গরিব মেধাবী ছেলে সালমান। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিল। এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। শিক্ষকদের আশা- ‘সালমান জেএসসিতেও ভালো করবে, প্রতিষ্ঠানের সুনাম বয়ে আনবে।’ ইতোমধ্যে পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন ফলাফলের জন্য অপেক্ষা। দেখতে দেখতে দুইমাস কেটে গেল। যথাসময়ে ফলাফল প্রকাশ হলো। শিক্ষকদের আশার প্রতি সম্মান দেখিয়ে এবারও ভালো ফলাফল করলো সালমান। গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়ে পুরো থানায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে। এমন ফলাফলে উজ্জ্বল হয়ে উঠে আত্মীয়-স্বজন ও শিক্ষকদের মুখ। তার বাবা বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হতেন। সরকার ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সংবর্ধনা দিল তাকে। পেল সনদ, ক্রেস্ট ও নগদ অর্থ। চল্লিশ হাজার টাকার মতো জমা হলো পুরস্কার বাবদ। সালমানের মা এবং বড় ভাই গিলমান বললো, ‘তোমার এ টাকা সংসারে খরচ করা হবে না। কোনো ঋণগ্রহিতাকে দিলে প্রতিমাসে কিছু লভ্যাংশ পাবে। সেখান থেকে তোমার পড়াশোনায় খরচ করতে পারবে।’
সালমানের এক শিক্ষক শুনে বললেন, ‘এমনটি করা ইসলামসম্মত নয়। সমাজের প্রচলিত এ নিয়মে তোমাকে যে লভ্যাংশ দেবে, তা সুদের অন্তর্ভুক্ত। সুদ গ্রহণ বৈধ নয়। এরচে’ বরং তুমি এক কাজ করতে পারো, টাকাটা দিয়ে কিছু সোনা কিনে রেখে দাও। সোনার দাম দিন দিন হু হু করে বাড়ছে। বেশি দাম পেলে বিক্রি করে দেবে। এতে বৈধ পন্থায় মুনাফা পাবে।’
শিক্ষকের পরামর্শে সে তাই করলো। শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে চল্লিশ হাজার টাকায় একভরি পরিমাণ একটি সোনার চেইন কিনে রেখে দিল।
এরপর আগ্রহ-উদ্দীপনার সঙ্গে চলতে থাকে তার পড়াশোনা। চার ভাই-বোনের সংসারে মা অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করান তাকে। বড় ভাইও তার পড়াশোনার প্রতি খেয়াল রাখে। এভাবে কেটে গেল আরো দুটি বছর। নিয়মিত ভালো ফলাফল করে নবম পেরিয়ে উত্তীর্ণ হলো দশম শ্রেণিতে। এর মধ্যে সালমান একদিন জুয়েলারিতে গিয়েছিল চেইনটি নিয়ে। তখন পঞ্চাশ হাজার টাকা দাম উঠেছিল সেটির। ফেরত এনে সযত্নে রেখে দেয় চেইনটি। মূলত দাম জানতেই গিয়েছিল সে। এসএসসি’র ফরম ফিলাপের সময় ঘনিয়ে এলে তার ভাইকে চেইনটি দিয়ে পাঠায় জুয়েলারিতে। এবার দাম হয় আটচল্লিশ হাজার। সোনার দাম ওঠানামা করে। দাম নামা দেখে ফেরত নিয়ে আসে। আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় ফরম ফিলাপ সম্পন্ন হয় তার। এসএসসিতেও গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়ে পাস করে সে। এবার আগের মতো তেমন সংবর্ধনা বা পুরস্কার পায়নি।
দুই.
ক’মাস হলো সালমানের ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। এখন আর আগের মতো তার লেখাপড়ার খোঁজ-খবর রাখে না। এমতাবস্থায় গ্রামে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া কঠিন। সালমানের ইচ্ছা শহরের ভালো কোনো কলেজে ভর্তি হবে। সে শুনেছে, ঢাকায় টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালানো যায়। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে সে কোথায় উঠবে। তার তো কিছুই চেনাজানা নেই। একা কখনো যায়ওনি।
সালমানের মা দূর সম্পর্কের এক মামার সঙ্গে যোগাযোগ করে তার থাকার ব্যবস্থা করলেন। তিনি ঢাকার মুহাম্মদপুরে থাকেন। তৃতীয় তলার নিজস্ব ফ্ল্যাটে স্ত্রী, ছোট এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে থাকেন এহসান সাহেব। খুব ভালো ও দয়াশীল মানুষ। তার ফ্ল্যাটের একটি রুম খালিই পড়ে থাকে। অনায়াসে ব্যবস্থা হওয়ায় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে সালমান ও তার মা।
‘দিল কলা পড়া, হলো কপাল পোড়া’। বাচ্চাদের না পেয়ে মা বিড়ালটি আরো বেশি চেচামেচি শুরু করলো। যেন সালমানের মায়ের মতোই খা খা করছে বিড়ালটির মন। ফাইয়াজ সাহেব বাসায় এসে জানতে পেরে অনেক রাগারাগি করলেন স্ত্রীর সঙ্গে। বললেন, ‘তোমার বাচ্চাদের কোথাও ফেলে আসি, দেখ কেমন লাগে!’
তিন.
একদিন এহসান সাহেবই গ্রামে গিয়ে সালমানকে নিয়ে এলেন বাসায়। স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই তাকে এনেছেন তিনি। কিন্তু এখন স্ত্রীর আচরণে অসম্মতিই প্রকাশ পাচ্ছে। এ নিয়ে প্রায়ই কথা কাটাকাটি হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। মিসেস এহসানের ব্যবহারে লজ্জায় অপমানে চোখ বন্ধ হয়ে আসে সালমানের। এ অবস্থায় তার বাড়িতে ফিরে যাওয়াই যেন ভালো। কিন্তু তাকে তো বাড়ি ফিরে গেলে চলবে না, ভালো পড়াশোনার জন্য রাজধানীর ভালো কলেজে ভর্তি হতেই হবে।
ভাবে অপমান সহ্য করেই দিন যেতে থাকে সালমানের। এর মধ্যে একটি নামকরা কলেজে ভর্তির সুযোগ পায় সে। চলতে থাকে পড়াশোনা। দুটি টিউশনির ব্যবস্থা করে দেন এহসান সাহেব। তার ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর বিষয়টিও মাথায় রেখেছিলেন তিনি। স্ত্রীর অমত দেখে এ ব্যাপারে আর আগে বাড়েননি। মিসেস এহসান সালমানকে একদম সহ্য করতে পারেন না, আবার স্বামীর উপর সরাসরি কিছু বলারও সাহস পান না। কিন্তু তাকে বাসা থেকে তাড়াতে পারলেই যেন বাঁচেন।
এমনি করে সালমানের ঢাকা আসার তিনমাস হয়ে গেল। এর মধ্যে মোটামুটি পথ-ঘাট চিনে ফেলেছে। সে মেসে ওঠার সিদ্ধান্ত নিল। একদিন এহসান সাহেবের রুমে গিয়ে বিনীতভাবে বললোÑ ‘মামা, আমি আর এখানে থাকবো না।’ এর প্রতিউত্তরে তিনি কোনো কথা বলতে পারেননি। এরপর সালমান চেইনের আদ্যোপান্ত শুনিয়ে চেইনটি এহসান সাহেবের হাতে দিয়ে বললো, ‘আমার এটি বিক্রি করে দিন।’ এহসান সাহেব মার্কেট ঘুরে এসে চেইনটি সালমানের হাতে দিয়ে যা বললেন এতে সালমানের পায়ের নিচের মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম- ‘তোমার এটি খাঁটি নয়, নকল’। সে চেইনটি হাতে নিয়ে ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখলো। কোনো পার্থক্য নেই। অবিকল সেটিই, যেটি শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে কিনেছিল। এরপর দুজনের মধ্যে এ নিয়ে আরো অনেক কথা হয়।
চার.
সালমান ঢাকা যাওয়ার পর খা খা করতে থাকে তার মায়ের মন। সে কলেজের ছাত্র হলেও এর আগে এতো দীর্ঘ সময় বাড়ির বাইরে কোথাও গিয়ে থাকেনি। মা সালমানের জামা-কাপড়, জীর্ণ পড়ার টেবিল, পুরনো বইপত্র হাতড়ে তার উপস্থিতি অনুভব করার চেষ্টা করেন। বারকয়েক গিলমানকে বলেন তাকে দেখে আসার জন্য। মাঝে-মধ্যে এটা সেটা করতে গিয়ে ভুলক্রমে সালমানকে ডেকে ফেলেন। কখনো পুকুর পাড়ের বয়স্ক আমগাছটার তলায় বসে সালমানের গমন পথের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন। একসময় সালমানের ছোট ভাই-বোন গিয়ে তুলে নিয়ে আসে।
সালমান যে মাকে ভুলে থাকছে তা কিন্তু নয়। মাকে এক নজর দেখার জন্য তার মনও নীড়হারা পাখির মতো ছটফট করতে থাকে। প্রথম কয়েক রাত সে ঘুমোতে পারেনি। পুরো শহর ঘুমের কোলে ঢলে পড়লে তার চোখের পর্দায় ভেসে বেড়াতো মায়ের মায়াবী চেহারা। লেখাপড়ার জন্য এখন একটু শক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। তবুও প্রিয় মাকে ভুলে থাকতে পারে না। মাঝে-মধ্যে মায়ের সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়। দেখার সাধ কি আর কথায় মিটে?
পাঁচ.
বারান্দার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছেন মিসেস এহসান। ভাবছেন কিভাবে ছেলেটাকে তাড়ানো যায়। তিন-চার বাসা পরে বসবাসকারী ফাইয়াজ সাহেব বিড়াল পোষেন। ক’দিন হলো সেটি একজোড়া বাচ্চা দিয়েছে। সারাদিন মিউ মিউ করে বাসা মাথায় তুলে রাখে বাচ্চা দুটি। মলত্যাগ করে বিছানাপত্র নষ্ট করে ফেলে। তাই মিসেস ফাইয়াজ কাজের মেয়েকে দিয়ে বাচ্চা দুটিকে রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে ফেলে আসে।
‘দিল কলা পড়া, হলো কপাল পোড়া’। বাচ্চাদের না পেয়ে মা বিড়ালটি আরো বেশি চেচামেচি শুরু করলো। যেন সালমানের মায়ের মতোই খা খা করছে বিড়ালটির মন। ফাইয়াজ সাহেব বাসায় এসে জানতে পেরে অনেক রাগারাগি করলেন স্ত্রীর সঙ্গে। বললেন, ‘তোমার বাচ্চাদের কোথাও ফেলে আসি, দেখ কেমন লাগে!’ তাদের ছেলে-মেয়েরাও ছানা দুটি নিয়ে খেলতে বেশ মজা পাচ্ছিল। ওরাও মায়ের উপর রাগ করলো।
এহসান সাহেবের বাসার কাছাকাছিই ছিল ডাস্টবিনটি। মিসেস এহসান এসবই দেখতে পাচ্ছিলেন বারান্দা থেকে। বিড়ালছানা দুটিকে ফেলে যেতেই স্বজনহারা শিশুর মতো ছটফট করতে থাকে ওরা। পাশের গেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে অন্য একটি মাদি বিড়াল। ছানা দুটি মিউ মিউ করে জানান দেয় স্বজন হারানোর বেদনা। মানুষ না বুঝলেও ওরা ওদের ভাষা ঠিকই বুঝে। মাদি বিড়ালটি হাত-পা দিয়ে আগলে ধরলো ছানা দুটিকে। গায়ে মাথায় পরশ বুলিয়ে, জিহ্বা দিয়ে লেইয়ে আদর-ভালোবাসা দিতে লাগলো ওদের। মিউ মিউ করে দিয়ে চললো বিড়ালীয় সান্ত¡না। একসময় কমে এলো ছানা দুটির ছটফটানি। যেন মায়ের আদরের উম খুঁজে পেল এই আগন্তুক বিড়ালের বুকে।
আদরমিশ্রিত মিউ মিউগুলো বোধ হয়ে ভাসতে থাকে বাতাসে। বোধগুলো বাতাসে ভেসে গ্রিলের ফাঁকগলে উঠে আসে তৃতীয় তলার বারান্দায়। চোখ-কান দিয়ে ঢুকে পড়ে মিসেস এহসানের ভেতরে। তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। এক ধরনের তোলপাড় শুরু হয় তার মধ্যে। তিনি সালমানকে ডাকলেন। সালমান তখন স্বপ্নের চেইন নিয়ে ভাবছিলÑ আমি নিজেই প্রতারিত হলাম, নাকি প্রতারণা করলেন অন্য কেউ? মিসেস এহসান সালমানকে বললেন, ‘তুমি আমাদের এখানেই থেকে যাও। আর সিয়াম-সায়মার পড়া নিয়ে একটু বসো। তোমার পড়াশোনার খরচ নিয়ে ভাবতে হবে না…।
patheo24/mr