২৪শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ , ১০ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ , ১লা রমজান, ১৪৪৪ হিজরি
২০০৬ সালের এই দিনে আমাদের চেতনার বাতিঘর আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দা.বা) জালিমের জিন্দানখানা থেকে মুক্তি পান। সেই থেকে প্রত্যেক বছর আমরা এই দিনে সেই স্মৃতিগুলো স্মরণ করি। আধ্যাত্মিক প্রেরণা লাভ করি এই বন্দিত্ব ও শৃংখলমুক্তির ঘটনা থেকে। জালিম শাহির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আদর্শে অবিচল থাকার অনন্য নজীর স্থাপন করেছিলেন আল্লামা ফরীদ মাসউদ। বাঙালি আলেমদের সামনে অনন্য এই নজীর সত্যি এক ঐতিহাসিক ব্যাপার ছিল।
২০০৫ সালের ২২ আগস্ট। আমি তখন দারুল উলূম দেওবন্দ অধ্যয়নরত তালিবুল ইলম। আমার এক বিহারি সহপাঠির সাথে সাইবার ক্যাফেতে যাই বাংলাদেশের খবর পেতে। তখন ইন্টারনেট সহজলভ্য ছিল না। দেওবন্দের বাজারে গিয়ে একটি ক্যাফেতে কম্পিউটারে বসতে হতো দেশের খবর পাওয়ার জন্য। সারা দেওবন্দে সাড়া পড়ে গিয়েছিল আল্লামা মাসউদের গ্রেফতারের সংবাদে। মনে পড়ে, উস্তাদদের মুখে মুখে এই ঘটনা। আল্লামা ফরীদ মাসঊদকে বিএনপি-জামাত সরকার গ্রেফতার করেছে।
দারুল উলূম দেওবন্দে অধ্যয়নরত বাঙালি ছাত্র ভাইয়েরাও উদ্বিগ্ন ছিল এ ঘটনায়। দলমত নির্বিশেষে সবাই এর নিন্দা জ্ঞাপন করছিল। প্রথম যখন আমরা জানতে পেলাম, কোর্টে উঠে আল্লামা মাসউদ ভাবলেশহীন দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, ‘আমাকে নয়, নিজামীকে জিজ্ঞাসা করলেই বোমা হামলার তথ্য উদ্ঘাটিত হবে’, কী এক ভালো লাগায় ভরে গেল আমাদের মন। এ তো সেই আকাবির আসলাফের সাহস ও হিম্মত। আমাদের বলতে ইচ্ছে হলো, ‘উলাইকা আবাই ফাজিইনি বিমিসলিহিম.. এরাই মোদের পূর্বসূরি..’। এমন সাহসী উচ্চারণ আর অনন্য দৃঢ়তার দৃষ্টান্ত বাতিলপন্থিরা কোথায় পাবে? কোথায় পাবে এই পাহাড়ের মত দার্ঢ্য?
বর্তমান সময়ে এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী নামধারী আলেম সামান্য জেল হাজতকে যেভাবে ভয় পায় এবং একের পর এক সাহু সেজদা দিয়ে চলে তাতেই বোঝা যায় এদের সামনে কোনো আদর্শ নেই। স্বার্থের টানে তারা ওঠে বসে, কথা বলে, ধর্মকে কেনে বেচে। সকালে এক কথা বলে, বিকালে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। এদেরকে সাধারণ মানুষ পল্টিবাজ মোল্লা অভিধায় অভিহিত করে।
ইসলামের বড় বড় কথা বলা সহজ। ‘রক্তের বন্যা বয়ে যাবে.. জীবন দিয়ে দিব.. আগুন জ্বলবে..’ ইত্যাদি শ্লোগান দেওয়া কঠিন কিছু নয়। কিন্তু কে সত্যিকার অর্থেই ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ তা বোঝা যায় চরম পরিস্থিতিতে। সেদিন আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সামান্য নতি স্বীকার করলেই মাসের পর মাস জেলখানায় অমানসিক কষ্ট বরদাশত করতে হতো না। কিন্তু তিনি তো সেই আকাবির আসলাফের উত্তরপুরুষ, যারা বিন্দু বিন্দু রক্ত ও ঘামে বয়ে এনেছেন ইসলামের চির সবুজ উত্তরাধিকার।
আজ ঐতিহাসিক পনেরই মার্চ। দেখতে দেখতে ষোলোটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। আতংকের সেই দিন হয়ত নেই, তবু একের পর এক কঠিন পরিস্থিতি অতিক্রম করে যেতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। সেই একই রকম দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি আজও ফুটে ওঠে এই জ্ঞানবৃদ্ধের নির্লিপ্ত চোখে। আকাবির আসলাফের ফরজান্দে আরজুমান্দ আল্লামা মাসউদ শতায়ু হোন। তার সব স্বপ্নগুলো পূর্ণতা পাক। নতুন প্রজন্ম আদর্শে অবিচলতার শিক্ষা গ্রহণ করুক ঐতিহাসিক কারামুক্তি দিবস থেকে।
লেখক : শিক্ষক, খতিব, প্রাবন্ধিক ও গবেষক