যাকাতের নিসাব ও বন্টনের খাত

যাকাতের নিসাব ও বন্টনের খাত

দ্বিতীয় পর্ব

মাহতাব উদ্দীন নোমান

যাকাতের গুরুত্ব এবং ফজিলত আলোচনার পরে এখন যাকাতের মৌলিক কিছু বিষয় আমাদের জেনে রাখা দরকার। এখানে শুধুমাত্র যাকাতের মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। বিস্তারিত বিষয় জানার জন্য অবশ্যই স্থানীয় মুফতি সাহেব বা কোন ইফতা বিভাগের শরণাপন্ন হতে হবে।

যাকাত যাদের উপর ফরজ হয় : প্রতিটি স্বাধীন সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ। যদি তারা মৌলিক প্রয়োজনাতিরিক্ত ঋণমুক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের পূর্ণাঙ্গ মালিক হয় এবং তার ওপর চন্দ্র বছর অতিবাহিত হয়। যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য এটি শর্ত।

সুতরাং তার সম্পদ যদি মৌলিক প্রয়োজনীয় হয়, বা ঋণ যুক্ত হয়, অথবা সে নেসাব পরিমাণ সম্পদের পূর্ণাঙ্গ মালিক না হয়, অথবা পূর্ণাঙ্গ মালিক হওয়ার পরেও চন্দ্র বছর অতিবাহিত না হয় তাহলে তাদের উপর যাকাত ফরজ হবে না। এছাড়া পাগল, বা অপ্রাপ্তবয়স্ক, বা অমুসলিমের উপর যাকাত ফরজ নয়।

যে সকল সম্পদের উপর যাকাত ফরজ হয় : ১. স্বর্ণ, যার নেসাব হল সাড়ে সাত ভরি। শুধু স্বর্ণ যদি সাড়ে সাত ভরির কম থাকে তাহলে তার উপর যাকাত ফরজ হবে না। ২. রুপা, যার নেসাব হল সাড়ে বায়ান্ন ভরি। (রুপার সাড়ে ৫২ ভরির বর্তমান বাজার মূল্য আসে ৫০০০ টাকা) শুধু রুপা যদি সাড়ে ৫২ ভোরের কম থাকে তাহলে তার ওপর যাকাত ফরজ হবে না। ৩. ব্যবসায়িক পণ্য, যে পন্যটি ক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যমে ব্যবসা করার উদ্দেশ্য থাকে। এ জাতীয় পণ্যের বিক্রয় মূল্য যদি রুপার নেসাবের সমান বা বেশি হয় তাহলে তার উপর যাকাত আসবে। ৪. নগদ টাকা, রুপার নেসাব পরিমাণ হলে বা তার থেকে বেশি হলে এর উপর যাকাত আসবে।

কারো কাছে কিছু স্বর্ণ আর কিছু রুপা আছে। আলাদাভাবে কোনটাই নেসাব পরিমাণ নেই। তখন দেখা হবে উভয়টিকে একত্রিত করলে মূল্য কত হয়। যদি তা যেকোন একটির নেসাব পরিমাণ হয়ে যায়, তাহলে যাকাত দিতে হবে।

ঠিক তেমনি ভাবে কারো কাছে কিছু স্বর্ণ বা রুপার অলংকার আছে, সাথে কিছু নগদ টাকা বা ব্যবসার কিছু পণ্য আছে। অলংকার বা নগদ টাকা বা ব্যবসার টাকা কোনটাই আলাদা আলাদাভাবে নেসাব পরিমাণ নাই। কিন্তু সবগুলোকে একত্রিত করলে যদি তা রুপার নেসাব সমপরিমাণ হয়ে যায়, তাহলে যাকাত দিতে হবে।

ঋণ দুই ধরনের হয়ে থাকে। ক. প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য বাধ্য হয়ে যে ঋণ নেওয়া হয়। খ. ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যে ঋণ নেওয়া হয়। প্রথম প্রকারের ঋণ সম্পদ থেকে বাদ দিয়ে যাকাতের নিসাব থাকলে যাকাত ফরয হবে, অন্যথায় নয়। কিন্তু যে সকল ঋণ উন্নয়নের জন্য নেওয়া হয় যেমন কারখানা বানানো, কিংবা ভাড়া দেওয়া বা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বিল্ডিং বানানো অথবা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নিলে যাকাতের হিসাবের সময় সে ঋণ ধর্তব্য হবে না। অর্থাৎ এ ধরনের ঋণের কারণে যাকাত কম দেওয়া যাবে না। তবে যদি প্রতিবছর ঋণ পরিশোধের তাগাদা থাকে, তাহলে প্রতি বছর পরিশোধীয় ঋণ ওই পরিমাণ সম্পদ থেকে বাদ দিয়ে যাকাত দিতে হবে।

অন্যকে যে টাকা কর্জ হিসেবে দেওয়া হয়েছে বা ব্যবসায়ী কোনো পণ্য বাকিতে বিক্রয় করেছে এই পাওনা টাকা পৃথকভাবে বা অন্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে মিলিতভাবে নিসাব পূর্ণ করলে তারও যাকাত দিতে হবে। পাওনা উসূল হওয়ার পর ওই টাকার যাকাত আদায় করা ফরয হয়। তার আগে আদায় করা জরুরি নয়, তবে আদায় করলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।

যাকাতের পরিমাণ : পূর্ববর্তী শর্তসমূহ পরিপূর্ণভাবে পাওয়া গেলে সর্বমোট সম্পত্তির চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত প্রদান করতে হবে। স্বর্ণ-রুপা এবং ব্যবসায়িক পণ্যের যাকাত মূল বস্তু দিয়ে দেওয়া যায় আবার টাকা দিয়ে দেওয়া যায়। টাকা দিয়ে যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে স্বর্ণ-রুপা এবং ব্যবসায়িক পণ্যের বর্তমান বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে তার চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে।

যে সব সম্পদের যাকাত আসে না : নিম্নোলিখিত সম্পদগুলোর যাকাত আসে না। এই সব সম্পদের মূল্য যত বেশিই হোক না কেন। ১. বসবাসের ঘর বাড়ি। ২. ভাড়া দেওয়ার ঘর বাড়ি। তবে তার থেকে ভাড়া বাবদ যে টাকা আসবে, তা নেসাব পরিমাণ হলে এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ওই টাকার যাকাত দিতে হবে। ৩. ব্যবহার্য কাপড়-চোপড়, চাদর, বিছানা ইত্যাদি। ৪. ঘরের আসবাবপত্র। যেমন ফার্নিচার, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি। ৫. বাহন। যেমন প্রাইভেট কার, মোটর সাইকেল, সাইকেল ইত্যাদি। তবে এগুলো ভাড়ায় চালিত হলে ভাড়া বাবদ টাকার ওপর পূর্ব শর্ত অনুযায়ী যাকাত আসবে। ৬. ঘরে রাখা খাবারের জিনিসপত্র। যেমন চাল, গম, আলু, পিয়াজ ইত্যাদি। ৭. স্বর্ণ-রুপা ছাড়া অন্যান্য সাজসজ্জার জিনিসপত্র। ৮. হীরার তৈরি অলংকারাদি। যদি তা ব্যবসার উদ্দেশ্যে না রাখা হয়। ব্যবসার উদ্দেশ্যে হলে যাকাত ফরয হবে। ৯. পড়ার উদ্দেশ্যে রাখা বইপত্র। ১০. পেশাজীবীদের বিভিন্ন জিনিসপত্র। যেমন মেশিন, কারখানা, ভাড়ায় চালিত গাড়ি, বাস, ট্রাক এবং কৃষকদের কৃষিকাজের সামগ্রী, যেমন ট্রাক্টর, লাঙ্গল জোয়াল ইত্যাদি। অথবা যে সকল জিনিস ক্রয়ের সময় এগুলো বিক্রির দ্বারা ব্যবসা করার উদ্দেশ্য হয় না।

যাদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে : সূরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকাতের খাত বর্ণনা করেছেন। বর্তমান যুগে ৫ শ্রেণীর ব্যক্তি কে যাকাত দেওয়া যায়। ১. ফকির, যার কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই। ২. মিসকিন যার কাছে কোনো সম্পদ নেই। ৩. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, যার কাছে ঋণ পরিশোধের কোনো সম্পদ নেই। ৪. মুসাফির ব্যক্তি, যে সফররত অবস্থায় ফকির হয়ে গেছে। যদিও তার বাড়িতে অনেক সম্পত্তি রয়েছে। ৫. আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধরত মুজাহিদ।

বাবা-মা দাদা-দাদি নানা-নানি ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনি এবং স্বামী স্ত্রী ব্যতীত অন্যান্য যেকোনো সম্পর্কের নিকটাত্মীয়রা যাকাত পাওয়ার বেশী হকদার। তাদের যাকাত দিলে দ্বিগুণ সওয়াব হবে। একটি যাকাত আদায়ের সওয়াব, অপরটি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার সওয়াব। যেমন ভাই-বোন, চাচা ফুফু মামা ভাতিজা ভাগিনা এরা যদি অভাবগ্রস্ত হয় তাহলে তাদেরকে যাকাত দেওয়া বেশি উত্তম।

কোন অভাবগ্রস্ত আলেম, মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জেন, খাদেম বা মাদ্রাসার ছাত্রকে যাকাত দিলেও দ্বিগুণ সওয়াব হবে। তবে তাদেরকে বেতন বাবদ যাকাতের টাকা দিলে যাকাত আদায় হবে না।

যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে নগদ টাকা বা কোন বস্তুর পরিপূর্ণ মালিক বানিয়ে দেওয়া শর্ত। মালিক না বানিয়ে কোন বস্তু দিয়ে শুধু উপকৃত হওয়ার সুযোগ দিলে যাকাত আদায় হবে না।

কোন প্রতিষ্ঠানে বা সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে বা কোন জনকল্যাণমূলক কাজে যাকাতের টাকা দিলে যাকাত আদায় হবে না। যাকাত আদায় হওয়ার জন্য যাকাত প্রদানের নিয়ত করা জরুরি। অথবা যাকাতের টাকা আলাদা করার সময় নিয়ত করলেও যথেষ্ট।

যাকাত যোগ্য ব্যক্তিকে এই পরিমাণ যাকাত দেওয়া মুস্তাহাব যা একদিন তার এবং তার পরিবারের জন্য যথেষ্ট হয়। তবে একেবারে নেসাব পরিমাণ অর্থ দেওয়াও অনুচিত। নেসাব পরিমাণ অর্থের কমে অর্থ দিয়ে তাকে কোন ব্যবসায় ধরিয়ে দেওয়া টা বেশি উত্তম।

যাদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে না : ১. নিজের উর্দ্ধতন আত্মীয়কে। যেমন পিতা দাদা-দাদী বা এদের উপরের আত্মীয় অথবা নানা-নানি বা এদের উপরের আত্মীয়। ২. নিজের অধঃস্তন আত্মীয়কে। যেমন ছেলে মেয়ে নাতি-নাতনি বা এদের নিচের আত্মীয়। ৩. অমুসলিমকে। ৪. নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিককে। ৫. বনি হাশিম বংশের লোকজনকে।

(উপরোক্ত যাকাতের মৌলিক মাসআলাগুলো মুফতি সালমান মনসুরপুরী দামাত বারাকাতুহুম রচিত কিতাবুল মাসায়েল থেকে সংক্ষিপ্তাকারে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এই কিতাবটি রাহনুমা প্রকাশনী থেকে অনুবাদ বের হয়েছে।)

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের যাকাতগুলো খুব সুন্দর করে আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: খতীব ও শিক্ষক

পড়ুন প্রথম পর্ব: যাকাত আদায়ের গুরুত্ব ও হিকমত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *