রোহিঙ্গা সঙ্কট, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ

রোহিঙ্গা সঙ্কট, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ

ইসলামের দৃষ্টিতে সবসঙ্কটেই ভ্রাতৃত্ববোধ মুমিনদের অন্যতম প্রধান শক্তি। তা কখনো নষ্ট হয় না। বরং দিন দিন তা উচ্চকিত হয়। যত বেশি সমস্যা সামনে এসেছে তত তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের চর্চা হয়েছে। নবীজীর হিজরতের পর মদীনার আনসারগণ যে ভালোবাসা দেখিয়েছে তা ইতিহাস হয়ে আছে। আজকের রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানোর ইতিহাসও কারও হৃদয় থেকে মুছে দেয়া সম্ভব না। সরকারের মানবতাবাদি হয়ে ওঠার গল্পটা দারুণ। সত্যিকার অর্থে একজন মুসলমান আরেকজনের বিপদে এগিয়ে যাওয়াটাই তার আসল ধর্ম। সীমান্ত খুলে দেয়া হয়েছে। লাখো লাখো মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের আরাকান ও রাখাইন রাজ্যের অসংখ্য মানুষ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায় ‘মিয়ানমারের দুর্গম পাহাড়ে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা’। গা শিউরে ওঠে। যেখানে কোনো চালচুলা নেই, সেখানে মানুষ ঠাঁই নিয়েছে হাজার হাজার। পরিস্থিতি কী তা সহজেই অনুমেয়। কেউ কেউ জীবনবাঁচাতে এসব মুসলিম রোহিঙ্গা ছুটে এসেও আবারও পাহাড়েই আশ্রয় নিয়েছে। মাথার উপরে ছাউনি না থাকলেও সবার আগে প্রয়োজন খাদ্য। খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে এসব রোহিঙ্গা নাগরিক। মানবিক কারণেই তাদের কাছে খাদ্য পৌঁছে দেয়া এ দেশের গণমানুষের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। রোহিঙ্গারা এ দেশে কত দিন থাকবে, আদৌ ফেরত যাবে কিনা, কীভাবে ঢুকছে, তাদের কোনো তালিকা তৈরি হচ্ছে কিনাÑ এরকম শত প্রশ্নের আগে তাদের দু মুঠো খাবার নিশ্চিত করাটা অতীব জরুরি। চিকিৎসা, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সুযোগ না পেলে তারা হিজরত করেও ধুঁকে ধুঁকে মরবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার কারণেই এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে (ইসলাম) আঁকড়ে ধর (ঐক্যবদ্ধ হও) এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। (সূরা ইমরান : আয়াত ১০৩)

ঐক্য সম্পর্কে অন্যত্র আল্লাহ বলেন, তোমরা সেইসব লোকদের মতো হয়ো না, যাদের কাছে স্পষ্ট ও প্রকাশ্য নিদর্শন আসার পরও তারা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং নানা ধরনের মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’। (সূরা আল ইমরান : আয়াত১০৫)

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’। (সূরা হুজরাত : আয়াত ১০) মহান পালনকর্তা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তাদের বেশি ভালোবাসি যারা আল্লাহর রাস্তায় এমনভাবে সারিবদ্ধ হয়ে লড়াই করে, ঠিক যেন সিসাঢালা এক সুদৃঢ় প্রাচীর’। (সূরা সফ : আয়াত ৬১)

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘এই যে তোমাদের জাতি, এ তো একই জাতি, আর আমি তোমাদের পালনকর্তা, অতএব তোমরা (ঐক্যবদ্ধভাবে) আমারই দাসত্ব করো। (সূরা তাওবাহ : আয়াত ৯২)
সত্যিই বিশ্বজুড়ে মুসলমানগণ নিজেদের ঐক্য হারিয়েছে বলেই দুর্দশা তাদের উপর জেঁকে বসেছে। কেবল মিয়ানমার নয়, বিশ্বের প্রায় সবখানে মুসলমান মার খাচ্ছে।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। ফলে ২৫ আগস্ট থেকে নতুন করে সংকট তৈরির পর এ পর্যন্ত প্রায় সোয়া লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে বলে জানায় বিবিসি। আমার বাতার খবরে বলা হয়, এ সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। প্রতি মুহূর্তেই এ সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে দুর্গম পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। তারা ভয়াবহ খাদ্য সংকটে ভুগছে। রাখাইনের সবচেয়ে সংঘাতময় এলাকা মংডুকে সামরিক অভিযান এলাকা ঘোষণা করেছে মিয়ানমার সরকার। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ইন্দোনেশিয়া ৪ যোগ ১ ফর্মুলা মিয়ানমারের কাছে পেশ করেছে। পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, শুধু মুসলিম হওয়ার কারণে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে।

পৃথিবীর যেখানেই দাঙ্গা হয়েছে, পাক-ভারতের ইতিহাসে দাঙ্গায় মানুষের জীবনে নেমে এসেছিলো দুর্বিষহ যন্ত্রণা। এখনো চীনে, মিয়ানমারে প্রায়ই এসব দাঙ্গা বাঁধিয়ে মানুষ মারার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলছে। কখনও কখনও ভারতেও দাঙ্গা বাঁধিয়ে মানুষ মারা হয়। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চরম নির্যাতন-হামলা আর ধর্ষণের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা কোথাও জায়গা না পেয়ে মিয়ানমারের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে আটকা পড়েছে। খাদ্য, পানি, বাসস্থান ও চিকিৎসার অভাবে এসব মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সব সংগঠন ও দেশ এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলেই আমরা দাবি জানাই। পৃথিবী থেকে ভয়, ক্ষুধা কমে গেছে। এ মুহূর্তে পশুর মতো আচরণ করে মানুষই বিপন্ন করে তুলেছে রোহিঙ্গাদের জীবন। পোপ ফ্রান্সিস যে কথা বলেছেন, শুধু মুসলিম হওয়াই যদি রাখাইনবাসির অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে তো দাঙ্গাটা দাঙ্গা থাকবে না। এটা বড় রকমের সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ মিয়ানমারের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী কেবল মিয়ানমারেই বসবাস করে না। শান্তির নামে এগিয়ে চলা বৌদ্ধদের এ বিষয়ে অবশ্যই চিন্তা করা উচিত। সারা ঘরে আগুন লেগে গেলে তা আর থামানো যায় না। রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের এই স্ফূলিঙ্গ মিয়ানমারের বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন বেসামাল হয়ে উঠবে পৃথিবী। তখন শান্তির দাবিদার এই বৌদ্ধরাই দায়ি হবে বলে আমরা মনে করি।

বাংলাদেশের মানুষদের দয়ালু বলেছেন একজন রোহিঙ্গা। কিন্তু যে পরিমাণ আতিথেয়তা, ভালোবাসা ও একজন বিপন্ন মুসলমানের পাশে এগিয়ে যাওয়া দরকার ছিল তা কি আমরা পেরেছি? মুসলমান হিসেবে আমরা কেউই সে দায়িত্ব এড়াতে পারবো না। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাওফিক দিন। আমীন।

সম্পাদকীয় ডেস্ক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *