মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও হাজী কাশেম সংযোগ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও হাজী কাশেম সংযোগ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও হাজী কাশেম সংযোগ

।। চৌধুরী আতিকুর রহমান ।।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে কাশেম সুলাইমানি কে মেরে যুক্তরাষ্ট্র তার এক ঘোরতর শত্রুকে হটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুলাইমানির সম্পর্ক সবসময়ই ছিল মিঠে-কড়া। এরা কখনও কখনও পরস্পরের সাহায্যকারীও ছিল।
২০১৩ নাগাদ ডেক্সটার ফিলকিন লিখছেন, ১১-ই সেপ্টেম্বর ২০১১-র পর আফগানিস্তান কেন্দ্র করে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ এক বিন্দুতে এসে দাঁড়ায়।

রায়ান ক্রকার ছিলেন তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ দপ্তরের উচ্চপদস্থ আধিকারিক। তিনি জেনেভায় একদল ইরানি কুটনীতিকের সঙ্গে মিলিত হতেন। ক্রকারের ভাষায় তিনি কারও মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় তা থেকে বাঁচার জন্য শুক্রবার দিন যেতেন রবিবার দিন ফিরতেন। সারা রাত ধরে বৈঠক চলত। ইরানি কূটনীতিকরা সুলায়মানিকে ডাকত ‘হাজি কাশেম’ বলে। সেখানে আফগানিস্তানের মানচিত্র নিয়ে তালিবানের অবস্থানগুলির উপর আলোচনা হত।

ততদিনে হাজী কাসেম ইরানের সীমান্ত ছাড়িয়ে তার আল-কুদস ফোর্সকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্রে সুলেইমানি কোন চিহ্ন ছেড়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। কোন কাগজে তাঁর হাতের লেখা বা স্বাক্ষর থাকত না। মুখোমুখি আলোচনা হত।

২০০১-এ আফগানভূমি থেকে তালিবান হঠাতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা দিনের আলোর মত পরিষ্কার। এফবিআই-এর রিপোর্ট অনুযায়ী তেহরানে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ আফগান লড়াইয়ের জন্য তার দপ্তর খুলেছিল। সেখান থেকেই ভিডিয়ো যুদ্ধের গতি প্রকৃতি জানতে ও নির্দেশ পাঠানো হত। মধ্যস্থতাকারীর,,, করে বলেছিলো, ‘হাজী কাশেম সহযোগিতায় সন্তুষ্ট’।

তালিবান হটানোর কার্যোদ্ধারের পর ২০০২-এ বুশ পুনরায় তার চেনা সুরে ফিরে যায়। সাদ্দামের ইরাক, উত্তর কোরিয়া ও ইরানকে ‘অ্যাক্সিস অফ এভিল’ নামে ডাকা হয়। ক্রকার বলছেন, এরপর আফগানিস্তানের কাবুলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ইরানি প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা বুশের বক্তব্যের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সুলাইমানি তো ক্রোধ ও কান্না মিশিয়ে বলেন আমরা চেয়েছিলাম ইরান- যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে সহযোগিতার দিনগুলি ফিরে এসেছে।

এরপর মার্কিন কথিত ‘অ্যাক্সিস অফ এভিল’-এর অপর শিকার সাদ্দামের ইরাক। আফগানিস্থান আর ইরাক ধ্বংসেই তার শেষ। বাকি দুজন? ২০০৩-এর মার্চে ইরাক আক্রমণ করা হল। ইরানকে সরাসরি দেখা গেল না। কিন্তু সাদ্দামের সময়ে একদল মানুষ যারা ইরাক থেকে ইরানে পালিয়েছিল তাদের সাহায্য নেওয়া হল। এই ইরান ফেরত ইরাকিরা মার্কিন বাহিনীর কাছে অচেনা তবে তাদের কাছে চেনা জগৎ ইরাকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মার্কিনীদের প্রবেশ করিয়েছিল। সাদ্দামের পরাজয় হল। কিন্তু ইরাক শান্ত হল না, ইজ্জত ইব্রাহিম আদ দৌরির নকসবন্দিয়া সেনানী মার্কিন ও ইরানি ফৌজকে বিপর্যস্ত করতে লাগল। তারও আগে ইরাকি নির্বাচনে ইরানি প্রভাব বোঝা যাচ্ছিল। নুরি আল-মালিকি ইরাকি প্রধানমন্ত্রী হলেও কাজ করছিলেন ইরানের হয়ে।

ক্রকার আরও বলেছেন, ২০০৮-এ দক্ষিণ ইরাকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মার্কিন সেনা সহায়তায়য় নুরি আল-মালিকি জিতে যায়। সেই সময় সুলাইমানি ইরাকি প্রেসিডেন্ট জালাল তালাবানি ও উপ রাষ্ট্রপতি আদেল আব্দুল মাহদীর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রাতের খাবার সময় ডেভিড পেট্রাউস ও ক্রকারকে সুলাইমানির মেসেজ দেখানো হয় যেখানে সুলাইমানি পারস্পরিক সহযোগিতায় ইরাকের উন্নতি চেয়েছেন। সোলাইমানি লিখেছেন তাঁর হাতেই রয়েছে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও গাজার নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব। ইরাকে ইরানি কুদস ফোর্স এর তিনিই সর্বেসর্বা। কারবালায় বোমা আক্রমণে ৫ মার্কিন সেনা মারা গেলে সুলেইমানি মেসেজ পাঠালেন, ‘ইমাম খোমেইনীর কবরের কসম এ কাজ আমাদের নয়’।
ফিলকিন বলছেন, পেট্রাউস সামনে সুলাইমানি কে বলতেন ‘ট্রু এভিল’। কিন্তু উইকিলিকসের লিক হয়ে যাওয়া খবর থেকে জানা যাচ্ছে সুলাইমানিকে অনুরোধ করছেন ইরাকি সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তদা আস সদরের বিদ্রোহ বন্ধ করার জন্য। সুলেইমানি অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন।

ইরান, সুলাইমানি ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ পুনরায় এক বিন্দুতে এসে দাঁড়ায় যখন ইসলামিক স্টেট নামক খারেজি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটি ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অংশ দখল করে। ইরাকে আপাত দৃষ্টিতে সুন্নি দলটির উত্থান ইরানের কাছে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ইরানি মিলিশিয়ার সর্বেসর্বা কাশেম সুলেয়মানি মার্কিন ফৌজের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ইরাকে আই এস-কে কোণঠাসা করে দেয়।

সুলেয়মানির উচ্চাকাঙ্ক্ষা আফগানিস্তান এবং ইরাকেই থেমে থাকেনি। সিরিয়াতেও বাশার আল-আসাদের সহযোগী রূপে সোলাইমানি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ইতিমধ্যে ট্রাম্পের ২০১৫-র পরমাণু চুক্তি থেকে বার হয়ে আসা ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধুচন্দ্রিমার ইতি ঘটায়। সোলাইমানি হত্যার পর মার্কিন বিদেশ সচিব মাইক পম্পেও একটি খোঁড়া যুক্তি দিয়েছিলেন সুলেইমানি নাকি মার্কিন স্থাপনায় হামলা করতে চেয়েছিলেন।

ইরান বা সোলাইমানি প্রতিবেশী দেশ গুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক রাখার থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও রাশিয়ার মত বহিরাগত শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সমস্ত এলাকাকে অশান্ত করতে পিছপা হয়না। এর একটাই কারণ, এলাকাতে নিজেকে প্রভু হিসেবে স্থাপন করার ইচ্ছা এবং ইরানি সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা দ্বারা একমাত্র শক্তিধর সাম্রাজ্য হিসাবে ইরানকে প্রতিষ্ঠিত করা।

লেখক : কলামিস্ট

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *