রোহিঙ্গা কিশোর | আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

রোহিঙ্গা কিশোর | আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

বিস্তৃত সবুজের মাঝে একটুকরো গ্রাম। গ্রামের নাম ঢেকিবুনিয়া। ঢেকিবুনিয়ার আকাশ যেন বিধবা মায়ের আঁচল। পুরনো আঁচলে গ্রামটিকে আগলে রেখেছে সেই কবে থেকে! আকাশের মতোই বিষণœতা নিয়ে গ্রামের এক পাশ দিয়ে এঁকে-বেঁকে বয়ে গেছে শৈলী নদীটি। জিসান তাকিয়ে আছে তারই তীর ছোঁয়া ছোট্ট ছোট্ট ঢেউয়ের দিকে। জিসান এখানে প্রায়ই আসে। বিশেষ করে ওর যখন মন খারাপ থাকে। নীরবে বয়ে চলা শৈলীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউয়ের সাথে জিসান তার কষ্ট ভাগাভাগি করে। ভাগাভাগি করে চোখের জলও। জিসান শৈলীকে জিজ্ঞেস করে,

আচ্ছা শৈলী! বলোতো কী অপরাধ ছিল আমাদের? মুসলমান হওয়াটাই কি আমাদের অপরাধ? দোষ করলো ওরা আর স্কুল থেকে বের করে দিল আমাদের। এই অবিচার আর কতো দিন?

শৈলী কিছুই বলে না। সেই আগেকার মতোই ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকে। এতে জিসানের খুব রাগ হয়। হাতের কাছে থাকা ঢিলাটি ছুড়ে মারে শৈলীর বুকে। আঘাতে শৈলীর ঢেউ ওঠে। ঢেউ ওঠে জিসানের চোখেও। অতঃপর তা চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরে শৈলীর অথই জলে। কান্নাভেজা চোখের পাতায় ভেসে ওঠে সেদিনের নির্মম দৃশ্যটি। জিসান, ইসমাইল আর নুসরাতেরা সেদিন না হয় ভুল করেই বসে পড়েরছিল ক্লাসের প্রথম সারিতে। কিন্তু তার জন্য মগের সন্তানরা ওদের বই খাতা কেড়ে নিয়ে ছিড়ে ফেলে দেবে? আর স্যারও বা কেমন! অপরাধীদের শাস্তি না দিয়ে, উল্টো জিসানদেরকেই বের করে দিলো স্কুল থেকে। নুসরাত বিচার চাইতে গেলে তাকেও শাসিয়ে দিলো। বললোÑ
তোরা জানিস না প্রথম সারির বেঞ্চগুলো শুধু মগদের জন্য! তোরা কি বৌদ্ধ? মগধর্মী হয়ে যা, তাহলেইতো সামনের সারিতে বসতে পারবি।

স্যারের মুখে এমন কথা শুনে নুসরাতের খুব মন খারাপ হলো। কিন্তু নুসরাত সবকিছু সহ্য করে নেয় গত বছরের নৃশংতার ভয়ে। গত বছরও ঠিক এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল এই স্কুলে। ক্লাস এইটের সুফিয়া নামের এক ছাত্রীকে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার দেয়ায় পরিমল স্যারকে কান ধরে উঠ-বস করায় মগ শিক্ষকেরা। সুফিয়া তখন প্রতিবাদ করে বলেছিল এটা অন্যায়।


চলো না আমরা এদেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই। যেখানে মগদের এই দানবতা থাকবে না।


এ কথা বলতে দেরি, কিন্তু দুবৃত্তদের সুফিয়ার ওপর হামলে পরতে দেরি নেই। পিতৃতুল্য একেকটা শিক্ষক মুহূর্তেই হয়ে গেল নরকের কীট। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় সেদিন সুফিয়াকে হতে হয়েছিল জীবন্ত লাশ। তাই এমন পরিণতি যেন নুসরাতেরও না হয়, সেজন্য চোখের পানি ছেড়ে বাড়ির পথ ধরে। কিন্তু জিসান ব্যাপারটিকে এতো সহজে মেনে নিতে পারেনি। ওরা যখন জিসানের বই খাতা কেড়ে নিতে এলো, তখনই ও সোজা এক ঘুষি লাগিয়ে দিলো ঝিন্টু নামের এক মগের নাকবরাবর। ওরা যেন আকাশ থেকে পরে। মুসলমানের বাচ্চার এতো সাহস! ওরা সবাই একসাথে হামলে পড়ে জিসানের ওপর। মুহূর্তেই ঘটে গেল রক্তাক্তি কা-। ইসমাইল এক দৌড়ে জিসানের বাবা খলিলুর রহমানকে খবর দিয়ে আসে। খবর পাওয়া মাত্রই তিনি দৌড়ে আসেন স্কুল প্রাঙ্গণে। শিক্ষকদের হাতে পায়ে ধরে কোনো রকমে উদ্ধার করেন রক্তাক্ত জিসানকে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হং সং জিসানের বাবাকে দশ হাজার টাকা জরিমানা করে। সেইসাথে এই ঘোষণাও প্রদান করে, আজ থেকে আর কোনো মুসলমানের ছেলে মেয়ে এই স্কুলে পড়তে পারবে না। ঘোষণাটি শুনে জিসানের বুকটা চিন চিন করে ওঠে। তবে কি ওর স্বপ্নটা পূরণ হবে না? ওর যে স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সাংবাদিক হবে। বিশ্ব মিডিয়ায় তুলে ধরবে আরাকানী মুসলমানদের ওপর নাসাকা বাহিনী আর মগসন্ত্রাসীদের নির্মমতার চিত্র। কথা বলবে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতার পক্ষে। কিন্তু তা আর হলো কই?

জিসান মায়ের বুকে মাথা ডুবিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। কেঁদে কেঁদে বলে,
মা! আমার আর স্কুলে যাওয়া হবে না?
ছেলের কথা শুনে মাও কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাভেজা গলায় বলেন,
আল্লাহকে বলো বাবা! তিনিই আমাদের একমাত্র সাহায্যকারী।

খলিলুর রহমান জিসানের পিঠে মলম লাগিয়ে দিচ্ছিলেন আর চোখের পানি ফেলছিলেন। জিসান বাবার অশ্রু মুছে দিয়ে বলে,

বাবা! চলো না আমরা এদেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই। যেখানে মগদের এই দানবতা থাকবে না। থাকবে না জাতি নিধনের নামে মানুষ পোড়ার মহড়া। পাশের বাড়ির সালিম চাচারাওতো বাংলাদেশে চলে গেছেন। চলো না, আমরাও না হয় সেখানেই চলে যাই। শুনেছি ওখানে নাকি অনেক সুখ। সেখানকার মানুষেরা নাকি মদিনার আনসারদের মতো রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ায়। সাহায্য সহোযোগিতা করে। চলো না বাবা! সেখানেই চলে যাই। কীলাভ এই বাপ-দাদার ভিটের মায়াকে আঁকড়ে ধরে?

খলিলুর রহমান জিসানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

বাবারে! আমরা সবাই যদি নিজেদের কথাই ভাবি, তাহলে এই আরাকানের কথা কে ভাববে? আমরা সবাই যদি চলে যাই, তাহলে এই ভূখ-ে কে দাঁড়িয়ে বলবে আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম?

তুমিতো বাবা আল্লাহর কথা ঠিকই ভাবছো। কিন্তু আল্লাহ কি আমাদের কথা ভাবছেন?
ছি! বাবা। এমন কথা বলতে নেই। আল্লাহ নাখোশ হবেন। আমাদের কথা আল্লাহ না ভাবলে আর কে ভাববে?
তাহলে তিনি আমাদের সাহায্যের জন্য আবাবিল পাঠান না কেন? যেমনিভাবে পাঠিয়েছিলেন জালিম বাদশা আবরাহাকে ধ্বংস করে কাবাঘরকে রক্ষা করতে। কাবা কি আমাদের থেকেও বেশি দামি?

খলিলুর রহমান ছেলের অনুযোগ শুনে মৃদু হাসেন। তারপর বলেন,
আবাবিলতো মামুলি জিনিসরে বাপ! তারচে বড় সাহায্যটাইতো আমাদের করেছেন।
কী সেটা?

এই যে তুই। তোর মতো আরো অনেক আরাকানি কিশোর। যাদের রক্তে ঢেউ খেলে স্বাধীনতার তামান্না। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন এই ভূখ-ে তোদের হাতে উড়বে স্বাধীন আরাকানের রক্তিম পতাকা।

সেদিন কবে আসবে বাবা?
যেদিন তোরা সবাই এক যোগে জেগে উঠবি। আল্লাহতো আসলে এরই জন্য অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষা করছেন তোদের জেগে ওঠার। যেদিন তোরা সত্যি সত্যি জেগে ওঠবি, সেদিন দেখবি আরাকানের লাল জমিন শুভ্র হয়ে ওঠছে বদরের ফেরেশতায়। বাবার কথাগুলো শুনার পর জিসানের ভেতরে ঢেউ ওঠে অনুশোচনার। ও মনে মনে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। তারপর চোখের পানি মুছে বাবাকে বলে,

ঢেউয়েরা বলে যায় ওপাড়ে আজ কতোটা প্রাণ ঝড়েছে। ভেঙেছে স্বপ্নের নীড়। আমার হাতে ক্যামেরা দেখেই হয়তো ওর ধারণা হয়েছিল আমি সাংবাদিক। তাই ত্রাণের পিছু না ছুটে হারানো স্বপ্নের ছায়ার পেছন পেছন চলে আসে এখানে।

তুমি দেখে নিয়ো বাবা! একদিন ঠিকই আমরা আরাকানকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ! সেদিন তোমার হাতে তুলে দেবো বিজয়ের পতাকা।
কিন্তু না। বাবাকে দেয়া কথা জিসান রাখতে পারেনি। তার আগেই নিষ্ঠুর মগরা ওর বাবাকে শহিদ করে দিয়েছে। শহিদ করে দিয়েছে ওর মা আর আদরের বোনটিকেও। জিসান এখন একা। বড়ই একা। জিসানের সাথে দেখা হয়েছিলো নাফের তীরে। যেখানে এখন বয়ে চলে শহিদি লাশের মিছিল। ঢেউয়েরা বলে যায় ওপাড়ে আজ কতোটা প্রাণ ঝড়েছে। ভেঙেছে স্বপ্নের নীড়। আমার হাতে ক্যামেরা দেখেই হয়তো ওর ধারণা হয়েছিল আমি সাংবাদিক। তাই ত্রাণের পিছু না ছুটে হারানো স্বপ্নের ছায়ার পেছন পেছন চলে আসে এখানে। আমি একটু থামতেই জিসান পেছন থেকে জিজ্ঞেস করে,

আপনি কি সাংবাদিক?
আচমকা প্রশ্নে পেছন ফিরি। দেখি বারো তেরো বছরের এই কিশোর দাঁড়িয়ে আছে এক পৃথিবী কৌতূহল নিয়ে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই তার চোখে মুখে ভাসমান অসহায়ত্বের ছাপ। দেহের দেয়ালে জমে থাকা ক্লান্তির পলেস্তার। সেদিন ও বলেছিল,

জানেন স্যার! আমারও না খুব ইচ্ছে ছিল, বড় হয়ে আপনার মতো একজন সাংবাদিক হবো।

শুরুটা ও এমনই স্বাভাবিকভাবে শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত এসে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। ওর কান্না আর বর্ণনা শুনে আমার চোখেও জল নেমে আসে। বুকটা ভারী হয়ে ওঠে। কিন্তু এখানেই যে গল্পের শেষ নয়। নির্মমতার আরও অনেক কিছুই যে বাকি রয়ে গেছে!

সবশেষে জিসানকে জিজ্ঞেস করি,
এদেশে তোমার কেমন লাগছে?
জিসান এক চিলতে হাসি দিয়ে বলে,

অনেক ভালো। এদেশের মানুষ খুবই ভালো। দেখুন না! আমাদেরকে তারা কতো সহজেই আপন করে নিয়েছে। তারা বুঝতেই দিচ্ছেন না আমরা সাময়িক আশ্রিত মাত্র। বরং তাদের আন্তরিকতা এটাই বলে দেয়, প্রয়োজনের তাগিদ আর ভূখ-ের ব্যবধানে হয়তো আমরা বাহ্যিক ভিন্ন। কিন্তু অভিন্ন আত্মার আত্মীয়। সবচে বড় কথা, এখানে বৌদ্ধদের নৃশংসতা নেই। নেই আগুনে পোড়া জ্যান্ত লাশের গন্ধ। হ্যাঁ, থাকা-খাওয়ার একটু কষ্ট হয়তো আছে। কিন্তু নেই দানবদের তা-ব। এখানে অসহায়দের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয় না। ভারাক্রান্ত হয় না দূরের আকাশ। বরং এখানে আকাশ নীল।

লেখক : গল্পকার

● অক্টোবর ২০১৭, মাসিক পাথেয়

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *