মধ‍্যবিত্তের গল্প | মহিউদ্দীন খান তানজীম

মধ‍্যবিত্তের গল্প | মহিউদ্দীন খান তানজীম

মধ‍্যবিত্তের গল্প | মহিউদ্দীন খান তানজীম

একটু পরেই ফজরের আজান হবে। ঘুম ভেঙেছে আজানের প্রায় আধঘণ্টা আগে। চারদিকে এখনো অন্ধকার ডানা মেলে আছে। পুরো রুমজুড়ে সুনসান নিরবতা। এ রুমে আমরা যে চৌদ্দজন থাকি, আমি ব্যতীত তাদের সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মাথার উপরে দুইকোণেতে দুইটা ইলেক্ট্রিক পাখা বিরামহীন সেবা দিয়ে যাচ্ছে কারিগরি শিক্ষার্থীদের। সবাই এখানে থেকে থেকে কারিগরি শিখছি। এইচএসসি দেওয়ার পর মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছাত্রদের লড়তে হয় নতুন এক যুদ্ধে। মা-বাবাদের তখন পড়াশুনার জন্য টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনাগ্রহ প্রকাশ পায়। এটা অবশ্য উনারা চাননা, তবে পরিবারের অন্য ভাই-বোনদের খরচও তো চালাতে হবে। এছাড়া উপায় কি! তাই সাফ সাফ জানিয়ে দেন ‘এতদিন পড়াশোনা করাইছি। এখন নিজের টাকা নিজে কামাই করো গিয়া।’

আমি উঠে বসে বিছানাটাকে গুটিয়ে রেখে দিলাম রুমের এককোণে। আগামী দুইদিন এই বিছানাতে শুয়া-বসা হবে না। অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষা চলছে। আমিও একজন পরীক্ষার্থী। আগামীকাল আমার ‘ওয়েস্টার্ন পলিটিকাল সাইন্স’ পরীক্ষা। রাষ্ট্র-রাজনীতি নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল আমার। তাই অনার্সে ভর্তির সময় প্রথম সাবজেক্টটাই সিলেক্ট করেছিলাম ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’। এভাবে নিজের পছন্দের সাবজেক্টটা পাওয়ায়, পড়ালেখার আগ্রহ যেন আরো দ্বিগুন বেড়েছে।

আজকে ফজরের পর বের হয়ে আগামীকাল পরীক্ষা দিয়ে রাত্রে রাত্রে আবার ঢাকায় ফিরতে হবে। একনাগাড়ে কয়েকদিন অনুপস্থিত থাকলে কোর্স থেকে নাম কেটে দিবে। তাই যে করেই হোক পরীক্ষা দিয়ে আবার ঢাকায় ফিরতে হয় আমাকে। এভাবে এসে-যেয়ে যে পরীক্ষা দিচ্ছি, এতে অবশ্য আমার খারাপ লাগে না। নিয়মিত ঢাকা-হবিগঞ্জ প্রায় দুইশত কিলোমিটারের যে পথ ট্রেনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়, তাতে কিছুটা ক্লান্তি আসলেও পড়ালেখার আনন্দ সেই ক্লান্তিকে ধোয়ে-মোছে সাফ করে দেয়। আমি হালকাভাবে দরজা টান দিয়ে বাহিরে বের হয়ে আসি। পুরো পরিবেশটা নিরব হয়ে থাকলেও পাখিদের কিচিরমিচির ভঙ্গ করেছে সেই নিরবতাকে। রুমের পাশে লাগুয়া বাসাটার ঠিক উত্তরকোণে ছোটখাটো বাগানটায় প্রতিদিন টুনটুনি ও চড়ুই ডাকাডাকি করে। আজকেও ডাকছে। আহ, কী মধুর!

কিছুক্ষণ পরে হোটেল-রেস্তোরাগুলো খুলতে শুরু করবে। যারা ধনী, পকেটে যাদের টাকায় ঘুর ঘুর করে, তাদেরকে প্রায়ই দেখি প্রভাতের আলোতে একটু-আধটু হাটা-চলার পর হোটেলের পাতলা রুটি আর লেবু চিপে ডাল খেয়ে বাসায় ফেরে। কাউকে দেখি আবার শখ করে চা-পানও খান। মধ্যবিত্তদের তো হিসেবের টাকা। তাদের কাছে এই টাকাগুলো কেবলই অপচয়। তারা একবার হোটেলে যাওয়ার আগে তিনবার ভেবে দেখেন, টাকা কত খরচ হবে! এই হলো উচ্চবিত্তের সাথে মধ্যবিত্তের ফারাক। আমি এগুলো কখনোই খাইনা। খাওয়ার অবশ্য ইচ্ছে জাগে। কয়েকদিন এমন হয়েছে যে, হোটেল পর্যন্ত গিয়েছি। তারপর যখন হিসেব কষে কষে চল্লিশ টাকা ম্যনেজারকে দিতে হবে-একথাটুকু ভাবনায় এসেছে, তখন সাথে সাথেই হোটেলের সম্মুখ থেকে উল্টোদিকে মোড় নিই। ওয়েটার অবশ্য বিস্ময় আখিযুগলে যথেষ্ট শ্রদ্ধার সাথে আমাকে ডেকেছে, কিন্তু চল্লিশ টাকার কথা ভেবে আমি ওদের ডাকে কর্ণপাত করিনি।

আমি আমার ফাইল, পরিচয়পত্র, প্রবেশপত্র নিয়ে বের হওয়ার সময় রুমের ঘুমন্ত কয়েকজনকে জাগ্রত হতে দেখলাম। তারা জানেনা আমি যে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যাচ্ছি। আমি অয়ন আর শাহরিয়ারকে বলে আসলাম ‘আমি একটু যাচ্ছি রে দোস্ত’। বসুন্ধরা কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে মেইনরোড পর্যন্ত ভাড়া ত্রিশ টাকা। এই এক-দেড় কিলোমিটার জায়গা অবশ্য ধনীরা ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা রিকসাযোগেই যান। কিন্তু আমি হেটেই যাই। কোথাও ক্লান্তি অনুভব হলে একটু বসে পা দুটো’কে নাড়া দিলে ক্লান্তি অবশ্য উধাও হয়ে যায়।

আমি হাঁটা ধরি মেইনরোডের দিকে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর NSU এর মোড় পাড় হয়ে অনুভব করলাম পিছনে পিছনে কে যেন আমাকে ফলো করে আসছে। কিছুটা শঙ্কিত হয়ে তাকালাম। দেখলাম, ছাই রঙের একটা কুকুর। আমি মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে বললাম ‘কি রে ক্ষুধা লেগেছে বুঝি খুব?’ কুকুরটা দুই অসহায় চোখ বের করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, ‘দাড়া, একমিনিট।’

তারপর ট্রেনে খাওয়ার জন্য যে পাউরুটি আর কলা রেখেছিলাম, তার অর্ধেক দিয়ে দিলাম কুকুরকে। কুকুরটা খাবারের দিকে তাকিয়ে পুনরায় লেজ নাড়াতে নাড়াতে আমার দিকে তাকালো। যেন আফসোসের সুরে বলছে, ‘বহুদ্দিন পরে কেউ ভালবেসে একটুকরো খাবার দিল রে! আল্লাহ তোর সহায়ক হোন।’

একটা কুকুর নিজের ঘুমটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে আমাদের উচু উচু দালানগুলোকে পাহাড়ে দেয়, তবুও কুকুরকে একটুকরো ভাল খাবার দিতে আমাদের আতে লাগে। হায় আফসোস!

হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় এসে মেইনরোডে পৌঁছাই। এখান থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাওয়ার জন্য ভাল ‘সিটিং সার্ভিস’ আছে। কিন্তু ওই যে বলেছিলাম, একটা কাজ করার পূর্বে তিনবার ভাবতে হয় আমাদের। অবশেষে স্বল্প ভাড়ার তুরাগই বেচে নিতে হয় আমাকে। ফিটনেসবিহীন নড়বড়ে তুরাগ আমাকে পৌঁছে দেয় এয়ারপোর্ট রেলওয়ে স্টেশনের পাশে। আমি পাঁচ টাকা দামের বাংলাদেশ প্রতিদিন হাতে নিয়ে অপেক্ষায় থাকি সিলেটগামী ‘পারাবত এক্সপ্রেসের’। ঠিক সাতটায় ট্রেনটা যখন এয়ারপোর্ট রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে, ধাক্কাধাক্কি করে হলেও ট্রেনটাতে আমাকে উঠতেই হয় তখন। দীর্ঘ সাড়ে তিনঘন্টা দাড়িয়ে থাকি ট্রেনের যে কোন এক বগিতে। দায়িত্বশীলরা আসলে কার্ড দেখিয়ে অর্ধেক ভাড়া দিয়ে দেই। পত্রিকার নিউজ, বিনোদন, সম্পাদকীয় পড়ে পড়ে সময়টাকে অতিক্রম করি। পা বদল করে করে শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখার চেষ্টা করি। তবুও কখনো কখনো বিরক্তি অনুভব হলে, পত্রিকাটা নিচে বিছিয়ে বসি। মানুষগুলো তখন বড্ড বিস্ময়ের চোখে আমার দিকে তাকায়! আমি ওদের নজরে খুব বেশী পাত্তা দেই না। নিচের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কবিতা আবৃত্তি করি- ‘আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়, আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়। আমি মানব-দানব দেবতার ভয়, বিশ্বের আমি চির দূর্জয়।’

এভাবেই প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি। তাও নিজের কাছে কোনরকম কষ্ট অনুভব হয়নি এটা ভেবে যে, তবুও তো দেশের বোঝা না হয়ে আমি একজন যোগ্য-নাগরিক হচ্ছি, তাহলে আমার আবার দুঃখ কিসের?

লেখক: শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অব পলিটিক্যাল সাইন্স

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *