মা আমার সর্বংসহা সৌম্য ধরীত্রির প্রতিকৃতি

মা আমার সর্বংসহা সৌম্য ধরীত্রির প্রতিকৃতি

  • ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ

‘ওগো! জানালা খোলে দাও আমার পুত্র আসছে, আমি আগেই তাকে দেখব’। চিরন্তন মায়ের আকুতি। আমেরিকা প্রবাসী এরোনোটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার চতুর্থ ছেলে মাহমুদকে বলছে মা। সুদূর আমেরিকার ডালাসে নিজ বাড়িতে শুয়ে শুয়ে অসুস্থ কাতর মা রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রকোষ্ঠ থেকে জানালার পর্দা উঠালে রাস্তা দেখা যায়। মা ছেলেকে দেখার আকুতিতে চেয়ে রয়েছে রাস্তার দিকে।

মার অবস্থা শুনে আমি ঢাকা থেকে রওনা দিলাম। উৎকণ্ঠা ও উদ্বিগ্নতায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঢাকা থেকে দুবাই, দুবাই থেকে ইংল্যান্ডের গেট উইক ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দর, সেখান থেকে ডিগ বেথ পরে টেক্সাসের ডালাস, প্লেনেই প্রায় আটচল্লিশ ঘন্টার পথ। ছোট ভাই মাহমুদ টেলিফোনে বলেছে আজ পারলে আজই চলে এসো। এদেশের বাঘা বাঘা ডাক্তার জবাব দিয়েছে। পথে সব জায়গায় আল্লাহ তাআলার সাহায্য প্রত্যক্ষ করেছি। ডালাসের বাড়ি পৌঁছলাম। মা শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে। বলছে, ‘জানালা খোলে দাও আমার ছেলে আসছে আমি দেখব’। দীর্ঘদিন থেকে মা শয্যাশায়ী ছিলেন। আমেরিকার নাগরিক হওয়ার সুবাদে বাহ্যিক সর্বোচ্চ চিকিৎসার সুযোগ হয়েছিল তার আল্লাহ পাকের মেহেরবানীতে। এগার ছেলে ও তিন কন্যার তৃপ্ত জননী।

বৃষ্টিস্নাত কচি গাছেরন পাতায় যেমন এক ধরনের চিকন সতেজ শ্যামলিমা চকচক করে, তেমনি এক ধরনের স্নিগ্ধ শ্যামল সতেজতা ছিল তার গাত্র বর্ণে।

টানাটানা বড় বড় চোখ, সুচারু নাসিকা, মোহনীয় বিম্বাধর, দীর্ঘাঙ্গী, সুডৌল দেহ বল্লরীর অধিকারী ছিলেন মা। দীর্ঘ ঘন কেশাদাম পিঠ ছাড়িয়ে জানু পর্যন্ত ছিল প্রলম্বিত। শ্যামল বাংলার কিঞ্চিত উজ্জল শ্যামলমোয় ছিলেন। বৃষ্টিস্নাত কচি গাছের পাতায় যেমন এক ধরনের চিকন সতেজ শ্যামলিমা চকচক করে, তেমনি এক ধরনের স্নিগ্ধ শ্যামল সতেজতা ছিল তার গাত্র বর্ণে। এখনো মনে পড়ে খুবই ছোটবেলায় মা যখন দুপুরে কাজকাম সেরে গোসল করে আসতেন, সেই ভেজা গাত্রে স্ফটিকের মত পানির বিন্দু অপার্থিব মোহনিয়তায় জ্যোতির্ময় হয়ে উঠত, আমি খুবই অবাক নেত্রে তাকিয়ে থাকতাম, মা, আমার মা।

হিজলিয়ার বিখ্যাত সৈয়দ বাড়ির মেয়ে ছিলেন তিনি। আমার নানা সৈয়দ আব্দুল লতীফ লম্বা, ফর্সা দীপ্তিমান লোক ছিলেন। সেই বৃটিশ যুগে ঢাকার হাম্মাদিয়া মাদরাসা থেকে আলিম হয়ে ছিলেন। বুযুর্গ এক আল্লাহর অলী হিসাবে এলাকায় প্রসিদ্ধি ছিল। সুদূর আসাম অঞ্চলেও ছড়িয়ে ছিল তার ভক্তকূল, মুরিদান আশেকীন।

সৈয়দ বংশ সূত্রে আরবীয় দেহকাঠামো ছিল তাঁর। আজানু লম্বতি বাহু। আমার প্রথম যৌবনেও লম্বায় তার বুকের কাছেও ঘেষতে পারিনি। বহু বছর পূর্বে তার ঊর্ধ্বতন পুরুষগণ ইরাক, ইরান দিল্লী হয়ে পূর্ব বাংলার শ্যামল লোকদের দীনের হেদায়েতের লক্ষ্য নিয়ে ব্রহ্মপুত্ররে কিনারা ঘেঁষে এসে থেমে ছিলেন তরুলতা পত্র পল্লব শোভিত হিজলিয়া গ্রামে। সাথে ছিল একটা নাম না জানা বৃক্ষের চারা। পুতলেন সেটিকে ব্রহ্মপুত্র বিধৌত পলি মাটিতে। অচিনা গাছ নামেই সেটি পরবর্তীতে পরিচিত পেয়েছিল। কেউ বলতে পারত না এটির বয়স কত? কি গাছ সেটি? সন্ধ্যা আমাবস্যায় এর পাশ দিয়ে যেতে আমাদের গা ছম ছম করত। নানা কাহিনী রকম রকমের কিংবদন্তি ছড়িয়ে ছিল গাছটিকে ঘিরে। জিনপরিদের সাজানো সংসার ছিল এতে। বহুজন মানত মানতো অজ্ঞতা বশত এর গোড়ায়।

নানা অসুখে এর পাতার ব্যবহারে বহুজনেই আরোগ্য লাভ করেছে বলে ব্যাপক জনশ্রুতি ছিল। ছোট সময় দেখেছি বাড়িটি ছিল পশ্চিম উত্তর দিকে ঘন অরণ্যে ঠাঁসা। এত ঘন ছিল যে সূর্যের আলো কোথাও কোথাও মাত্র পৌঁছতো বড়ই ক্লায় ক্লেশে। দক্ষিণমুখী বাড়িটির সামনের দিকটি ছিল খোলা। এরপর সবুজ ক্ষেতের বিস্তার। পশ্চিম দিক ঘেঁষে একটা পুরনো জুমা মসজিদ। নানা নিজেই এর ইমামত করতেন বিনা জাগতিক পারিশ্রমিকে। নানা কারামত ও অলৌকিক কাহিনী ছড়িয়ে আছে তার পূর্ব পুরুষদের নিয়ে এবং খোদ তাঁকে নিয়েও।

নানি ছিলেন পুলের ঘাট কালিয়া চাপড়ার খন্দকার বাড়ির মেয়ে। অলৌকিক এক কিংবদন্তির পুকুর ছিল সেই বাড়ির। হঠাৎ একদিন যা জেগে উঠেছিল এবং পুরো পুকুরটিই ছিল লোহার জাল দিয়ে আবৃত। আধুনিক শিক্ষার চর্চা ছিল বৃটিশ যুগেই। মার এক মামা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ই বিমান বাহিনীর এক পাইলট ছিলেন বৃটিশ আর্মির। মহাযুদ্ধের পর বৃটেনের প্রবাস গ্রহণ করেছিলেন এবং সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন। অন্য মামারাও ছিলেন শিক্ষিত। এক মামাত ভাই বিয়ে করে ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারে। আমার নানু ছোটখাট ধরণের খুবই সুন্দর এক মহিলা ছিলেন। ফর্সা হলদে আভা মিশ্রিত গায়ের রং। পুতুলের মত লাগত তাকে। খুবই এবাদত গোজার এবং রোজাদার ছিলেন। আমাদের ছোটকালেও কোন কথা বলতে শুনিনি তাকে। খুব প্রয়োজন ফিস ফিস করে দুচারটে কথা হয়ত বলতেন কখনও কখনও।

বৃদ্ধাবস্থায় নিজের হাতে পাক করে খেতেন। অন্য হাতের রান্না খেতেন না। সারা রাত নামাজে দাঁড়িয়ে থাকতেন। রুকু সেজদায় কাটাতেন। শুইতে দেখেছি খুব কমই। যে চৌকিতে নামাজ পড়তেন এর উপর আড়াআড়ি ভাবে একটা বাঁশ টানিয়ে রেখেছিলেন। ক্লান্ত হলে ঐ বাঁশটির উপর দিয়ে দুই হাত ছেড়ে দিয়ে কিয়ৎক্ষণ জিরিয়ে নিতেন। পরে আবার নামাজ শুরু করে দিতেন। এই ভাবে ফজর হয়ে যেত। নিজের থুথুকে পর্যন্ত এত হেফাজত করতেন যে এখানে সেখানে কখনো থুথু ফেলতেন না। একটা বাঁশের চোঙ্গায় থুথু ফেলতেন এবং তা ভরে গেলে জঙ্গলের একটা নির্দিষ্ট গাছের গোড়ার কাছে মাটি খুঁড়ে পুতে ফেলতেন। আমাদের খুবই অবাক লাগত। পবিত্রতার ছাপ ছিল তার পুরো অবয়বে।

নামাজ রোজা আর দান সদকা ছিল দৈনন্দিনের অঙ্গ। এভাবে আদায় করতেন দেখে মন হত না আলাদা কিছু করছেন তিনি।

মার মাঝে তার পারিবারিক বনেদিয়ানা ও ইবাদত বন্দেগীর ছাপ ছিল স্পষ্ট। নারী শিক্ষা তো দূরের কথা। মুসলিম পরিবারে পুরুষদের শিক্ষাও যেখানে ছিল বিরল, সেই যুগে তিনি পঞ্চম শ্রেণীর মান পর্যন্ত পড়াশানো করেছিলেন। খুবই মেধাবী ও স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। আমাদেরকে কখনও কখনও তার ছোটবেলায় পড়া কবিতা মুখস্ত শুনাতেন। হাতের লেখা ছিল স্পষ্ট ও সুন্দর। আমার নিজেরই আফসোস হয় আমার লেখার কুশ্রিতা দর্শনে। মামা খালারাও ছিলেন তখনকার মান হিসাবে শিক্ষিত। কিছুটা নিচু স্বরে হামেশা কুরআন মাজীদ পড়তে দেখেছি তাকে, প্রায় গুনগুন পর্যায়ের ছিল তা। তবে সহিহ ও শুদ্ধ ছিল তা। নামাজ রোজা আর দান সদকা ছিল দৈনন্দিনের অঙ্গ। এভাবে আদায় করতেন দেখে মন হত না আলাদা কিছু করছেন তিনি। শেষ অসুস্থতার সামান্য কয়েকটা দিন ছাড়া নামাজ রোজা কাযা হয়নি জীবনে। একটি পেলব স্নিগ্ধতা ছিল কথায় বার্তায়, চলনে আচরনে।

শিক্ষিত বনেদী ঘরের ছেলে ছাড়া বিয়ে দিবেন না মেয়েকে এই ছিল নানার ইচ্ছা। বাবা তখন কিশোরগঞ্জ মহকুমা শহরে অবস্থান করছিলেন কাৰ্যব্যাপদেশে। কিশোরগঞ্জের তারাপাশার বড় খালু প্রখ্যাত ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞানী শাহ হাকিম মুহাম্মাদ আব্দুল হাই এর সঙ্গে ছিল পরিচয়। তারই বোন জামাই সৈয়দ মলু মিঞার পুরান থানা এলাকায় বিরাট এলোপ্যাথিক দোকান ছিল। তা ছাড়া আরও বহু ঘরবাড়ি জায়গা যমীন ছিল পুরান থানা ও গৌরাঙ্গ বাজার এলাকায়। তিনিও ছিলেন অকৃত্রিম বন্ধু। তাদেরই প্রচেষ্টায় বিয়ে হয় বাবা মার।

আমাদের এলাকার বৃটিশ যুগের বড় এক ধনী ব্যবসায়ী অনেক চেষ্টা করেছিল বহু টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে বাবার কাছে তার কন্যা অর্পণের। তারা এলাকার অনেক বনেদী পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করেছিল টাকার জোরে। এমনকি ঘোড়াশালের বিখ্যাত মিঞাদের সঙ্গেও ছিল তাদের আত্মীয়তা। কিন্তু দাদু খুবই বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তা। তখন তিনি বলেছিলেন, আমার স্বামী দুটি আমানত রেখে গেছেন আমার কাছে, ইয়াতিম দুটো ছেলে আর তার বংশ মর্যাদা।

তার আমানতের খেয়ানত করতে পারি না আমি। তাই তৎসময়ে সৈয়দজাদী ও শিক্ষিতা দেখে পুত্রবধু হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন আমার মাকে। বাবাকে পেয়েও খুশি ছিলেন তার আত্মীয় স্বজনরা। মার এক বৃদ্ধা চাচী ছিলেন। তিনি বলতেন লুলু (এই নামে ডাকতেন মাকে, আরবী শব্দ, অর্থ পান্না) এর জামাই মাষ্টার। মাষ্টার খুব ভালো। অন্য জামাইদের তিনি এত স্বীকৃতি দিতেন না।

মা ছিলেন খুবই ধৈয্যশীলা এবং বিচক্ষন । আমরা চৌদ্দ ভাই বোনকে তিনি কিভাবে সামলাতেন আজো ভাবলে আশ্চর্যবোধ করি। মারামারি, গালাগালি তার ধাতেই ছিল না, খুবই অনুচ্চ কণ্ঠে ধীরে ধীরে কথা বলতেন। কথা খুব কম বলতেন। এত লজ্জাশীলা ছিলেন যে আমাদের দিকেই পুরো চোখে তাকাতে দেখিনি। পরিশ্রমী ছিলেন। নিজের হাতে ঘর বাড়ি সাফ সুতরো করতেন, রান্নাবান্না করতেন। রান্না হত খুবই সুস্বাদু।

আমার জৌষ্ঠ বোনজামাই ঘোড়াশাল মিয়া বাড়ির আশুনী মিয়ার ভাতিজা সৈয়দ আব্দুল আজিজ (রহ.) বলতেন, মার হাতের মুরগীর কোরমা আর মাছের ঝোলের স্বাদ আর কোথাও পাইনি। শিল্পবোধ ছিল খুবই সূক্ষ। সূচিকর্মে ছিলেন দক্ষ পারদর্শী। চিত্র-বিচিত্র পাতা ফুল, আল্লাহর নামাঙ্কিত নানা চিত্রসূচি সৌকর্মে ভাসিয়ে তুলতেন। কাঁথা সেলাইয়ে ছিল অপুর্ব দক্ষতা, নকশি কাঁথায় ছিল নিপুনতা। খুবই কোমল হত তার কাঁথা সেলাই। এখনও আমি একটা কাঁথা হামেশাই বুকে চেপে ঘুমাই। স্নেহের নাতনী তীনাকে শেষ একটা নিপুন নকশী কাঁথা উপহার দিয়ে দিয়েছিলেন যা আমাদের গর্বের সংগ্রহ। কাউকে কষ্ট দেয়া তাে দূরের কথা এমনকি নিজের কোন ব্যথা ‘উহ’ বলেও প্রকাশ করতেন না। খুবই চাপা স্বভাবের ছিলেন। অম্লান বদনে সব ব্যথা বেদনা শােক সহ্য করেছেন। আল্লাহর দরবারে সবর করেছেন। কোন অভিযােগের স্বর শােনা যায়নি তার কণ্ঠে। এমনকি আনন্দের সময়ও কেবল স্মীত হাসতেন। এর বেশি প্রকাশের উল্লাস ঘটত না তার মাঝে।

হে আল্লাহ, আমার এতগুলাে সন্তান, আমার কোন শক্তি নেই, সামর্থ্য নেই, তুমিই দিয়েছ মেহেরবাণী করে, কেন দিয়েছ তা তুমিই জানো, দয়া করে এদের মানুষও করে দাও তুমিই।

এত সন্তান বৎসল ছিলেন এবং তাদের শিক্ষিত করার এত প্রবল ছিল যে আমাদের পড়াশােনার জন্য গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে এসেছিলেন, যদিও শহরে থাকা তার জন্য কষ্টকর ও অপছন্দনীয় ছিল। তিনি বলতেন আমি কেবল আল্লাহর কাছে যাঞ্চা করতাম, হে আল্লাহ, আমার এতগুলাে সন্তান, আমার কোন শক্তি নেই, সামর্থ্য নেই, তুমিই দিয়েছ মেহেরবাণী করে, কেন দিয়েছ তা তুমিই জানো, দয়া করে এদের মানুষও করে দাও তুমিই। খুবই দানশীল ছিলেন। জীবভর দান খয়রাত করে গেছেন। জীবনের শেষ সময়ে তার সঞ্চিত চার হাজার ডলার গরীব ও দরিদ্র কল্যাণে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে একটা ট্রাষ্ট করে গেছেন। টাকাটা তার পঞ্চম পুত্র ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চ শিক্ষা প্রাপ্ত বায়ােকেমিষ্ট বিজ্ঞানী নজমুদ্দীন মাসুমের তত্বাবধানে আছে।

বিনয়ী ছিলেন খুবই। মুখের উপর যদি কেউ কিছু বলতাে তবুও কোন জবাব দিতেন না। ক্ষমা করে দিতেন। বলতেন, প্রতোত্তর দিয়ে কি লাভ? তাহলে তাে আমিও তার মত হয়ে গেলাম, আল্লাহ দেখবেন। আমানত আদায়ের খুব লক্ষ্য রাখতেন। এমনকি ছােট খালার সামান্য কয়েকটা টাকা পাওনা ছিল বাবার কাছে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তার ব্যবসায়ী পুত্র কিশােরগঞ্জ বনিক সমিতির সক্রিয় সদস্য নেসারুদ্দীন মাহফুজকে ডেকে নিজে থেকে সে পয়সা দিয়ে খালার কাছে পৌঁছে দিতে নির্দেশ দেন। অথচ খালা নিজেও ভুলে গিয়েছিলেন সে টাকার কথা।

শিক্ষা অর্জন ও শিক্ষা দানে খুব আগ্রহী ছিলেন। গ্রামের বাড়িতে যতদিন ছিলেন গ্রামের মেয়েদের ডেকে এনে কোনরূপ পারিশ্রমিকের কল্পনা না করেই তাদের শিক্ষা দিয়েছেন। বহু মেয়েরাই মার কাছে কুরআন মাজীদ শিখেছে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রাথমিক পাঠ লাভ করেছে।

বাবার সাথে তার দাম্পত্য জীবন ছিল প্রায় ষাট বছরেরও অধিক কালব্যাপী। কিন্তু তাদের পরস্পরে কোন মনােমালিন্য বা কলহ দেখেনি আমরা। বাবার সম্পর্কে তার খুব উচ্চ ধারণা ছিল। আমাদের তিনি বলতেন, তোমার বাবার কোন লােভ ছিল না। উঁচু দরের মানুষ।

কাউকে কোনদিন লজ্জা দিয়ে কথা বলতে পারতেন না। এমনকি নিজের ক্ষতি স্বীকার করেও অন্যকে লজ্জা থেকে বাঁচাতে তৎপর থাকতেন। একবার প্রতিবেশী এক মহিলা আমাদের বাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে যায় বেশ কিছু চাল। তিনি ধরতে পেরেও তাকে বললেন, জলদি নিয়ে চলে যা, তােকে অন্য কেউ দেখে ফেললে খুব লজ্জা পাবি।

আমেরিকা প্রবাস জীবনে শেষের দিকে তিনি দূরারােগ্য লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আগে দুঃস্বপ্ন দেখতেন, কে যেন তার পা চেপে ধরেছে। তিনি পা তুলতে পারছেন না। আমি বড় ছেলে মাওলানা হিসাবে টেলিফোনে একবার বললে আমি অশরীরী কিছুর চাপ ভেবে কিছু তাবিজ কবজ দিয়েছিলাম মার সান্ত্বনার জন্য, পরে বুঝেছিলাম, এটা হয়ত ক্যান্সারের জীবাণুর কোন প্রতীকী রূপ দেখতে পেয়েছিলেন আগেই। মনে হয় তখনই যদি চিকিৎসা করা যেত তবে আশা করা যেত যে আরাে হায়াত পেতেন। কিন্তু আল্লাহই ভাল জানেন।

তার আচার ব্যবহারে এত স্নেহময়তা ও ভদ্রতার ছাপ ছিল যে বিধর্মী হিন্দু খৃষ্টান মহিলা পুরুষরাও তার প্রতি অনুরক্ত ছিল । আমেরিকার যে মহিলা নার্স তার দেখাশােনা করতেন তিনি বলতেন, আমি তার জন্য গির্জায় যেয়ে প্রার্থনা করি, গড যেন তাকে ভালো করে দেন। এমন একজন মায়ের জীবিত থাকা, সুস্থ হয়ে উঠা খুবই বড় কাজ।

বার্ধক্যেও মার গায়ের চামড়া খুবই মসৃন ছিল। ঐ খৃষ্টান নার্স অনেক সময় মার চামড়ায় হাত বুলাতে থাকত আর বলত, এমন মসৃন চামড়া যদি আমার হত! আমাকে আপনি আপনার এই মসৃনতা দান করে দেন। মা স্মীত হাসতেন।

শেষ বিদায়ের দিন অযু করে কাপড় বদলালেন এবং আল্লাহ আল্লাহ বলতে বলতে চলে গেলেন। সারা চেহারায় উজ্জল স্নিগ্ধতার আভা ফুটে উঠেছিল তখন।

মৃত্যুর কিছু দিন আগে মা এতটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন যে প্লেনে চড়ার ধকল সইবার মত শক্তি হয়ে উঠল। আমরা সকলেই পরামর্শ করে মাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে মনস্থ করলাম। মাহমুদ মাকে নিয়ে বেশ ভালাে ভাবেই ঢাকায় পৌঁছল। ঢাকায় আমার বাসায় মা উঠলেন। বাবাও এখানেই থাকতেন। আল্লাহর মর্জি কিছুদিনের মধেই আবার তার স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি দেখা দেয়। ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।

ভাইবােনেরা হােমিওপ্যাথিক ইউনানী, কবিরাজী, ঝাড়ফুঁক সবধরনের চিকিৎসা করল। কিন্তু আল্লাহ পাক তাকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে মনস্থ করলেন। শেষ বিদায়ের দিন অযু করে কাপড় বদলালেন এবং আল্লাহ আল্লাহ বলতে বলতে চলে গেলেন। সারা চেহারায় উজ্জল স্নিগ্ধতার আভা ফুটে উঠেছিল তখন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তারিখটি ছিল ৪ঠা আগষ্ট রবিবার ২০০২ সাল। পৃথীবিতে প্রায় পঁচাত্তরটি বসন্ত করেছিলেন অতিবাহিত।

হে দয়াময়, আরহামুর রাহিমীন, বেহেস্ত কুল রমণীর সর্দার তারই ঊর্ধ্বতন রক্ত হযরত ফাতিমা (রা.) সাথে জান্নাতে জায়গা দিও এই অধন্তন কন্যাকে। আমাদের নেক আমল ও দোয়া দুরূদের সওয়াব পৌছে দিও তার পবিত্র রুহে। আমীন, ছুম্মা আমীন, ইয়া আরহামার রাহিমীন।

‘পাথেয়’ সম্পাদক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *