রণক্লান্ত বীর আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ

রণক্লান্ত বীর আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী

এক সময় কবি নজরুলকে মানুষ কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। তার কিছু কবিতার কারণে মানুষের চোখের কাঁটায় পরিণত হয়েছিলেন তিনি। কবি গোলাম মোস্তফা সাহেব তাকে সংযত হওয়ার আহবান জানিয়ে ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’ কবিতা রচনা করেছিলেন। সময়ের বিবর্তনে কবি নজরুল আবার এদেশের মানুষের চোখের পুতুলি হয়ে যায়। স্থান নেয় সকলের মণিকোঠায়। এক সময়ের খলনায়ক হয়ে যায় মহানায়ক। কারণ নজরুলের দ্রোহের কবিতা সত্যি প্রশংসনীয়। তার প্রতিটি কবিতা মুক্তিকামি মানুষের হৃদয়ে আঘাত করে।

“আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত”

নজরুলের এমন শত- সহস্র কবিতা জাতিকে ভাবিয়ে তোলে। অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে। তার কবিতা-গান সব কিছুতে এদেশের মজলুম মানুষের পক্ষে এবং জালেমদের বিরুদ্ধে মহা বিপ্লবের ডাক রয়েছে। ঘুমন্ত জাতিকে জেগে ওঠার মন্ত্র দিয়েছিলেন তিনি। যে কারণে কবি নজরুল সর্বস্তরেে মানুষের নিকট আস্থাভাজন হিসাবে আভির্ভূত হয়েছিলেন।

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেব কোনো কবি নন। নজরুলের সাথে কোনো উপমা চলে না। নজরুল কবি হিসাবে তার স্থানে শ্রেষ্ঠ। তবে আল্লামা মাসঊদ সাহেবের কিছু ঘটনাবলী কবি নজরুলের মত। সে কারণে নজরুলের কথা কিছু উল্লেখ করলাম। অবশ্য আল্লামা মাসঊদ সাহেবের যিন্দেগী শাইখুল আরব ওয়াল আজম সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.) এর যিন্দেগীর সাথে কিছুটা মিল পাওয়া যায়। যিনি আসলেই রণক্লান্ত মুজাহিদ ছিলেন।

তিনি তো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক। পুরো জীবনটাই সঁপে দিয়েছিলেন আন্দোলন সংগ্রামে। মজলুম মানুষের পক্ষে তার ভুমিকা চিরস্মরণীয়। সেই শাইখুল ইসলামের ছায়া পাওয়া যায় আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবের মাঝে। তাঁর জীবনের অনেক ঘটনার মিল দেখা যায় বর্তমান যুগের মাদানী আল্লামা মাসঊদ এর মাঝে।

শাইখুল ইসলাম মাদানীকে এক সময় মানুষ কাফের ফতুয়া দিয়েছিল। এক ঝাক আলেম-উলামার ফতুয়া গর্জে ওঠেছিল। তারা মাওলানা মাদানীর চিন্তা-চেতনা না বুঝেই যত ফতোয়ার খড়গ চাপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এক সময় মাদানী দর্শনই শ্রেষ্ঠ বলে যখন আলেমগণ বলা শুরু করলেন, তখন কিন্তু তারা ভুল বুঝতে পারে। যারা সেকালে মাওলানা মাদানীর ঘোর বিরোধী ছিল, তারাই আপন বনে গেল। আজও পর্যন্ত তাদের উত্তারাধিকারীগণ মাদানী সাহেবকে শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ হিসাবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। এমনকি এ কথা বলতে শোনা যায়, রাজনীতি যদি শিখতে চাও মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানীকে ফলো করো।

মজলুম আলেমেদ্বীন, দারুল উলূম দেওবন্দের সূর্যসন্তান, শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দামাতবারাকাতুহুম তিনি বহু ফতোয়ার শিকার হয়েছেন। কেউ কাফের! কেউ দালাল! কেউ বলে গোমরাহ! এরকম নানান তকমা লাগানো হয়েছে। কিন্তু এই রণক্লান্ত মুজাহিদ দমে যাননি কখনো, বরং ময়দানে বীরের মত লড়াই করেছেন। দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করে গেছেন। কারো ফতোয়ায় ভেঙে পড়েননি। তিনি যেন সেই বিদোহী রণক্লান্ত।

পঞ্চাশ বছর ধরে বুখারী শরীফের দরস দিয়ে আসছেন। হাজার হাজার আলেম তৈরী করেছেন। লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক শত-সহস্র। যাকে বলা হয় আলেম তৈরীর কারিগর। হাজার মুহাদ্দিস-মুফতীর উস্তাদ। বর্তমান এদেশের বিজ্ঞ আলেম এবং ইসলামী ঘরানার লেখক-সাহিত্যিক প্রায় সবই তাঁর সংস্পর্শে গড়ে ওঠেছে। এদেশে দেওবন্দী আলেমদের অনন্য উচ্চতায় ওঠাতে তাঁর অবদান কোনোদিন ভোলা যাবে না। কওমী মাদ্রাসাকে যুগপোযোগী করা, মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা কারিকুলামে ব্যাপক জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করার পিছনে তার মেহনত সীমাহীন।

বাংলাদেশকে এবং এদেশের আলেম সমাজের মান বিশ্ব দরবারে উঁচু করে ধরেছেন তিনি। বিশ্বব্যাপি ওলামায়ে কেরামের নিকট ও সর্বস্তরের মানুষের নিকট বাংলাদেশের আলেম সমাজের ভাবমুর্তি উজ্জল করেছেন। সবচেয়ে বড় অবদান, “লাখো আলেমের ফতোয়া” সন্ত্রাস- জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তাঁর এই ফতোয়া বিশ্ববাসীর কাছে সমাদৃত হয়েছে।

আসলে ক্লান্তহীন বীর তিনি। অবিরাম ভাবে ছুটে চলেছেন। যেমন দরস-তাদরীস, তেমনী খেদমতে খালক। সেই সাথে ইসলাহী প্রোগ্রাম দিয়ে মানুষের আত্মশুদ্ধির কাজ করে যাচ্ছেন। ‘বাংলাদেশ জমিয়াতুল উলামা, ইসলাহুল মুসলিমিন পরিষদ’ বিভিন্ন ব্যানারে তাঁর কর্মিগণ কাজ করে থাকেন।ওদিকে ফেদায়ে মিল্লাতের খলিফা তিনি। সেহিসাবে তাঁর ইসলাহী মিশন অব্যহত রয়েছে দেশ জুড়ে।

নীরব বিপ্লবের কান্ডারী তিনি। এ যেন ইসলাহী মিশনের মাধ্যমে বিপ্লব ঘটাচ্ছেন। কারো সমালোচনা নয়। কোনো কামড়াকামড়ি নয়। কারো বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্য নয়। এমনকি ঈঙ্গিত করে কাউকে খোঁচা মারতে দেখি না। আপন গতিতে ছুটে চলেছেন। এখন বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের আলেম সমাজ বু্ঝতে পেরেছেন। আসলে তিনি বেমেছাল। তাঁর খেদমত অপরিসীম। তাঁর দর্শন- চিন্তাচেতনা সত্যি শ্রেয়।

সেদিন তাঁর বক্তৃতা শোনা গেল, দীন টেকাতে কওমী মাদ্রাসার বিকল্প নেই। জাতির ক্রান্তিকালে এমন বক্তৃতায় এদেশের মানুষ যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। জীবন সায়াহ্নে তিনি এদেশের আলেম এবং কওমী মাদ্রাসাকে ভুলে যাননি। তাঁকে জানাই হাজারো সালাম। আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবের সুস্বাস্থ্য এবং নেক হায়াত কামনা করি। আল্লাহুম্মা আমিন।

  • লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *