মদ্যপানে বছরে মারা যায় ২৮ লাখ মানুষ
শাহ আলম বাদশা : অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস-এর গবেষণায় দেখা গেছে, মদ্যপানের ক্ষেত্রে পুরুষের সংখ্যাকে প্রায় ধরে ফেলেছে নারীরা। তাদের মধ্যে মদ্যপানের অভ্যাস দ্রুত বাড়ছে। ২০১৬ সালে বিশ্বজুড়ে পরিচালিত একসমীক্ষায় এ দাবি করা হয়েছে। ১৮৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জন্ম নেওয়া প্রায় চল্লিশ লাখ মানুষের তথ্যবিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখিয়েছিলেন, পুরুষের মধ্যে মদ্যপানের অভ্যাস ছিল বহুগুণ বেশি এবং একারণে মদ্যপানজনিত স্বাস্থ্যসমস্যায় তারাই বেশি ভুক্তভোগী। কিন্তু এর পরবর্তী প্রজন্মে মদ্যপানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের এই ব্যবধান সাংঘাতিকভাবে কমে এসেছে।
গবেষকরা বলছেন, সমাজে নারী-পুরুষের ভূমিকা পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে মদ্যপানের ক্ষেত্রে দুইলিঙ্গের ব্যবধান দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বিংশশতাব্দীর শুরুর দিকে নারীর তুলনায় পুরুষের মদ্যপানের অভ্যাস ছিল দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু এখন মদ্যপানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের এই অনুপাত এক দশমিক এক। অ্যালকোহলের সহজলভ্যতাও এর পেছনে আরেকটি কারণ। যারা অ্যালকোহল বিপণন করছে, তারা ভোক্তা হিসেবে নারী, বিশেষ করে তরুণীদের টার্গেট করছে বেশি।
শুধু তাই নয়, বিশ্বে প্রতি ২০ জনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হচ্ছে মদ্যপানে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার প্রতিবেদন বলছে, শুধু ২০১৬ সালে মদ্যপানের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা মরণব্যাধি ক্যানসারসহ অন্যান্য সংক্রমক রোগের সম্মিলিত মৃতের সংখ্যার থেকে অনেক বেশি। মদ্যপানে গত বছরে যে ২৮ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় এরমধ্যে অন্তত ৭৫ শতাংশই পুরুষ। ২০১৬ সালে মদ্যপানে যে ৩০ লাখ মানুষ মারা গেছে, তাদের মধ্যে ২৮ শতাংশ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে দুর্ঘটনাজনিত কারণে। ২১ শতাংশ মানুষের নিজেদের মধ্য সংঘর্ষে বা নিজেকে নিজে আঘাত করে। ১৯ শতাংশ মানুষের হজমের সমস্যাজনিত কারণে। বাকিদের মৃত্যু ঘটেছে মদ্যপানের ফলে সৃষ্ট শারীরিক ও মানসিক রোগের জন্য। সমগ্র পৃথিবীতে এমন ২৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ আছেন, যারা জানেন না, তাদের কী পরিমাণ মদ্যপান করা নিরাপদ।
২০১৫ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার (ডব্লিউএইচও) জরিপ অনুযায়ী, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মদ্যপানে শীর্ষস্থান দখল করেছিল বিশ্বের সবচেয়ে ধনী শহরের দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। সংবাদমাধ্যম ডেইলি ইনকোয়ারারে প্রকাশিত তথ্যমতে, ডব্লিউএইচও বলেছে, একজন বাংলাদেশি সারাবছরে একবোতলের চেয়েও কম মদ্যপান করেন, যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৫ বছরের বেশি বয়সিরা পান করেন সর্বোচ্চ গড়ে ১০.৯ লিটার মদ। দক্ষিণ কোরিয়ায় ভাত থেকে তৈরি ‘সোজু’ নামের একবিশেষ মদের জনপ্রিয়তাই এর মূলকারণ। মদ্যপানের পরিসংখ্যানে দক্ষিণ কোরিয়ার পর দ্বিতীয়স্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। উদীয়মান অর্থনীতির এই দেশে মদ্যপানের হার বাড়ছে। এশিয়ায় মদ্যপানে তৃতীয়স্থানে রয়েছে থাইল্যান্ড। মদ্যপানে মঙ্গোলিয়া ও চীনের অবস্থান যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম। বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ চীনে চাকরিতে পদোন্নতির জন্য সহকর্মীদের সাথে মদ্যপানের সংস্কৃতি রয়েছে।
২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে মদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও ভয়াবহতা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, বিশ্বে প্রতি তিনজনে একজন অ্যালকোহল বা মদ পান করে। আর মারাত্মক আশঙ্কার বিষয় হলো, অপরিণত বয়সে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টিতে ‘সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ’ হলো মদ্যপান। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ১৯৫টি দেশে মদের ব্যবহার, অসুস্থতা ও মৃত্যুর তথ্যবিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধে গবেষকরা বলেছেন, অ্যালকোহল গ্রহণে কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই।
দেখা গেছে, ডেনমার্কের মানুষ সবচেয়ে বেশি মদ্যপান করে। দেশটির ৯১ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ মদ্যপান করে। সবচেয়ে কমসংখ্যক পুরুষ মদ্যপান করে পাকিস্তানে। দেশটির মাত্র শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ মদ্যপান করে। সবচেয়ে কম মদ্যপানকারী দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশেই মদ্যপানের প্রবণতা যেমন সবচে কম, তেমনই বিশ্বের সবচেয়ে কমসংখ্যক নারীও মদ্যপান করে বাংলাদেশে। শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ নারী মদ্যপান করে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
লেখক : কলামিস্ট ও সমাজ বিশ্লেষক