রং নাম্বার | সাখাওয়াত রাহাত
রাবেয়ার ফোনে অচেনা নাম্বার থেকে কল এলো! সালাম দিয়ে কল রিসিভ করতেই তিনি বুঝতে পারলেন- ভুলবশত তাঁকে কল করা হয়েছে। তাই ‘দুঃখিত! রং নাম্বার’- বলেই তিনি ফোন কেটে দিলেন। ওদিকে কলদাতা যখন বুঝতে পারল- এটি একটি মেয়ের নাম্বার তখন সে ওই রং নাম্বারে ক্রমাগত কল করতেই থাকল! কিন্তু অসংখ্যবার কল দেওয়ার পরও যখন রাবেয়া ফোন রিসিভ করছিলেন না; তখন ছেলেটি ওই নাম্বারে নানা ধরনের ম্যাসেজ পাঠাতে শুরু করল- ‘জান! ফোনটা রিসিভ কর!’ ‘আমার সঙ্গে কথা বল!’ ‘তুমি ফোনটা রিসিভ করছ না কেন?’ ‘অন্তত একবার আমার সঙ্গে কথা বল!’
রাবেয়ার শাশুড়ি ছিলেন কুৎসিত মনের অনেক ঝগড়াটে এবং সন্দেহপ্রবণ একজন মহিলা! তিনি রাবেয়াকে একদমই সহ্য করতে পারতেন না! এর অন্যতম একটি কারণ ছিল- রাবেয়ার ননদকে তাঁর বড়ভাই ‘রাসেল’ বিয়ে করেছেন; কিন্তু স্বামীর ঘরে ননদ সুখী ছিলেন না! তাই রাবেয়ার শাশুড়ি তার মেয়ের জামাইয়ের সব রাগ-ক্ষোভ পুত্রবধূর ওপর মেটাতেন! পান থেকে চুন খসলেই তাঁর ওপর দজ্জালি করতেন! কোনো বাহানা না পেলে নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে তাঁকে গালমন্দ করতেন!
একদিন পর সকালে রাবেয়া যখন রান্নাবান্নায় ব্যস্ত তখনই সেই ছেলে আবারো তাঁর নাম্বারে কল দিতে লাগল! কয়েকবার রিং বাজার পর শাশুড়ি এসে ফোন রিসিভ করলেন! ওপাশে ছেলের কণ্ঠ শুনে তিনি চুপ মেরে রইলেন! ছেলেটি লাগাতার বলতে থাকল- জান! আমার সঙ্গে কথা বল না কেন? প্রিয়তমা! চুপ করে আছ কেন? কথা বল না প্লিজ! তোমার কণ্ঠস্বর আমাকে মাতাল করে দিয়েছে! তোমার আওয়াজ শুনতে আমি ব্যাকুল হয়ে আছি! শাশুড়ি কোনো কথা না বলে লাইনটি কেটে দিলেন।
রাতে রাবেয়ার স্বামী ঘরে ফেরা মাত্রই শাশুড়ি তাকে নিজের রুমে ডেকে নিয়ে গেলেন। ছেলের কাছে পুত্রবধূর ওপর তিনি দুশ্চরিত্রা ও পরপুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের অপবাদ আরোপ করলেন! স্বামী তার মায়ের কথা শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠলেন! স্ত্রীর কোনো কথাই তিনি কানে নিলেন না! দরজা বন্ধ করে হাতের কাছে পাওয়া লাঠি দিয়ে পিটিয়ে স্ত্রীকে রক্তাক্ত করে ফেললেন!
রাবেয়াকে আধমরা করে স্বামী যখন রুম থেকে বের হলেন; তখন শাশুড়ি সেই মোবাইলটা ছেলের হাতে ধরিয়ে দিলেন! এরপর মুখ বাঁকা করে বললেন: দেখ! এখানে তোমার স্ত্রীর প্রেমিকের নাম্বার আছে!
স্বামী প্রথমে কললিস্ট এবং পরে ম্যাসেজ চেক করলেন! ম্যাসেজবক্সে সেই ছেলের পাঠানো সবগুলো ম্যাসেজই ছিল! ক্রোধান্নিত স্বামী সেসব ম্যাসেজ দেখে স্ত্রীর ওপর আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠলেন!
ওদিকে শাশুড়ি রাবেয়ার বড়ভাই রাসেলকে ফোন দিয়ে বললেন, আমরা তোমার বোনকে তাঁর প্রেমিকার সঙ্গে কথা বলা অবস্থায় হাতেনাতে ধরে ফেলেছি! সে আমাদের মান-সম্মান সব ধুলিসাৎ করে দিয়েছে!
ফোন রেখে তখনই রাসেল এবং তা মা রাবেয়ার বাড়ি চলে এলেন! রাবেয়ার শাশুড়ি এবং স্বামী তাঁর ভাই এবং মাকে রাবেয়ার কথা বলে অপমান করতে লাগলেন! তাদের অভিযোগ- রাবেয়া একজন দুশ্চরিত্রা ও ব্যভিচারিনি! সে তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ রাখে! নিয়মিত কথা বলে! তাঁর কারণে আমরা সমাজে মুখ দেখাতে পারছি না!
এসব শুনে তাঁর ভাই প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে ওঠলেন! ভয়ে যবুথবু হয়ে থাকা রাবেয়ার চুলের মুঠি ধরে তিনি অনবরত তাঁকে থাপ্পড় দিতে লাগলেন! বেচারি রাবেয়া কসম খেয়ে খেয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেই যাচ্ছিলেন! কিন্তু বিদ্বেষী শাশুড়ি ও রাগত স্বামীর কাছে তাঁর কসম, চোখের পানি কিছুই ধোপে টিকল না!
রাবেয়ার মা তাঁকে বললেন: ওজু করে কুরআন শরীফের ওপর হাত রেখে বল- এসব মিথ্যা! তুই নির্দোষ! রাবেয়া তাই করলেন। কিন্তু দজ্জাল শাশুড়ি তুড়ি মেরে এটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন: যেই নারী তার স্বামীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে; তাঁর জন্য কুরআন ছুঁয়ে মিথ্যা কথা বলা কোনো ব্যাপারই না!
এদিকে শাশুড়ির কথায় সায় দিয়ে রাবেয়ার স্বামীও মোবাইল বের করে সেসব ম্যাসেজ তাঁর ভাইকে দেখালেন যেগুলো ওই ছেলেটা রাবেয়াকে পটানোর জন্য পাঠিয়েছিল! শাশুড়ি তখন রাসেলের রাগের আগুনে ইন্ধন দেওয়ার উদ্দেশ্যে বললেন, তোমার বোন খুব ধূর্ত ও চালাক! পাশাপাশি ঠগ এবং প্রতারক! সে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে! আমার সহজ সরল ছেলেটাকে ঠকিয়েছে!
এসব তীর্যক মন্তব্য রাসেলের মনকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল! তার আত্মসম্মানে মারাত্মক আঘাত হানল! সে তার বোনের কোনো কথাই শুনল না! টেবিলের উপর থাকা ক্রিস্টালের ফুলদানি দিয়ে মুহূর্তেই রাবেয়ার মাথায় প্রচন্ড বেগে আঘাত করল! ঘটনাস্থলেই রাবেয়ার প্রাণ বায়ু ওড়ে গেল! এভাবে একটি রং নাম্বারের কারণে একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল! এবং দুটো বাচ্চা এতিম হয়ে গেল!
রাবেয়ার আরেক ভাই যখন সমস্ত ঘটনা জানলেন; তখন তিনি তাঁর ভাই, ভাবী, রাবেয়ার স্বামী, শাশুড়ি এবং সেই অপরিচিত মোবাইল নাম্বারধারীর বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর করলেন। পুলিশ যখন রাবেয়ার ফোনের ডাটা চেক করল; তখন জানা গেল- রাবেয়া কেবল একবারই সেই রং নাম্বার থেকে আসা কল রিসিভ করেছিলেন! এরপর সেই রং নাম্বারধারীই তাঁকে পটানোর উদ্দেশ্যে অনবরত কল এবং ম্যাসেজ করেছিল!
ফোন ট্র্যাক করে রং নাম্বারধারী ছেলেটিকে পুলিশ দ্রুত গ্ৰেফতার করল! রাবেয়া হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সকলকেও কারাগারে পাঠানো হল! এই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর থেকে রাবেয়াকে হত্যাকারী ভাই ‘রাসেল’ প্রচণ্ড মানসিক অবসাদে ভুগতে লাগল! মানসিক যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে দুদিন পর সে জেলখানায় আত্মহত্যা করল!
সামান্য একটি রং নাম্বার তিনদিনের মধ্যেই একজন সতীসাধ্বী নারীকে তাঁর অবুঝ দুটি বাচ্চা থেকে চিরদিনের জন্য পৃথক করে দিল! আর দশদিন পর তাঁর ভাই আত্মহত্যা করে আরেকজন নারীকে বিধবা এবং তাঁর তিন ছেলেমেয়েকে এতিম করে দিলেন!
#প্রিয় বন্ধু! এভাবেই মাত্র তের দিনের ব্যবধানে পাঁচটি শিশু এতিম এবং দুটি পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল! চিন্তা করে বলুন তো- আসল অপরাধী কে? অসভ্য রং নাম্বারধারী? নাকি হিংসুটে শাশুড়ি? নাকি সন্দেহপ্রবণ মূর্খ স্বামী? নাকি বাছবিচারহীন আত্মমর্যাদাবান ভাই? নাকি রাগ ও ক্রোধের আগুন? নাকি আমাদের সমাজব্যবস্থা?
সুক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে দেখবেন- এসব রং নাম্বার ভিনগ্ৰহ থেকে আসে না! বরং আমাদের মধ্য থেকেই যায়! আপনি আমি বা আমাদের মধ্য থেকেই কেউ এসব গর্হিত কাজ করেন! তাই কখনো কোনো রং নাম্বারে ফোন দেওয়ার আগে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন- এর দ্বারা ফোনের ওপাশে থাকা কোনো নিষ্পাপ বোনের সংসার তছনছ হয়ে যেতে পারে! আমার এক মিনিটের হাসিঠাট্টা কারো পুরো জীবনটাই ধ্বংস করে ফেলতে পারে!
আর হ্যাঁ, কখনো কারো বিচার করতে হলে ইনশাআল্লাহ ইসলামী বিধিবিধানের আলোকেই বিচার করব। ইসলাম আমাদেরকে বলে- রাগান্বিত অবস্থায় বিচার করা যাবে না[১]। বাদী বিবাদী উভয়ের কথাই শুনতে হবে [২]। উভয়ের প্রতি সম আচরণ করতে হবে [৩]। কোনো পক্ষের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ পূর্বক বিচার করা যাবে না [৪]। ঘুষ গ্ৰহণের মাধ্যমে বিচার করা যাবে না [৫]। পদ গ্ৰহণের প্রতি আগ্ৰহ প্রকাশ করা যাবে না[৬]।
আল্লাহ তায়ালা গল্প থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দিন।
___________________________________________
[১] আবু বাকরাহ সিজিস্তানে অবস্থানকারী তার পুত্রকে লিখে পাঠান- তুমি রাগান্বিত অবস্থায় লোকদের মাঝে বিচার-ফায়সালা করবে না। কেননা আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- ‘কোনো বিচারক রাগান্বিত অবস্থায় দু’জনের মধ্যে বিচার-ফায়ছালা করবে না’।
(বুখারি শরিফ; হাদিস নং ৭১৫৮; মুসলিম শরিফ; হাদিস নং ৪৩৮২; আবু দাউদ শরিফ; হাদিস নং ৩৫৮৯; তিরমিজি শরিফ; হাদিস নং ১৩৩৪)
[২] (ক) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘তোমার নিকট যখন দু’জন লোক বিচারের জন্য আবেদন করে, তখন তুমি দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে না শুনেই প্রথম পক্ষের কথার উপর ভিত্তি করে রায় প্রদান করবে না। তুমি খুব শীঘ্রই জানতে পারবে, তুমি কীভাবে ফায়ছালা করেছ’।
(তিরমিজি শরিফ; হাদিস নং ১৩৩১; সহিহুল জামে; হাদিস নং ৪৩৫)
(খ) এ ব্যাপারে আরেকটি হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘তোমার নিকট যখন দু’জন লোক বিচারের জন্য বসে, তখন তুমি তাদের মাঝে ফায়সালা করবে না, যতক্ষণ না দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্য শুনবে যেভাবে তুমি প্রথম পক্ষের কথা শুনেছ। যখন তুমি এরূপ করবে, তখন তোমার কাছে ফায়সালার বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে’।
(মুসনাদে আহমাদ; হাদিস নং ৮৮২; সহিহুল জামে; হাদিস নং ৪৭৮; সহিহাহ; হাদিস নং ১৩০০)
[৩] হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই মানুষ এমন একশত উটের মত, যাদের মধ্য থেকে তুমি একটিকেও বাহনের উপযোগী পাবে না’।
(এর অর্থ হল- ইসলামে সকল মানুষই সমান। যেমন একশত উটের মধ্যে সবগুলোর মর্যাদা সমান। তেমনই মানুষের মধ্যে ধনী-গরীব, সাদা-কালো, আশরাফ-আতরাফ সকলের মর্যাদা সমান।)
(বুখারি শরিফ; হাদিস নং ৬৪৯৮)
[৪] আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়বিচার কর, যা আল্লাহভীতির অধিকতর নিকটবর্তী। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সকল কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগত’।
(আল কুরআন; ৫:৮)
[৫] হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন- ‘বিচারের ক্ষেত্রে ঘুষ গ্রহীতা ও ঘুষ প্রদানকারীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন’।
(তিরমিজি শরিফ; হাদিস নং ১৩৩৬; ইবনু মাজাহ; হাদিস নং ২৩১৩)
[৬] আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানত সমূহকে তার যথার্থ হকদারগণের নিকটে পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা লোকদের মধ্যে বিচার করবে, তখন ন্যায়বিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে সর্বোত্তম উপদেশ দান করছেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’।
(আল কুরআন; ৪:৫৮)