মানুষ যেহেতু আকাশে ওড়ে

মানুষ যেহেতু আকাশে ওড়ে

মানুষ যেহেতু আকাশে ওড়ে | দ্বিতীয় পর্ব

মুবাশশির হাসান সাকফি : গত পর্বে আমরা বলেছিলাম আব্বাস ইবনে ফিরনাসের কথা। যিনি স্বপ্নকে সত্যি করে দিয়ে আকাশে গ্লাইডিং করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমরা এখানে রাইটস ভাইদ্বয়ের গল্প করে সময় নষ্ট করবো না। আজ আমরা অত্যাধুনিক কিছু এভিয়েশন টেকনোলজি বা উড়ালপ্রযুক্তি নিয়েই কথা বলবো। চলুন, কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক।

একসময় ফ্লাইং কার বা উড়াল গাড়িকে বৈজ্ঞানিক কল্পগল্পের গাজাখোঁরি ব্যাপার বলে ধরা হত। পর্দায় দেখা যেত। তবে বাস্তবে ভাবাও যেত না। কারণ, লক্ষ কোটি টাকা খরচা করে এত দামি একটা অ্যারোপ্লেন বানানো হয় কেবল ব্যবসার জন্য। তাও ওড়ানো, টেক অফ করা, ল্যান্ডিং করার কত কত ঝামেলা। গাড়ির ক্ষেত্রে এটা সম্ভব না! কিন্তু মজার ব্যাপার, এখন শুধু উড়ুক্কু গাড়িই না; বরং ফ্লাইং মোটরসাইকেল, হেলিকপ্টারের বাচ্চা ভলোকপ্টার, যুদ্ধবিমানের নাতি ড্রোন, রকেটের খালাতো ভাই জেট প্যাক এমনকি বুড়ো ট্রেন দাদুকে ছাপিয়ে বাজারে চলে এসেছে ভাসমান ট্রেনও! ভাবতেই অবাক লাগছে তাই না?

আরও অবাক লাগবে যখন শুনবেন, রাস্তাঘাটে ট্যাক্সি যেমন পাওয় যায় তেমনি উবারের ফ্লাইং কারও এখন কিছু দেশে চালু হয়ে গেছে! এইসব প্রযুক্তি আমাদের কতটা কাজে লাগছে, আর কতটা অকাজে লাগছে তার বিশ্লেষণ গুণিজনদের হাতে ছেড়ে দেই। আমরা শুধু জানার জন্য আলোচনা করছি। না জানলে যদি কোন বিপদে আবার পড়ি!

আপনার শখের ঘর এখন টাটা বাই বাই জানিয়ে চলে যাচ্ছে।

যেমন, একদিন সকালে আপনি ঘুম থেকে উঠে দেখলেন বাড়িটা আকাশে উড়ছে। মানে ওটা ছিল একটা ফ্লাইং হাউজ! বাড়িভাড়া না দেওয়ায় কোম্পানি ওটা তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে। আপনার শখের ঘর এখন টাটা বাই বাই জানিয়ে চলে যাচ্ছে। বস্ত্রসহ বাসস্থান গেল। আপনি পথে বসে গেলেন। অন্ন জোগাড় করতে গিয়ে জানলেন বাজারের সব দোকান উড়ে চলে গেছে! পুলিশের নতুন কোনো আইনে ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো সব আন্ডারগ্রাউন্ড বা ওভার স্কাই হয়ে গেছে। কিছু ভালো মানুষ আপনার অন্নকষ্ট দেখে অনলাইনে খাবার অর্ডার করে দিলেন।

দ্রব্যমূ্ল্যের যে উর্ধ্বগতি, ভাত আর আলুও কদিন পর হয়ত আকাশে উড়ে বেড়াবে আর আমরা পয়সা রকেটে বসে সেগুলো ধরার চেষ্টা করবো! তো অর্ডার করে খাবারের কথা ভাবছেন। হঠাৎ একদল ড্রোন সাঁই সাঁই করে উড়ে এল! একি! যুদ্ধ ড্রোন! ড্রোনগুলো বলল, “টাকা দে!” ছিনতাইকারী ড্রোন! পরে জানলেন, এরা বাজার সদায় সরবরাহকারী ‘কামলা ড্রোন’! কী এক অবস্থা! পৃথিবীর অনেক দেশেই বাজারসহ প্রয়োজনীয় পৌঁছে দিচ্ছে ড্রোন। তবে সাবধান, টাকা না দিলে এদের কাছে আছে ভয়ানক সব ক্ষেপণাস্ত্র! তাছাড়া ফ্লাইং হাউজ বা উড়ন্ত ঘরও তৈরি করেছে কিছু কোম্পানি! আপ নামের কার্টুনে দেখানো আইডিয়া নিয়ে একটা বেলুনে করে উড়ে বেড়াচ্ছে বাড়ি।

একটু পরে দেখলেন, কয়েকটা পিচ্চি হেলিকপ্টার লাল আলো জ্বেলে আপনাকে ঘিরে ধরেছে। আপনি ভাবলেন, হয়ত খেলনা হেলিকপ্টার! কিন্তু ওরা বলল, “আইডি দে!” এরা পুলিশের মাইক্রো ট্রুপ মিনি কপ্টার! আচ্ছা, খুঁজে দেখলেন আইডিটা পকেটে নেই! ওটা বাড়ির সাথে সাথে উড়ে চলে গেছে! ব্যস, আইডি দিতে না পারায় কপ্টারগুলো গেল খেপে। আপনাকে লোহা দিয়ে পেঁচিয়ে মাটিতে ফেলে দিল! এবং পিস্তল বের করে বলল, “খবরদার ওঠার চেষ্টা করবি না। তোকে এখন জেলখানায় নিয়ে যাবো।“ আপনি ছটফট করছেন কিন্তু আপনার শরীর আপনাতেই এগিয়ে যাচ্ছে ওদের সাথে সাথে।

প্রযুক্তি দিয়ে সবচেয়ে বড় যে জিনিসকে এখনও পর্যন্ত ভাসানো হচ্ছে তা হলো, ম্যাগলেভ ট্রেন। হ্যাঁ, আস্ত ট্রেন এখন উড়ে উড়ে যাচ্ছে।

অবাক হবার বিষয়, আপনি ভাসছেন কিন্তু আপনার গায়ে কোনো যন্ত্র নেই! এটা কী করে সম্ভব! খালি কয়েক গজ লোহার তার দিয়ে আপনাকে পেঁচানো হয়েছে! একে বলে ম্যাগলেভ প্রযুক্তি। ম্যাগনেটিক লেভিটেশন বা চুম্বকীয়-ভাসমানতা প্রযুক্তিতে একজন মানুষকে খুব সহজেই কোনো যানবাহন ছাড়া কয়েক টুকরো চুম্বক গায়ে লাগিয়েই ওড়ানো যায়‍! শক্তিশালী চুম্বকের ওপর প্রবলভাবে বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহ করলে চুম্বকটি ভাসতে থাকে। যদিও এ প্রযুক্তির ব্যবহার এখন খুব কম। এই প্রযুক্তি দিয়ে সবচেয়ে বড় যে জিনিসকে এখনও পর্যন্ত ভাসানো হচ্ছে তা হলো, ম্যাগলেভ ট্রেন। হ্যাঁ, আস্ত ট্রেন এখন উড়ে উড়ে যাচ্ছে। রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশে এরকম ট্রেন বাণিজ্যিকভাবেই ব্যবহার হচ্ছে।

তাহলে আমরা বুঝলাম, প্রযুক্তি আমাদের জন্য কতটা ভাল সেটা সন্দেহপূর্ণ। তবে প্রযুক্তি সম্পর্কে না জানলে কী বিপদে যে পড়তে হয় সেটা একজন প্রযুক্তি না জানা মানুষ খুব ভালো করেই টের পান। তো, এত গালগল্প রেখে চলুন আমরা এসব প্রযুক্তির ক্ষতিকারক দিক নিয়ে এবার কিছু জানি।

১. এইসব উড়াল প্রযুক্তি এখনও পর্যন্ত কেবল ধনকুবেরদের সেবা দিচ্ছে। সুতরাং ধনী-দরিদ্রের বিভেদরেখা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। ধনীরা আয়েসের জন্য ব্যবহার করছে অথবা গরীবরা প্রয়োজনেও এসব সেবা পাচ্ছে না। ভারতের চেন্নাইয়ে অষ্টম শ্রেণী পাস রাজা নঁননম প্রকাশম একটি কম খরচে প্যারাগ্লাইডার বানিয়েছেন; নাম জুগাডু প্যারাগ্লাইডার। ভেলরের দুস্থ গ্রামের লোকদের জরুরি চিকিৎসাসেবা দেবার জন্য। তবে এরকম ঘটনা খুবই কম, ব্যক্তিউদ্যোগ এবং তেমন সহায়তাও এই মানুষেরা পাচ্ছে না। সুতরাং, উড়াল প্রযুক্তিকে জরুরি খাতগুলোতে ব্যবহারের চেষ্টা করা উচিৎ। বিশেষত মানবিক কাজে।

২. উড়াল প্রযুক্তি যত বাড়ছে আকাশে যানদুর্ঘটনার আশংকাও তত বাড়ছে। বেশিরভাগ বিমানদুর্ঘটনা ঘটে পাখির কারণে। সেখানে আকাশভর্তি ড্রোনের কারণে সংকট আরও বেড়েছে। আইন কঠোর করেও সমস্যা কাটানো যাচ্ছে না। তাই সবারই উচিৎ উড্ডয়নের আইনগুলো মেনে চলা।

৩. উড়াল প্রযুক্তি বিশেষত ম্যাগলেভ প্রযুক্তিতে অনেক শক্তির অপচয় ঘটে। তাছাড়া তেলকে জ্বালানিরূপে ব্যবহারে পরিবেশেরও ক্ষতি হয়। তাই এগুলোও নিরাপদ প্রযুক্তিতে রূপান্তরের চেষ্টা করা উচিৎ।

অনেক কথা বলে ফেললাম। ইচ্ছা ছিল আরও কিছু লিখব। কিন্তু থাক। আজকে নয়। অন্য কোনো পর্বে আবার এ বিষয়ে মজার কিছু তুলে ধরবো, ইনশাআল্লাহ। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকুন।

আরও পড়ুন: মানুষ যখন আকাশে ওড়ে | প্রথম পর্ব

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *