুষ মেনে নেয়নি।

হাটহাজারির পর এদেশে বিভিন্ন সময়ে হক্কানী-রব্বানী আলেমদের উপর হামলা করেছে। বহু আলেমকে নিপীড়ন-নির্যাতনের মাধ্যমে পুঙ্গত্বের দ্বার প্রান্তে পৌছে দিয়েছে। এখনো পর্যন্ত বহু আলেম সেই নির্যাতনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। মৃত্যুকাল পর্যন্ত সেই চিহ্ন বয়ে নিয়ে যেতে হবে। মানে এমন নিঠুর অত্যাচার করেছিল তারা, যেটা বর্ননার ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না।

নব্বই দশকে মোজাহেদে আজম মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) এর বড় সাহেবজাদা মাওলানা ওমর সাহেবের উপর মওদুদী সাহেবের অনুসারীগণ হামলা চালায়েছিল। তার প্রতিবাদে বাংলাদেশের আলেমগণ ফুঁসে উঠে ছিলেন। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গাতে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছিল। যেটা অত্যন্ত দুঃখজনক ছিল। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) এর মত জগদ্বিখ্যাত আলেমের সন্তানের উপর হামলে পড়া ছিল বড় ন্যাক্কারজনক ঘটনা।

এমনি খুলনার মাওলানা আলী হোসেন সাহেব (রহ.)। যিনি প্রখ্যাত আলেম এবং ওয়ায়েজ ছিলেন। আবার ছিলেন তিনি মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী শাগরেদ। এই মহান আলেমের উপরও মওদুদীপন্থীরা আক্রমণ চালিয়েছিল। একবার-দুবার নয় বহুবার তাদের হামলার শিকার হন। তাদের নির্মম নির্যাতনে মাওলানা আলী হোসেন সাহেব পুঙ্গত্ববরণ করেন। সেই পুঙ্গ অবস্হায় তিনি বহুবছর যাবত দ্বীনি মাহফিল করতেন। পরিশেষে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।

মওদুদীবাদীদের নির্মম নির্যাতনের শিকার আরেকজন আলেম হলেন মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈফী সাহেব। তিনি এখনো বেঁচে আছেন।তবে মওদুদীবাদীদের হামলার ক্ষতচিহ্ন আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন। জনাব সাঈফী সাহেব একজন সাহসী এবং মুখলেস আলেম। তিনি সবসময় বাতিলের বিরুদ্ধে সোচ্চার। হকপন্হী আলেমদের সাথে তাঁর সবসময় উঠাবসা। সেই মহান ব্যক্তির উপর আশি/বিরাশীবার ওরা হামলা চালিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন করে রাস্তায় ফেলে রেখেছে। সাধারন জনতা রাস্তা থেকে কুড়ায়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। এভাবে বহুবার দেওবন্দী আলেম-উলামা এবং তলাবাদের উপর তাদের নগ্ন হামলা চলেছে। উপর্যুপরি হামলায় অসংখ্য আলেম-উলামা আহত হয়েছেন। কেউ কেউ পুঙ্গত্ববরণ করেছেন।

দেওবন্দী মাদ্রাসা এবং দেওবন্দী আলেম দুটোর সাথেই তাদের দুশমনি। কীভাবে এসকল প্রতিষ্ঠান এবং আলেম ও তলাবাদের কোনঠাসা করা যায় সেই প্রচেষ্টা তাদের। বিগত জোট সরকার যখন ক্ষমতায় তখনতো ক্ষমতার অংশীদারিত্বে ছিল তারা। সেসময়ে দেখেছি বিমাতাসুলভ আচরণ করতে। সেসময়ে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) এবং চরমোনাই এর পীর সৈয়দ ফজলুল করীম (রহ.) সহ আরো ওলামায়ে কেরাম কওমী মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতির জন্য আন্দোলনে নেমেছিল। কিন্তু ওদের বিরোধীতার কারণে সরকার স্বীকৃতি দিতে পারেনি।

যেটা সেসময়ের সকল আলেম সমাজের জানা। তাছাড়া সেসময়ে বহু আলেমদের গ্রেফতার এবং হয়রানি ও নির্যাতনে অতিষ্ট করে তুলেছিল। মোটকথা মওদুদীবাদীদের চরম বিরোধীতা এবং ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিতে হয়েছে দেওবন্দী আলেমদের। নানা ভাবে জুলুম-নির্যাতন সইতে হয়েছে। তারা যে দেওবন্দী আলেমদের বন্ধু নয়, সেটা বারবার প্রমাণ করেছে।

ইদানিং মওদুদীবাদের অনুসারী এক বক্তা যিনি দেশব্যাপি পরিচিতি লাভ করেছেন। তিনি অহেতুক ভাবে হেফজখানাগুলোর নামে নির্জলা মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন। আর সেই সাথে তাকে সাপোর্ট দিচ্ছেন মওদুদী অনুসারী অন্যান্য ওয়ায়েজ ও তাদের সংগঠনের লোকেরা। জনাব আফসারী সাহেব মিথ্যাচার করলেও অন্যরা সেটাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, যেটা ভাবতে কষ্ট হয়। অথচ অন্য সময় দেখা যায়, দেওবন্দী কোনো আলেম মুখ ফসকে কোনো কথা বলে ফেললে সেটা নিয়ে তোলপাড় শুরু করে দেয়, কিন্তু অন্যায় ভাবে দ্বীনি শিক্ষার বিরুদ্ধে লাগামহীন বক্তব্য দিচ্ছেন, সেব্যাপারে কোনো কথা না বলে অন্যায়কে সমর্থন করে যাচ্ছে। এর দ্বারা বোঝা যায়, তারা দেওবন্দী আলেম এবং দ্বীনি শিক্ষার চরম বিরোধী। তারা এদেশে দ্বীনি শিক্ষার প্রসার ঘটুক সেটা চায় না।

আফসারী সাহেব যেসব অভিযোগ করেছেন সবই ভিত্তিহীন। সেগুলো কল্পনা প্রসূত এবং হিংসার বহিঃপ্রকাশ। তিনি অভিযোগ করেছেন-

এক. ছাত্রদের প্রহার করা হয়। কওমী মাদ্রাসার হেফজখানাতে শিশু নির্যাতন করা হয়। আফসারী এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণ হবে। কোথাও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। ওই রকম বিচ্ছিন্ন ঘটনা স্কুলেও হয়ে থাকে। তাহলে কী স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে? বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার উপরে আপত্তি তোলা ঠিক নয়।

দুই. আফসারী অভিযোগ করেছেন কয়টা হাফেজ আলেম হয়েছে? একশো মেডিকেলের ছাত্র এর মধ্যে একশোই ডাক্তার হয়, কিন্তু হাফেজ একশোটা তো একশো আলেম হতে পারে না।

হেফজ পড়া এটা তো মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাথমিক ধাপ। যেমন প্রাইমারী স্কুল। এখন তিনি যদি বলেন, কজন হাফেজ শেষ পর্যন্ত পড়ে দাওরায়ে হাদীস পাশ করে আলেম হয়েছেন? তাহলে আমরা বলতে পারি, প্রাইমারির ছাত্র কয়জন লেখাপড়ার শেষ পর্যন্ত গিয়ে এমএ পাশ বা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে? দেখা যাবে প্রাইমারীর শতকরা নব্বইভাগ ছেলেমেয়ে শিক্ষার শেষ পর্যন্ত পৌছাতে পারেনা। তাহলে কী প্রাইমারির পড়াশুনা বন্ধ করে দিতে হবে? তার তো আগে জেনারেল শিক্ষা নিয়ে কথা বলা দরকার ছিল, কিন্তু সেটা না বলে দ্বীনি শিক্ষার বিরুদ্ধে বিষোদগার করলেন।

তিন. তিনি বলেছেন ছোট ছোট ছাত্রদের তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য রাতে উঠানো হয়। এটা কোন হাদীসে আছে?

দেখুন! রাতে ছোটদের তাহাজ্জুদের ব্যাপারে হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এটা শিশুদের প্রতি অন্যায় নয়। তাছাড়া শিশুদের দিনের বেলায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমের সময় রয়েছে। এসব আমলের মাধ্যমে শিশুদের চরিত্রগঠন এবং আমল আখলাকে তরক্কি হয়ে থাকে।

মোটকথা আফসারী সাহেবের সকল অভিযোগ ভিত্তিহীন। তার আপত্তিগুলো উদ্দেশ্যমূলক। যেখানে অন্যান্য প্রতিষ্টানে ছাত্রদের চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ। যাদের মাঝে আমল-আখলাকের কোনো কিছু নেই। সরকার যাদেরকে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে সহীহ রাস্তায় ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে সেখানে কওমী মাদ্রাসার মতো ইলহামী প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের অনুদানমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার উপরে ভিত্তিহীন প্রশ্ন তোলা দুঃখজনক।

আমরা কেউ শিশু নির্যাতনের পক্ষে নই। বরং কোথাও এধরনের ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। সুতরাং এরপরেও কেউ যদি অভিযোগ তোলে বোঝা যাবে তিনি কওমী মাদ্রাসার কল্যাণকামী নন। আফসারী সাহেবের যদি উদ্দেশ্য সংশোধন হত তাহলে তিনি এখন খামোশ হয়ে যেতেন, কিন্তু খামোশ না হয়ে বরং ইনিয়েবিনিয়ে বারবার অভিযোগ তুলছেন এবং যেটার কোনো সত্যতা নেই সেটা নিয়ে টানা হেঁচড়া।

আসলে গোড়ায়গলদ ওদের। ওলামায়ে হক্কানী-রব্বানী মওদুদী সাহেবের চিন্তাধারার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। কেননা সেটা প্রত্যখ্যাত। তারা গোমরাহীর মধ্যে আছে। আলেমগণ বারবার সতর্ক করছেন। এতদসত্বেও তারা তাদের নীতিতে অনড়। গোমরাহীকে আঁকড়ে ধরে আছে। এজন্য এখন ওদের কানে হক জিনিস পৌছে না। তারা এখন হকের প্রতি বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। আর এ কারণে দ্বীনি শিক্ষার বিরুদ্ধে দুশমনি তাদের।

আল্লাহ তাদের হেদায়েত দান করুন। আমিন।

  • লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *