রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন : আশায় আশায় ছয় বছর

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন : আশায় আশায় ছয় বছর

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফেরেনি৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সে চেষ্টাতেও পড়েছে ভাটার টান৷ কক্সবাজারের উখিয়া আর টেকনাফ উপজেলায় এখন ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বাস। দুই উপজেলায় মোট স্থানীয় পাঁচ লাখের মতো৷ ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠী সেখানে এখন সংখ্যালঘু। তাদের কাজের সুযোগ কমেছে। বন উজাড় হচ্ছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অবনতি ঘটছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির। তাই ২০১৭ সালে স্থানীয় যারা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, তারাও এখন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থী আসার ছয় বছর পূর্তিতে স্থানীয়রা তাই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য র‌্যালি করেছেন প্ল্যাকার্ড নিয়ে।

মিয়ানমারে সামারিক নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গারা রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেন। তখন তাদের সংখ্যা সাত লাখের মতো হলেও এখন সংখ্যাটা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

ইউএনএইচসিআরের হিসেবে এখন কক্সবাজারের ২৭টি ক্যাম্প এবং ভাসানচরে মোট নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছেন ৯ লাখ ৫০ হাজার ৯৭২ জন। আরো এক লাখ রোহিঙ্গা শিশু এখন নিবন্ধনের অপেক্ষায়। এর বাইরেও আগে আসা নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছেন প্রায় ৪০ হাজার।

বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের কাছে এ পর্যন্ত আট লাখ ২৯ হাজার ৩৬ জন রোহিঙ্গার তালিকা পাঠানো হয়েছে। মিয়ানমার এর মধ্যে মাত্র ৩৭ হাজার ৭০০ জনকে মিয়ানমারের বলে নিশ্চিত করেছে। বাকিদের বিষয় ঝুলে আছে। এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। দুইবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কাজে আসেনি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘‘এখানে সব পক্ষের দায় আছে। রোহিঙ্গারাও ফেরত যেতে চায়না। আবার কিছু এনজিও আছে যারা রেহিঙ্গাদের ফেরত যেতে নিরুৎসাহিত করছে।”

মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক আ্যটাশে এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, ‘‘মিয়ানমার আসলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকের মর্যাদা দিয়ে ফেরত নিতে চায় না। আর আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কোনো কোনো দেশ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশিদের সঙ্গে একীভূত করার কথা বলছে। এই দুইটি বিষয়ই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথে এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে এখন অন্তত ১১টি সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়। কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট পর্যন্ত সেখানে ১১ ধরনের অপরাধে তিন হাজার ২০টি মামলা হয়েছে। দেড় শতাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ক্যাম্পকেন্দ্রিক অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি, মানব পাচারসহ অন্যান্য অপরাধে ওইসব মামলা হয়েছে।

কক্সবাজার বনবিভাগের তথ্য বলছে, মিয়ানমার থেকে ১১ লাখ রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফের ৮ হাজার একর বনভূমিতে আশ্রয় নিয়েছে; যা বন ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। হাতির অভয়ারণ্য ও চলাচলের পথ নষ্ট হচ্ছে। পাহাড় কাটা হচ্ছে। গাছ কাটা হচ্ছে।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটি এবং জেলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘‘এখন মনে হচ্ছে সব কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ছয় হাজার একর সংরক্ষিত বন উজাড় হয়ে গেছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে।স্থানীয়দের কাজের সুযোগ কমছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।”

তার কথা, ‘‘রোহিঙ্গাদের তাদের দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কোনো কার্যকর উদ্যোগ এখনো চোখে পড়ছে না। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে দিন দিন ক্ষোভ বাড়ছে। তারা নিজ এলাকায়ই এখন সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছেন।”

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এখন সার্বিকভাবে দেখাশোনা করে ইউএনএইচসিআর। তাদের সঙ্গে আছে বিদেশি এবং দেশি এনজিও। ২০২৩ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য ২৭৫ মিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু এখন পর্যন্ত চাহিদার মাত্র ২৯ ভাগ পাওয়া গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আন্তর্জাতিক সহায়তা কমছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, গত মাস থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালে প্রতিশ্রুতির চেয়ে যথাক্রমে ৬০, ৭৩ ও ৬৩ ভাগ সহায়তা পাওয়া গেছে।

ডা. এনামুর রহমান জানান, ‘‘রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে কোনো অর্থ বরাদ্দ দিতে হয় না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে সহায়তা করে তা ইউএনএইচসিআর এবং আইওএম-এর মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়। এর টোটাল ম্যানেজমেন্ট তাদের হাতে।”

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ সরকার শুধু আইন-শৃঙ্খলা ও ক্যাম্পের বাইরে অবকাঠামো খাতে খরচ করে। ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্প পুরোটাই বাংলাদেশের টাকায় নির্মাণ করা হয়েছে।” তবে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাজেটে রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারকে বড় একটি অংক বরাদ্দ রাখতে হতো।

রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বরাদ্দ কমিয়ে দেয়ার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, তাতে পরিস্থিতি খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে বলে মনে করেন শহীদুল হক। তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের জন্য আর খরচ করা সম্ভব নয়। এমনিতেই বাংলাদেশ নানা সংকটে আছে।”

তার কথা, ‘‘রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশকে ক্ষতির মুখে ফেলছে। বাংলাদেশ যে পদ্ধতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করতে চাইছে, তা সম্ভব না-ও হতে পারে। কারণ, পুরো বিষয়টি মিয়ানমারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। মিয়ানমার যাদের নাগরিক বলবে, তারাই নাগরিক- এটা হয় না। বাংলাদেশের উচিত এটা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো চাপ দেয়া। কারণ, রোহঙ্গিাদের তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো ছাড়া এর আর কোনো সমাধান নেই।”

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘‘প্রথম দিন থেকেই আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানিয়ে যাচ্ছি, তারা সহায়তা করছেন। কিন্তু আমরা চাই তারা রোহিঙ্গাদের সহায়তা এবং তাদের প্রত্যাবাসনে সমানভাবে কাজ করুক।”

তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমরা এখন সংকটে আছি। আমাদের বন উজাড় হচ্ছে, পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। ওই এলাকায় আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে। আর আমাদের নিজেদেরই এত জনসংখ্যার মধ্যে এই বাড়তি লোকের চাপ আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে।”

সূত্র: ডয়চে ভেলে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *