যৌতুক ও মরিয়মের মৃত্যু

যৌতুক ও মরিয়মের মৃত্যু

  • মনজুর সা’দ

মতি মিয়া। এলাকার একজন সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ। দিনে এনে দিন খান। সংসার চলে না। বয়সও হয়ে গেছে। এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। আল্লাহ তাঁর ঘরে সুন্দর ফুটফুটে একটা কন্যা দান করেছেন। কন্যা জন্ম হওয়ার পর তার মা রহিমা বেগম পরপারে পাড়ি জমান। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আর দ্বিতীয় বিয়ে করেনি মতি মিয়া৷

এখন মেয়েটা বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। দেখতে শুনতে খুব ভালো। কিন্তু মতি মিয়া বিয়ে দিতে পারছেন না। অনেক জায়গা থেকে ঘর আসে। পছন্দ করে ঠিকই কিন্তু সমাজে যে প্রথা চালু হয়ে আসছে তার জন্য আর হয় না! এখন তো সাধারণ মানুষ মেয়ে জন্ম নেওয়ার পর মুখে হাসি আসার বদলে কাশি আসে। কালো জামের মতো মুখ কালো হয়ে যায়। বিয়ের জন্য মেয়েকে পছন্দ করার পর ধর কষাকষি করেন ছেলের বাবা।দেখে মনে হয় মাছের বাজারে তাজা মাছ কিনতে আসছেন।

দুদিন আগের কথা। পাশের এলাকা থেকে একটা ঘর আসল। মেয়েকে দেখে সবাই মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ খুব সুন্দর বলে প্রশংসা করলেন। কিন্তু যখনই বিয়ের দিন তারিখ নির্ধারণ করতে যাবে ঠিক সে সময় ছেলের বাবা মতি মিয়াকে এক পাশে নিয়ে বললেন, বিয়াই সাহেব, মেয়ে তো মাশাল্লাহ ভালাই। কিন্তু আসল কথা হলো আমার একটাই ছেলে। অনেক শখ ছিল সরকারি একটা চাকরি করবে কিন্তু…
– কিন্তু কিন্তু করছেন ক্যান? বলে ফেলান।
– চাকরির জন্য লাখ দু’য়েক দিলেই হবে। বেশি কিছু চাইছি না। অল্পই চাইলাম আর কি। হাহা।

মতি মিয়ার বলতে ইচ্ছে করছে, ছেলে নিয়ে ব্যবসা শুরু কইরা দিছোস হ্যাঁ? চোখের সামনে থেকে দুই শো হাত দূর হ। দূরে গিয়ে মর।’

মতি মিয়া অনেক চেষ্টা করেছেন যৌতুক ছাড়া মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কোনো ভাবেই পারছেন না। এ সমাজে যৌতুক ছাড়া বিয়ে হয় না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাই একই কথা বলে।

গত কয়েক দিন ধরে মতি মিয়ার চোখে ঘুম নেই। মানুষের ধারে ধারে ঘুরে কিছু টাকা ঋণ নেওয়ার জন্য। কিন্তু কেউ তাকে ঋন ও দিতে চায় না। সময় খারাপ হলে যা হয় আর কি! যদি সময় মতো টাকা না দিতে পারে তখন কে দেবে!

আরও পড়ুন: আয়েশা, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা

চোখের সামনে বাবার এহেন পরিস্থিতি দেখে মরিয়মের খুব কষ্ট হয়। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘ধ্বংস হোক এই অভিশপ্ত সমাজ। যেখানে টাকা ছাড়া নারীদের মর্যাদা দেওয়া হয় না।’

অনেক কষ্টে মতি মিয়া পয়ষট্টি হাজার টাকা জোগাড় করেছেন। লাখ খানেক টাকা দিতে হবে। বিয়ের সময় শর্ত ছিল। বিয়ের পর বেশ কিছু দিন ভালো কাটল। হঠাৎ করে শ্বশুরবাড়ির লোকজন মরিয়মকে মারধর শুরু করেছে। বাকী টাকার জন্য। সে কার কাছে নালিশ করবে? তার জামাই একটা লোভী প্রকৃতির লোক। সেও তাকে নানাভাবে কষ্ট দেয়।

মরিয়ম শ্বশুরবাড়ির লোকদেরকে হাত জোর করে বলেছেন, ‘আপনারা কিছু দিন সময় দেন। বাবা দিয়ে দিবে। শরীরটা তার ভালো না। বৃদ্ধ মানুষ। এখন বলতে পারব না বাবাকে। আগের টাকার ঋণ এখনো পরিশোধ করতে পারেনি। এখন কোত্থেকে দিবেন বেচারা!’ কে শুনে কার কথা!

মরিয়মের শ্বশুড়ি পেটে লাথি মেরে বলল, ‘গরীবের মাইয়া হয়ে বড় গলায় কতা কস। তোর সাহস তো কম না। তোর বাপে টেকা দিতে পারব না আগে কইতো৷ এহন কস ক্যান? ঐ মানিক তোর বউয়েরে তুই মার। ইচ্ছে মতন মার। মরলে মরুক। জেল জরিমানা অইলে অইব তাও এর বাপ থেইকা টেকা আদায় করে ছাড়মু।’

মরিয়মের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। পাশের বাড়ির লোকজন ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তার বাবু মরিয়মের ডান হাতের রগ চেপে ধরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দুঃখিত, সে আর বেঁচে নেই!’

মতি মিয়া মেয়ের লাশের পাশে বসে চোখের জল ফেলে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘মরিয়ম, তুই আমারে রাইখে গেলি ক্যান? তুই ছাড়া আমার কে আছে? মা,আমারেও নিয়ে যা!’

লেখক: শিক্ষার্থী,জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *