মায়ের ঘ্রাণ

মায়ের ঘ্রাণ

  • সাইফুল ইসলাম তানভী

আমজাদের ঘরে বছরে দু-তিনবার গরুর গোস্ত রান্না হয়। স্ত্রী মেহেনুর কাপড় সেলাই করে কিছু আয়-রোজগার করে, সেখান থেকে কিছু জমিয়ে রাখে ঈদুল ফিতরে গরুর গোস্ত কেনার জন্য। সেমাই নুডুলস চিনি পোলাওয়ের চাল মসলা ইত্যাদি আমজাদ ধান বেচে কিনে আনে। তিন বাচ্চার জন্য কাপড়চোপড় সেলাই মেশিনে মেহেনুরই তৈরি করে। বাজার থেকে আমজাদ কম দামে কিছু কাপড় কিনে আনে, সেটা দিয়েই তিন বাচ্চার ঈদের পোশাক হয়।

আমজাদ অল্পতেই তুষ্ট। সারাক্ষণ কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। ধান, মুগ ডাল, পেঁয়াজ রসুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, টমেটো ইত্যাদি শস্য ফলে আমজাদের খেতে। কৃষিখেতের চেহারাটা ভালো হলে আমজাদের মনটাও আনন্দে ভরে ওঠে।

লেখাপড়া নয় ক্লাসের পর আর হয়নি। ছোটবেলায় তার বাবা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। বিধবা মায়ের বিয়ে হয় আমজাদের চাচাত মামার সঙ্গে। বিয়ে হওয়ার পর মা আর সন্তানের পরিচয় দেয়নি। মায়ের নতুন স্বামী অনেক উচ্চ ডিগ্রিওয়ালা। পাকিস্তান আমলেই প্রতিটা বোর্ড পরীক্ষায় বোর্ডস্ট্যান্ড। একজন ভালো শিক্ষক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বর্ণপদক পেয়েছেন। মায়ের থেকে মায়ের নতুন স্বামী প্রায় বিশ বছরের বড়।

শিক্ষক হিসেবে তিনি আদর্শ শিক্ষক। ন্যায়নীতি ধর্মকর্মে তিনি সদানিষ্ঠ। একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর তিনি। প্রশাসনিকভাবে কঠোর হলেও সাধারণ হাজারো মানুষের সঙ্গে তিনি অমায়িক কোমল আচরণ করেন। দুর্নীতি তিনি পছন্দ করেন না। ঢাকা শহরে তিনি নিজস্ব গাড়িতে চড়েন না। ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে যে জিপগাড়িটা পেয়েছেন সেটা অফিসিয়াল কাজেই ব্যবহার করেন। নিয়মিত নামাজ পড়েন। একাধিকবার হজ করেছেন। ইবাদতের কোনো কমতি নেই। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তাঁকে সম্মান করেন। গরিব-অসহায়দের দান-খয়রাতও কম করেন না।

আমজাদের মায়ের সুখের সংসার। নতুন স্বামীর যেমন খ্যাতির অভাব নেই, তেমনি ঢাকা শহরে আছে একটা নিজস্ব ছোট্ট বাড়ি। মায়ের নতুন করে চার ছেলেমেয়ে হয়েছে। মায়ের এ স্বামীর প্রথম স্ত্রীর আছে আরো অনেক সন্তান। আমজাদের মা তাঁর সতিনের সন্তানদের সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করেন। কাউকে বুঝতে দেন না তাঁর স্বামীর ঘরে দুই স্ত্রীর সন্তান। প্রথম স্ত্রী ইন্েতকাল করার পর আমজাদের মাকে এই মহত্ শিক্ষাবিদ বিয়ে করেন। পরিবারটা যেন এক টুকরো জান্নাত! সতিনের মেয়েদের সকলেই উচ্চশিক্ষিত। মার্জিত। বাসায় মেহমানদের আপ্যায়ন করা হয় অ্যারাবিয়ান স্টাইলে। মেহমানদের প্রচুর ফল-ফ্রুট দেওয়া হয়। কাজের মেয়েরাও হাসিমুখে কাজ করে। মেয়ের জামাইগুলোও অনেক অনেক সম্পদশালী এবং শিক্ষিত। সকলেরই ঢাকা শহরে গাড়ি বাড়ি আছে। কোনটা সতিনের মেয়ের জামাই আর কোনটা নিজের মেয়ের জামাই— সেটা বাইরের অনেকেই বুঝতে পারে না। একটি সুন্দর সুখী সংসার বলতে যা বোঝায়, তার কোনো খামতি নেই।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পাখিগুলো বাসায় ঢুকবে। কতগুলো ডাহুকের বাচ্চা এদিক-সেদিক হেঁটে তাদের মাকে খুঁজছে। বেতঝোপের নিচে মাটির গর্তে ওদের বাসা। মা ডাহুকগুলো বিল সাঁতরিয়ে বাচ্চা ডাহুকগুলো নিয়ে বাসায় ঢুকে গেল। অন্যান্য পাখিও কিচিরমিচির করে তাদের মাকে নিয়ে বাসায় ঢুকছে। গরু-ছাগলগুলোর বাচ্চারাও ওদের মাকে খুঁজে গোয়ালঘরে ঢুকছে। বিকেল তিনটার পর আমজাদ খেতে কাজ শুরু করে। মাঝে খেতেই আসরের নামাজটাও পড়ে। মাগরিবের কিছু আগে নীরবে সে মাকে খুঁজছিল। কেউ কাছে ছিল না। নীরবে পাখিদের এমন দৃশ্য দেখে আমজাদ কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিয়েছে। ছেলেমানুষরা সহজে এমন কাঁদে না। আমজাদ নিয়মিতই কাঁদে। এই কাঁদা সহজে পরিবারের কেউ দেখে না। স্ত্রী-সন্তানরা ঘুমিয়ে পড়লেও নীরবে কেঁদে বালিশ ভেজায়। সকালবেলা স্ত্রীর বকা শুনতে হয়। স্ত্রী বলে, তুমি কি শিশু? বালিশ ভেজে কীভাবে? ঘুমের সময় তোমার মুখ থেকে লালা পড়ে?

এসব কথা শুনে আমজাদের কোনো রাগ হয় না। তার কলিজাটা কষ্টে পাথর হয়ে রয়েছে। মায়ের ঘ্রাণের জন্য আমজাদ বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। সেই শিশুবেলায় মায়ের ঘ্রাণ পেয়েছিল। মা আছে কিন্তু মায়ের ঘ্রাণ নিতে পারে না। মায়ের ঘ্রাণটা একটু যদি আমজাদ পেত তাহলে সে নিজেকে পৃথিবীর বাদশা মনে করত। আমজাদ সব জানে—মা কোথায় আছে। কোথায় মায়ের বাসা। কিন্তু মা আমজাদের পরিচয় দেয় না। বাবা ইন্তেকাল করেছে, মা অন্য কাউকে বিয়ে করতেই পারে। কিন্তু সেজন্য নিজের পেটের সন্তানের পরিচয় দেবে না কেন? আমজাদ কৃষক। লেখাপড়া কম জানে। এটাই কি তার অপরাধ? মায়ের নতুন স্বামী-সংসার সব এলিট শ্রেণির। শাশুড়ির আগে বিয়ে হয়েছে, সেখানে গরিব সন্তান আছে—সেটা অভিজাত মেয়ের জামাইয়েরা জানলে ইজ্জত চলে যাবে। আমজাদ যেন তার মায়ের সুখের সংসারের কাঁটা!

সবকিছু জানার পরও আমজাদ মায়ের ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য একদিন ছুটে যায় ঢাকার সেই বাসার গেটে। তেমন কোনো লোভে নয়, শুধু একটু মায়ের ঘ্রাণ সে চায়। অনেকক্ষণ ধরে আমজাদ মায়ের নতুন স্বামীর বাড়ির কেচি গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু উপর থেকে মা জানিয়ে দিলেন— দেখা করা সম্ভব নয়। বলে দেওয়া হলো চলে যেতে। আমজাদের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরতে লাগল! কলিজাটা যেন ফেটে যাচ্ছিল। কাঁদতে কাঁদতে নিজের গ্রামে চলে গেল। পুরো বাস জার্নিতে সে কাঁদছিল। অনেক যাত্রী তাকে কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু সে কাঁদার কারণ কাউকে বলেনি।

দীর্ঘ পঞ্চাশ কিলোমিটার পথ কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির মধ্যে যখন আমজাদ প্রবেশ করল তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ঘরে না ঢুকে ‘মা’ বলে এত বড় এক চিৎকার দিল আমজাদ—যেন পুরো গ্রাম কেঁপে উঠল। আমজাদ শুধু ‘মা’ ‘মা’ ‘মা’ বলে চিৎকার দিতেই থাকল।

স্ত্রী বারবার জানতে চাইল—ওগো তোমার কী হয়েছে?

সন্তানরা কাঁদতে থাকল।

চিৎকার থামিয়ে ঠান্ডা হয়ে আমজাদ সবাইকে নীরব থাকতে বলল। কেঁদেকেটে ফুলে ওঠা মুখে সে খাটে শুয়ে পড়ল। ছোট্ট কন্যাশিশুটিকে কোলে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল আমজাদ। কন্যার হাতের বেলিফুল আর কন্যার শরীরের ঘ্রাণ মিলেমিশে যেন একটা জান্নাতের ঘ্রাণ আসতে লাগল তার নাকে। যেন এতকালের তৃষিত মায়ের অপূর্ব ঘ্রাণে সে ভেসে যেতে লাগল। আমজাদের মলিন চেহারাটা আর মলিন রইল না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *