মনে পড়ে ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যিদ আসআদ মাদানীকে

মনে পড়ে ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যিদ আসআদ মাদানীকে

আমিনুল ইসলাম কাসেমী : কুতুবুল আলম সাইয়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. যেভাবে সুদুর প্রসারী চিন্তা-চেতনা নিয়ে ময়দানে নেমেছিলেন, যার চিন্তার ফসল আজো ভোগ করে চলেছেন শত শত কোটি মানুষ। নির্বিঘ্নে-নিরাপদে কাটিয়ে দিচ্ছেন। আজ আর ব্রিটিশদের চোখ রাঙানী নেই। পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে এক মুক্ত হাওয়ায় চলেছে এই ভারত উপমহাদেশের জনতা। ঠিক তাঁর যোগ্য উত্তরসুরী ছিলেন ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যিদ আসআদ মাদানী রহ.।

হুবহু পিতার নঁকশে কদমে চলেছিলেন তিনি। একটুও এদিক সেদিক করেননি। জাতিকে এমন দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যা আজো বারবার স্মরণ হয় তাঁকে। একবিংশ শতাব্দীর এই সংকটময় মুহুর্তে কদমে কদমে মনে পড়ে। ফেদায়ে মিল্লাতের প্রতিটি পদক্ষেপ সর্বস্তরের মানুষের জন্য কল্যাণ ছিল, তা প্রতীয়মান হচ্ছে। তাঁর চিন্তা – চেতনা কত পরিচ্ছন্ন, কত যুৎসই সেটা আমাদের সামনে ভেসে উঠছে।

আচ্ছা, ফেদায়ে মিল্লাত যে খ্রীষ্টান মিশনারীর বিরুদ্ধে জোরালো ভুমিকা রাখতে বলেছিলেন, তিনি যে আলেমদের বারবার বলেছিলেন, খ্রীষ্টানদের অপতৎপরতা থেকে মুসলিম মিল্লাতকে রক্ষা করতে হবে, তাদের মোকাবেলায় মুসলিমদের খেদমতের প্রসার ঘটাতে হবে, কিন্তু আমরা কজন পেরেছি সেই কাজে শরীক হতে? বরং কত বনী আদমকে খ্রীষ্টান মিশনারীরা গোমরাহ বানিয়ে দিচ্ছে। কত মুসলমানের ঈমান ধ্বংস করার নীলনকশা আটছে তারা। কিন্তু আমরা সবাই যেন ঘুমিয়ে আছি।

স্কুল প্রতিষ্ঠার ভাবনা ছিল ফেদায়ে মিল্লাতের। তিনি সর্বপ্রথম আলেমদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। আলেমগণ যেভাবে মাদ্রাসা পরিচালনা করছেন, ওই ভাবে স্কুলও পরিচালনা করবেন। যার দ্বারা সাধারণ শিক্ষিতদের মাঝে দ্বীনের সমঝ পয়দা হবে। এবং তারা খ্রীষ্টান মিশনারী এবং ইসলাম বিরোধী শক্তির মোকাবেলায় বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াবে।

ফেদায়ে মিল্লাতের পরামর্শ অনুযায়ী আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেব সর্বপ্রথম স্কুল এর গোড়াপত্তন করেন

আমরা কিন্তু স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একদম পিছিয়ে। এর ব্যাপারে আমরা গাফেল। খুব কম প্রতিষ্ঠা হয়েছে স্কুল। অথচ ওলামা মাশায়েখদের নেতৃত্বে স্কুল তৈরী হলে, সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রসার ঘটত। সবাই দ্বীনের দিকে ঝুকে পড়ত। বিশেষ করে ইংরেজী শিক্ষিত মানুষের মাঝে দ্বীনদারী চলে আসলে ব্যাপক ফায়দা হত জাতির। ওই সব দ্বীনদার ভায়েরা ক্ষমতার চেয়্যারে বসলে আর কখনো দুর্নিতী করার মন-মানসিকতা থাকত না।

এখানে লক্ষণীয়, সবশ্রেণীর মানুষের সন্তান কিন্তু মাদ্রাসায় ভর্তি হয় না। অথচ তারা কিন্তু মুসলমান। তাহলে তারা কি দ্বীনী শিক্ষা থেকে দুরে থাকবে? কখনো নয়। তাদেরকেও দ্বীন শেখাতে হবে। কোরআন-হাদীসের সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে তাদের। এসব চিন্তা করেই সাইয়্যিদ আসআদ মাদানী রহ. স্কুল প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে বেশী তাকিদ করেছিলেন।

ফেদায়ে মিল্লাতের পরামর্শ অনুযায়ী আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেব দামাত বারাকাতুহুম সর্বপ্রথম স্কুল এর গোড়াপত্তন করেন। তিনি রাজধানী ঢাকাতে ‘ইকরা বাংলাদেশ’ নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেসময়ে অনেকেই কিন্তু স্কুল তৈরী করাকে ভাল চোখে দেখেননি। অনেকে ঠাট্রা- বিদ্রুপ করেছেন। কিন্তু তাঁর এই মিশনে তিনি সাকসেস হয়েছেন আমি মনে করি। আল্লামা মাসঊদ সাহেবের দেখাদেখি অবশ্য জেলা পর্যায়ে অনেক প্রতিষ্ঠান তখন গড়ে ওঠেছে। যেগুলো ফরীদ সাহেবের ঐ সিলেবাস অনুযায়ী পরিচালিত হয়।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিন্তু ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যিদ আসআদ মাদানী রহ. সেই দর্শন, চিন্তা- চেতনার কথা আরো স্মরণ হচ্ছে। কেননা, স্কুল কিন্তু বন্ধ বহুদিন ধরে। করোনার কারণে চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু যদি আলেমদের নেতৃত্বে কোন দ্বীনি স্কুল তৈরী হলে মনেহয় সেটা এভাবে বন্ধ হত না। তার কোন সুরাহা অবশ্যই হত।

আজকে দেশের অধিকাংশ জেনারেল শিক্ষিতদের ইসলামিক কোন জ্ঞান নেই। তারা দেশের বড় বড় পদে বসে আছে। ডিসি, এসপি, জজ, ব্যারিষ্টার, সবাই কিন্তু কোরআন-হাদীসের জ্ঞানে মুর্খ। তারা জীবনটা বিলীন করে দিয়েছেন দুনিয়াবী জ্ঞান হাসিলের জন্য। সত্যি তারা যদি আজ কোরআন জানত, হাদীস জানত, কতই না ভালো হত।

বড় ভাললাগে যখন শুনি একজন ব্যারিষ্টার, তিনি আবার মাওলানা। বড় গর্ব হয়, একজন জেলা প্রশাসক তিনি কোরআনের হাফেজ। একজন সচিব রমজানে খতম তারাবীহ পড়ান। এরকম পরিবেশ কায়েম করতে পারলে বড় শান্তির আমেজ সৃষ্টি হবে। ঠিক ফেদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানী সাহেব এটাই চাচ্ছিলেন, তার চিন্তা- চেতনা এমনই ছিল।

ফেদায়ে মিল্লাতের আরো বড় অবদান, দুস্হ, অসহায়, নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তিনি তো জীবনকে বিলীন করে দিয়েছিলেন। বিশ্ব মুসলিমের অগ্রদুত বলা হত তাঁকে। মুসলিম উম্মাহর ক্রান্তিকালে তিনি বুক চিতিয়ে দিতেন। মজলুম মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। যেখানেই মানুষ অসহায় হয়েছে, সেখানেই তিনি বিদ্যুৎবেগে ছুটে গেছেন।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন সাইয়্যিদ আরশাদ মাদানী

বিশেষ করে সাইয়্যিদ আসআদ মাদানী সাহেব আলেম-উলামার ইসলাহী খেদমত বেশী করেছেন। যার জন্য বছরের বেশ কয়েকবার তিনি ছুটে আসতেন। শুধু বাংলাদেশ নয়।পুরো বিশ্ব তিনি সফর করতেন। উলামায়ে কেরামের অনেকেই ইসলাহী এই প্রোগ্রাম বা ইসলাহী তায়াল্লুকের ব্যাপারে তাঁদের গাফলতী ছিল। অনেক প্রতিভান আলেম তারা কিন্তু পিছিয়ে থাকতেন এই মহান কাজে। কিন্তু ফেদায়ে মিল্লাত সেই সব আলেমদের তিনি বাগে এনে রাহবারী করেছেন। বহু আলেম আছেন, যাদের চলন্ত লাইব্রেরী বলা যায়, সেসব আলেমদেরকে কাছে টেনে তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন।

আরবীতে একটা প্রবাদ আছে, ‘ফে’লুল হাকীমে লা – ইয়াখলু আনিল হেকমাতে’ বিজ্ঞজনদের কোন কাজ হেকমত থেকে খালি নয়। এজন্য ফেদায়ে মিল্লাতের চিন্তা-চেতনা, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অতুলনীয়। যার সাথে কোন তুলনা হবে না। শুধু তাঁর কথা মনে পড়ে। মহান আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দুআ করি, আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসে সুউচ্চ মাকাম দান করেন। আমিন।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *