মানুষ যেহেতু আকাশে ওড়ে | তৃতীয় পর্ব
মুবাশশির হাসান সাকফি
আমরা এই শিরোনামের প্রথম পর্ব শুরু করেছিলাম প্রথম উড়ুক্কু মানব আব্বাস ইবনে ফিরনাসের কথা দিয়ে। দ্বিতীয় পর্বে বলেছিলাম উড়াল প্রযুক্তির ক্রমসম্প্রসারণ, কিছু জটিলতা ও প্রতিকার নিয়ে। এই পর্বে সবচেয়ে সহজ বিষয়টা আমি বেঁছে নিয়েছি। সেটা হল, ওড়ার পদ্ধতি।
কেন? কারণ, আমি মনে করি আব্বাস ইবনে ফিরনাসের মত যদি কোনো কবির আকাশে উড়তে ইচ্ছে করে কিন্তু তার কাছে বিমানে চড়ার টাকা নেই কিংবা কোনো মহাজাগতিক যুদ্ধের মুখে আমরা পড়ে গেলাম অথচ পর্যাপ্ত বিমান নেই তখন আমরা কী করতে পারি? বুদ্ধিমান কিছু মাথা খেলে গেলে হয়ত খুবই কম খরচে আমরা বিমান বা গ্লাইডার বানিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কাজে লাগাতে পারবো। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেই বিমান বা গ্লাইডার বানিয়ে কেউ যেন আরমেন ফিরমানের মত মুখ থুবড়ে না পড়ে! তাই সহজে কীভাবে বিমানের কৌশলগুলো জানানো যায় সেই ভাবনা থেকেই লিখছি।
উদাহরণ দেই। ধরুন, আপনাকে ধরে কয়েকজন বন্ধু মিলে টানাটানি করছে। একজন টানছে ওপরে তুলতে, একজন নিচে টানছে, আরেকজন ডানে তো একজন আবার বামে। এখন আপনি কোনদিকে যাবেন? যদি এরা সমান ভাবে আপনাকে টানে তাহলে আপনি কোনোদিকেই যাবেন না। এটাকে বলে, বল বিভাজনের সাম্যতা। সবাই সমান বলে টানাটানি করলে আপনি কোনোদিকে যাবেন না।
বাতাস পানির চাইতে হালকা বলে আমাদের শরীর বাতাসে ভাসাতে পারি না।
একটা পাখিও যখন আকাশে ওড়ে তখন চারটা বল কাজ করে। একটা হল গ্র্যাভিটি যে তাকে নিচে টানে। আর বাকি চারটা হল বাতাসের কণাগুলো। এরা এলোপাতারি ভাবে পাখিটাকে উপরে, ডানে-বামে টানাটানি করতে থাকে। তো, পানিতে ভাসা আর আকাশে ভাসা কিন্তু কাছাকাছি ব্যাপারি। আমি বাস্তবে সাঁতার জানি না। তাই পানিতে নামলে ডুবে যাই। কিন্তু সাঁতারুরা সুকৌশলে হাত পা ছড়িয়ে নাড়তে থাকেন এবং পানিই তাদের ভাসিয়ে রাখে। তবে বাতাস পানির চাইতে হালকা বলে আমাদের শরীর বাতাসে ভাসাতে পারি না। যদি আমরা পাখির মত হতাম এবং আমাদের ৬.৭ মিটার বা তার চেয়ে বড় পাখনা থাকত এবং পাখির মত আমাদের পেটের ভেতর অনেক বেশি বায়ুথলি থাকত তাহলে আমরা অলিম্পিকে সাঁতারের পাশাপাশি ওড়ার মেডেলও জিততে পারতাম।
যাক, আফসোস করার কিছু নেই। কারণ, মানুষ আকাশে উড়তে পারে। কিন্তু কীভাবে? ভাবুন তো, ঘুড়ি কীভাবে ওড়ে, ফানুস কীভাবে ওড়ে? বিশাল আকারের ঢাউস কিন্তু মানুষকেও উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। আমি আমার বাবার কাছে গল্প শুনতাম, আমাদের গ্রামের বাড়িতে ঘুড়ি ওড়ানোর মৌসুমে একবার নাকি আমার এক চাচা ঢাউসের সাথে উড়ে গেছিলেন। তিনি চিৎকার করছিলেন, “এরে, আমারে কেউ থামারে। এই ঢাউস তো উড়ায় নিয়ে যাচ্ছে রে…” কৈপুকুরিয়া হাইস্কুল মাঠ থেকে এই ঢাউস তাকে উড়িয়ে নিয়ে মাইল পাঁচেক দূরে তেবাড়িয়া হাটের কাছে নিয়ে যায়। তিনি সুযোগ বুঝে দড়ি ছেড়ে লাফিয়ে বাঁচেন। ঢাউসটা কিন্তু সবেগে ছুঁটে চলে যায় মহাকাশ ভ্রমণ করতে।
যাক, বলাই যায়, এখানে নিজের অজান্তেই আমার সেই চাচা একটা প্যারাগ্লাইডার বানিয়ে ফেলেছিলেন। আরেকটু খাটাখাটুনি করলে ওয়ার্ল্ড রেকর্ডও করে ফেলতে পারতেন। আমার বাবা বলেছিলেন, অত বড় ঘুড়ি এর আগে কেউ বানায় নি।
সুতরাং, আমরা যদি কিছু না পারি, অন্তত একটা বড় ঘুড়ি বানাতে পারি সেটাও আমাদের ওড়াতে সক্ষম হবে! পৃথিবীতে অনেক বেলুনে ওড়ার গল্প আমরা শুনেছি। বেলুনে ওঠার পর গ্যাস শেষ হয়ে গেছে। বেলুনটা উড়ে চলেছে, যাত্রীর কী হবে কেউ জানে না! কী থ্রিল আর রোমাঞ্চই না অনুভব করেছি গল্পগুলো শুনে।
সুতরাং আমরা বাতাসকে কাজে লাগাবো। কীভাবে? হয়ত বেলুন বানিয়ে বাতাসকে আটকবো অথবা ঘুড়ির মত একটা ছড়ানো আকার দেবো। যদি বেলুন বা ঘুড়িটা খুব পাতলা হয় তাহলে সেই ওড়াকে বলা হবে বয়ান্ট উড্ডয়ন(Boyant Flight) আর যদি ভারী হয় তাহলে তা অ্যারোডায়নামিক্স উড্ডয়ন (Aerodynamics Flight)।
বয়ান্সি মানে হল, বাতাসের চেয়ে কম ঘন জিনিসকে ভাসানো। তেল পানিতে ভাসে কেন? কারণ, তেলের ঘনত্ব পানির চেয়ে কম। একটা লোহার কয়েন পারদে ভাসে। যদিও ভারি বেশি কিন্তু ঘনত্ব কম। ঘনত্ব আর ভার এক নয়। মনে করুন একজন ৩ ফুটের খাটো মানুষের ওজন ৫০ কেজি। আবার একজন ৮ ফুটের লম্বা মানুষও ৫০ কেজি।
বলুন তো, কাকে চাড়তে বা তুলতে বেশি কষ্ট হবে? অবশ্যই খাটো লোকটাকে। দুজনের ওজন সমান কিন্তু খাটো লোকের সব ওজন অল্প স্থানে জড়ো হয়ে খুব ঘন হয়ে গেছে। কিন্তু লম্বা লোকটার ওজন ছড়িয়ে গেছে তাই হালকা লাগছে। সুতরাং, আমরা যদি এমন কিছু বানাতে পারি যেটা অনেক বড় বা ভারি কিন্তু তার ওজন ছড়িয়ে দেওয়ায় বাতাসের চাইতে কম ঘন বলে বাতাস অনায়াসেই তাকে তুলে নিয়ে যাবে। বাতাস বলবে, ‘এই তুলার বস্তাটাকে আমার খুব ভাল লেগেছে তাই তুলে নিয়ে গেলাম মেঘের দেশে!’ আর যদি এত হালকা কিছু নাও হয়, সমস্যা নেই তখন বুদ্ধি খাটিয়ে ওটাকে ওড়ানোর কৌশলই হলো অ্যারোডায়নামিক্সের পড়াশোনা।
অ্যারোডায়নামিক্সে কয়েকটা জিনিস খালি মাথায় রাখতে হবে। প্রথমে পশুপাখিকে দেখতে হবে ওরা কীভাবে ওড়ে। দ্বিতীয়ত কোন কোন পদ্ধতিতে আকাশে কোনো কিছু ওড়ে। আকাশে তো শুধু পাখিই ওড়ে না। ধুলাবালি ওড়ে, মেঘ ওড়ে, শ্যাওলা ওড়ে। এদের ওড়ার পদ্ধিতটা কী? তো যাক, পাখি, ফড়িং, বাঁদুড়, উঁইপোকা সবই ওড়ে ডানা ঝাঁপটে।
কোন বিমানে উঠলাম রে, ভাই। পাইলট তো ডান-বাম কিছু চেনে না!
সুতরাং আমাদেরও ডানার মত কিছু ঝাঁপটাতে হবে। এটা একটা ফ্যানও হতে পারে যেটা মাথার ওপর লাগিয়ে আকাশে উড়ে যাবো! কিন্তু পাখিরা তো ডানা ছড়িয়ে নিজেকে ভাসিয়েও রাখে। তাহলে? কোনো ব্যাপার না, দুই হাতে দুটো ৪ মিটারের বা তার চেয়ে বড় ডানা লাগিয়ে ছড়িয়ে রাখবো। যথেষ্ট কষ্টকর ব্যাপার। আচ্ছা, একটা কাজ তো করাই যায়, আমরা একটা বাক্সের ওপর একটা ফ্যান লাগিয়ে দেই বাক্সের দুই পাশে দুটো ডানা আর পাখির মত একটা লেজ লাগিয়ে দেই! তাহলেই তো একটা বিমান হয়ে গেল! কিন্তু পাখা ঘুরবে কী করে, বিমান নিয়ন্ত্রণ করবে কে?
সাইকেল আমরা যেভাবে চালাই সেভাবে তো পাখাও ঘোরানো সম্ভব। তাই তো! তাহলে একটা সাইকেলের প্যাডেল দিয়ে একজন লোককে ওই বাক্সের মধ্যে বসিয়ে দেই। সমস্যা হল, পাখা ঘুরবে এবং বিমান উড়বেও হয়ত কিন্তু ডান-বাম নিয়ন্ত্রণ করবে কী করে? এমন বিমান চালালে মানুষ বলবে, ‘কোন বিমানে উঠলাম রে, ভাই। পাইলট তো ডান-বাম কিছু চেনে না!’ তো ডান-বাম ঠিক করবে কে? এটা করবে বিমানের লেজটা। প্যাডেল চালিত নৌকার পেছনে একটা লেজ থাকে যেই লেজটা ডানে দিলে নৌকা যায় বামে, বামে দিলে নৌকা যায় ডানে। মাছ যেভাবে পানিতে চলাচল করে। আমাদের বিমানের লেজে এটা রশি লাগিয়ে ওটার একটা অংশ ডান বা বামে নড়ানো ব্যবস্থা করে দেবো।
এই বিমান এর নাম এইচপিএ। চমৎকার বিমান। ১৯০৪ এ এরকম বিমান প্রথম বানানো হয়। বর্তমানে এমআইটির আওতায় নির্মিত লাইট ঈগল এইচপএ-তে চড়ে প্রায় সাড়ে ৭১ মাইল পাড়ি দেওয়ার রেকর্ড আছে। তাও একজন মানুষের চালনায়!
অ্যারোডায়নামিক্স যে খুব একটা কঠিন ব্যাপার না সেটা আমরা সহজেই বুঝতে পারছি। আর এই সহজ ও মজার বিষয়টা আরও ভালভাবে জানতে পড়াশোনাও করতে হবে। যদিও দক্ষিণ ভারতের ৮ম শ্রেণী পাস নঁননম প্রকাশম একটা আস্ত প্যারাগ্লাইডার বানিয়ে ফেলেছেন তেমন শিক্ষা-দীক্ষা ছাড়াই। তার তিন চাকার বিমানের উপরে আছে একটা প্যারাস্যুটের প্রশস্ত ডানা এবং পেছনে একটা বিদ্যুৎ চালিত ফ্যান। সেটা চিকিৎসাসেবায় দু:স্থ গ্রামবাসীদের জন্য ব্যবহার করছেন। তো প্রিয় পাঠক, আজকের এই আলোচনা এই স্কুল ছেড়ে দেওয়া তরুণ উদ্যোক্তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই শেষ করছি।
আশা করি আবার কখনও গল্প করতে পারবো এরকমই মজার কোনো বিষয়ে। সেই পর্যন্ত সবাইকে শুভেচ্ছা।
আরও পড়ুন: মানুষ যেহেতু আকাশে ওড়ে | দ্বিতীয় পর্ব