আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মহাকাশ থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তোলা ছবি কি অসমতার মাত্রা নিরূপণে ভূমিকা রাখতে পারে? অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘হ্যাঁ’ পারে। অন্তত ভারতীয় দুই অর্থনীতিক প্রবীণ চক্রবর্তী ও বিবেক দেহেজ্জা তা-ই মনে করেন। শুধু মনে করা না, ভারতের ১২টি অঙ্গরাজ্যের বিভিন্ন শহর ও জেলার স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে এর পক্ষে কিছু প্রমাণও হাজির করেছেন তাঁরা।
এ সম্পর্কিত বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউএস এয়ার ফোর্স ডিফেন্স মেটিআরলজিক্যাল স্যাটেলাইট প্রোগ্রামের (এএফডিএমএস) আওতাধীন স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করেছেন প্রবীণ চক্রবর্তী ও মুম্বাইভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইডিএফসির সিনিয়র ফেলো বিবেক দেহেজ্জা। পৃথিবীকে দিনে ১৪ বার প্রদক্ষিণ করা এই স্যাটেলাইটগুলো রাতের পৃথিবীর আলোর হিসাব রাখে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের রাতের আলোর ছবি তুলে রাখে এগুলো। এই স্যাটেলাইটের ধারণ করা ছবিগুলো থেকে দুই গবেষক বেছে নেন ভারতের কিছু নির্দিষ্ট এলাকার ছবি।
গবেষকরা জানান, স্যাটেলাইটগুলো থেকে পাওয়া ছবিগুলোর মাধ্যমে তাঁরা ভারতের ১২টি রাজ্যের ৬৪০টি জেলার মধ্যে ৩৮৭টি জেলা পর্যবেক্ষণ করেন। এসব জেলায় ভারতের মোট জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশের বাস। আর দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকা-ের (মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ভিত্তিতে) ৮০ শতাংশই এসব জেলায় পরিচালিত হয়। স্যাটেলাইটগুলো থেকে পাওয়া সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর ছবি বিশ্লেষণ করে ভারতের সম্পদবণ্টনের চিত্র পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে গবেষণায়।
এতে দেখা গেছে, রাতের ভারতের অধিকাংশ এলাকাই অন্ধকার। কারণ, এই সময়ে অধিকাংশ অঞ্চলে কোনো অর্থনৈতিক কর্মকা-ই চলে না। তবে কিছু অঞ্চলে বেশ উজ্জ্বল আলো দেখা যায়, যা ওই সব অঞ্চলের অর্থনৈতিক গতিশীলতার প্রমাণ বহন করছে। কিছু অঞ্চলে মৃদু আলো দেখা গেছে, যা অর্থনৈতিক কর্মকা- চললেও এর স্বল্পমাত্রার কথাই জানান দেয়। বিশ্লেষণে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি রাজ্যের ভেতরের বণ্টনব্যবস্থার অসাম্যকে চিত্রিত করছে বলে মত দেন গবেষকেরা।
ছবিগুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১২টি রাজ্যের পর্যবেক্ষণাধীন ৩৮০টি জেলার রাতের গড় উজ্জ্বলতা মুম্বাই বা বেঙ্গালুরুর মতো বড় শহরের উজ্জ্বলতার পাঁচ ভাগের এক ভাগ। আবার এই জেলাগুলোর মধ্যে অগ্রসর ১০ শতাংশ জেলা রাতে যতটা উজ্জ্বল, বাকিগুলোর উজ্জ্বলতা তার এক-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি। আর এই তুলনামূলক অবস্থার উন্নতির বদলে ক্রমাবনতি ঘটছে। বিশেষত ১৯৯১ সালে অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম শুরুর পরের বছর থেকে এই ব্যবধান ক্রমাগত বাড়ছে। ১৯৯১ সালের আগে এই সব অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে যে সাম্য দেখা গিয়েছিল, তার ছাপ রয়েছে সেই সময়ের ছবিগুলোতে। কিন্তু এর পরের ছবিগুলোয় আর এই সমধর্মিতা বজায় থাকেনি।
গবেষকেরা জানান, ২০১৪ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে, সবচেয়ে ধনী তিন রাজ্য কেরালা, তামিলনাড়ু ও মহারাষ্ট্রের একজন মধ্যম আয়ের মানুষের গড় আয় সবচেয়ে দরিদ্র তিন রাজ্য বিহার, উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের মধ্যম আয়ের মানুষের গড় আয়ের তিন গুণ। অর্থাৎ ১৯৯১ সালের পর গৃহীত অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় ভারতের রাজ্যগুলো সমভাবে শামিল হতে পারেনি। এটি ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক অসাম্য তৈরি করেছে। ঠিক একইভাবে কোনো একটি নির্দিষ্ট রাজ্যের ভেতরেও অর্থনৈতিক অগ্রগতি সমভাবে হয়নি। অর্থাৎ বৈষম্য এসেছে দুই দিক থেকেই। আর এর পেছনে সুশাসনের অভাবকেই কারণ হিসেবে দেখছেন গবেষকরা।
বিবেক দেহেজ্জা বিবিসিকে বলেন, ‘এক রাজ্যের সঙ্গে অন্য রাজ্যের এবং একই রাজ্যের ভেতরে দুই জেলার মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। আর এই ব্যবধান সময়ের সঙ্গে বাড়ছে। না এটাকে “ধনীর আরও ধনী হওয়া”র মতো কোনো বিষয় বলা যাবে না। বরং বলতে হবে, অর্থনৈতিক কর্মকা-ের দিক থেকে বিভিন্ন অঞ্চল সমভাবে এগোতে না পারায় দরিদ্রদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ধনীরা। ব্যবধান বাড়ছে।’
_Patheo/106/sl