- আমিনুল ইসলাম কাসেমী
মধুমতি নদীর সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মধুমতির কুলঘেঁষে আমার নানাবাড়ি। শৈশবের দুরান্তপনা কেটেছে এই নদীর পাড়ে। ভরদুপুরে উচ্ছল সাঁতারকাঁটা। খরস্রোত উপেক্ষা করে দুর্বার গতিতে উজান বেয়ে চলেছি। কখনো স্রোতের তালে তালে সাতরিয়ে চলে গেছি অনেকদূর। কখনো নদীতে নুইয়ে পড়া নারকেল গাছে উঠে নদীতে ঝাপ দিতাম। কয়েক মিনিট পরে উঠতাম অনেকদূরে গিয়ে । বন্ধুরা খোঁজাখুঁজি করত। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে একটু পরে ফুঁস করে উঠতাম। আহ, সে কী আনন্দ। দুপুর গড়ায়ে বিকেল বেলা হাজির হতাম নানাবাড়ির দোরগোড়ায়। নানাজির ভয়ে চুপে চুপে ঘরে গিয়ে বসে থাকতাম।
সবচেয়ে বড় মজা ছিল নদীতে মাছধরা। বাঁশে বাঁধা জাল নিয়ে কিনারে ইচামাছ( চিংড়ি) মাছ ধরতাম। কখনো বেলে মাছও উঠত তাতে। আবার কখনো খল্লা মাছের ঝাক দেখলে জাল পেতে চুপি চুপি দুরে রশি ধরে দাঁড়িয়ে থেকেছি। যখনই মাছের ঝাক জালের মধ্যে এসে জমা হয়েছে, অমনি জোরে রশি টান দিতাম। মাছগুলো ডাঙ্গায় এসে পড়ত। চটজলদি মাছগুলো কুনোর মধ্যে ভরে নিতাম। (কুনো মাটির তৈরী পাত্র, যাতে মাছ ধরে জিইয়ে রাখা যেত)। এরকম বহুবার মাছ ধরেছি মধুমতি নদী থেকে।
আমাদের ছোটবেলা দেখেছি মধুমতি নদীতে ইলিশমাছ পাওয়া যেত। বর্ষার মৌসুম আসলে জেলেদের খাওয়া-ঘুম থাকত না। ছোট ছোট নৌকা নিয়ে তারা নদীতে জাল ফেলত। নানাবাড়িতে গেলে তাজা ইলিশ মাছ খেতাম তখন। সেসময়ে মাছ ধরা পড়ত অনেক। জেলেরা স্থানীয়ভাবে বেচাকেনা করেছে বেশী। বাইরের হাটবাজারে সেসব মাছ কম গিয়েছে। কখনো জেলেদের মাছ অবিক্রি থেকেছে। সেটা অবশ্য রাতের বেলা। গভীর রাতে জেলেদের হাঁক শোনা যেত। মাছ কিনবেন কেউ! ইলিশ মাছ…। রাতেরবেলা সস্তায় ইলিশ মাছ পাওয়া গেছে তখন।
সেসব এখন স্মৃতি। মধুমতি নদী দেখলে সেসব স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। শৈশবের দুরন্তপনার কথা বারবার স্মরণ হয়। নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার পাশ দিয়ে চলে গেছে মধুমতি নদী। ওপারে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপেজেলা। এই লোহাগড়া উপজেলা এবং কাশিয়ানীর মিলনস্থলেই কালনাঘাট। যেটা দক্ষিণবঙ্গের মানুষের কাছে প্রসিদ্ধ। যশোর এবং খুলনা থেকে নিয়মিত বাস যাতায়াত করত এখানে। খুলনা এবং যশোর টার্মিনালে বাসওয়ালাদের ডাক শোনাযেত এ্যাই কালনাঘাট, কালনাঘাট। সেই কালনাঘাটে এখন দৃষ্টিনন্দন সেতু। বাংলাদেশে এই প্রথম ছয় লেনের সেতু উদ্বোধন হয়েছে।
ইতিপুর্বে আর কোথাও এমন সেতুর উদ্বোধন হয়নি। এটাকে নড়াইল জেলার মানুষের পরম সৌভাগ্যের সেতু বলা হচ্ছে। দক্ষিণবঙ্গের নড়াইল- যশোরবাসীর বড় নেয়ামত মনে করা হচ্ছে। কেননা নড়াইল ছিল অবহেলিত জনপদ। এর আগে চোখে পড়ারমত উন্নয়ন হয়নি। তাছাড়া নড়াইল থেকে ঢাকা আসতে হলে যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, ফরিদপুর হয়ে ঢাকা ঢুকতে হত। এখন নড়াইল থেকে উল্টো যশোর, ঝিনাইদহ ঘুরতে হবে না। ১০০ কিলোমিটার রাস্তা কমে গেছে। বড় পাওনা নড়াইলবাসীর।
১০ অক্টোবর কালনা সেতু উদ্বোধন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়াল ভাবে কালনা সেতু উদ্বোধন করবেন। খবরটা কানে পৌছে গেল। তবে হৃদয়ে সাড়া জেগে গেল আমার। যেভাবেই হোক কালনা সেতু উদ্বোধনের দিন পার হতে হবে। শৈশবের স্মৃতিমাখা মধুমতি। সেখানে এখন স্বপ্নের সেতু। মনটা আনচান করতে লাগল। তাইতো রাজবাড়ি থেকে রওনা হলাম।
বেলা দুইটায় কালনাঘাটে পৌছালাম। ততক্ষণে কালনাসেতুর দরজা খুলে গেছে। কালনাসেতুর কাশিয়ানী প্রান্ত দিক দিয়েই প্রবেশ করলাম। বাহ, কী চমৎকার দৃশ্য! মনোরম পরিবেশ। এতদিন যেখানে ডিঙ্গিনৌকা আর ফেরীতে করে নদী পার হতে হয়েছে। আজ সেখানে নজরকাড়া সেতু। পুরো নড়াইল ও কাশিয়ানীর মানুষের মাঝে আনন্দের জোঁয়ার। যেকারণে কালনা সেতুতে মানুষের ঢল। হাজারো নারী-পুরুষ জমা হয়েছে সেখানে।
কালনাসেতু যেন মহামিলনের। এপার-ওপারের মানুষ জমা হয়েছে সেখানে। এতদিন নদীর কারণে দূরে দূরে ছিল সবাই। আজ আর দূরে থাকা নয়। আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। একে অপরকে আলিঙ্গন করে নিচ্ছে। নদীর এপাশে ওপাশে আত্মীয় তথা আপনজন ছিল। মাঝখানে বিশাল নদীর কারণে আত্মীয়তার হক আদায় হয়নি। আজ সেতুর কারণে বন্ধন মজবুত হয়ে গেল।
মধুমতি নদীর পাড়েই আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু বিশাল নদীর কারণে সবার সাথে দেখা-সাক্ষাত কম হয়েছে। নদী পারাপারের ঝামেলা ছিল বড়, কিন্তু এখন আর কোনো ঝামেলা নেই। পায়ে হেঁটেই এপার ওপারে যাওয়া যাচ্ছে। জনগণের পয়সা বেঁচে যাচ্ছে। এটা পারহতে ১০ টাকা খরচ হত। এখন তো পায়ে হাঁটা মানুষের জন্য ফ্রি। বড় আনন্দের কথা।
পদ্মাসেতু যেভাবে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের সাথে প্রীতি-বন্ধন গড়ে তুলেছে। কালনা সেতুও কোনো দিক থেকে কম নয়। দক্ষিল-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের সাথে সেতুবন্ধন কায়েম করবে। অবহেলিত জনপদগুলোর প্রাণোচ্ছলতা ফিরে পাবে। গড়ে উঠবে প্রীতি বন্ধন। সত্যি সেতু পার হয়ে আত্মীয়তার বন্ধন মজবুতের জন্য চলে গেলাম। অনেকদিন পরে আমাকে পেয়ে অনেক খুশি। তারা ভালবাসার বন্ধনে আটকিয়ে ফেলল। ছুটে এলো অনেক পরিচিতজন। সেতুর কারণে মহামিলন ঘটে গেল।
- লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট