লকডাউন | আহমেদ খান

লকডাউন | আহমেদ খান

লকডাউন | আহমেদ খান

দরজাটা বন্ধ করতেই নাদিয়া খিলখিল করে হেসে ওঠে। দুহাত ছড়িয়ে শরীরটা এলিয়ে দেয় সোফায়। বলে, ‘শান্তি…’

শান্তি আমার অবশ্য তেমন লাগছে না। বাসাটা মিজানের। সে থাকে না। তার বিদেশি পার্টনাররা এলে ব্যবহার হয়। ওই মাসে বড়জোর ১০-১২ দিন। কিন্তু চীন, ফ্রান্স ইতালি মিলিয়ে যা চলছে, বিদেশি পার্টনাররা এখন গ্যাঁট হয়ে বসে আছে নিজের দেশেই। সেই সুযোগটা মিজান আমাদের দিয়েছে। শূন্য ফ্ল্যাটে প্রেম। মিজান অবশ্য এর চেয়ে নোংরাভাবে বলেছিল। আমি কোনো উত্তর করিনি। যার ফ্ল্যাট সে একটু-আধটু নোংরা কথা বলতেই পারে। তা ছাড়া আমরাও তো কোনো তাজমহল বানাচ্ছি না প্রেমের। নিরেট একটা পরকীয়া করছি। আমি আমার স্ত্রীকে লুকিয়ে এবং নাদিয়া জুঁই তার স্বামীকে ডজ দিয়ে দেখা করছে। এ নিয়ে বন্ধুরা রসিকতা করতেই পারে। সে রসিকতা নোংরা হলেও কিছু বলার থাকে না। আর এ রকম দিনে আস্ত একটা বাসা পাওয়া এবং সে বাসায় সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আসতে পারাটা মোটামুটি থ্রিলারই বটে।

নাদিয়া বলে, ‘সিগারেট কিনছেন?’

নাদিয়াকে দিয়ে নিজেও জ্বালাই একটা। টানতে টানতে ভ্রু লাফায় নাদিয়া।

‘কী দেখেন?’

‘আপনাকে দেখি। আপনি সুন্দর।’

নাদিয়া খিলখিল করে হেসে ওঠে আবারও।

‘নতুন কিছু বলেন মিয়া…এইগুলা জানি!’

সিগারেট মেঝেতে চেপে জড়িয়ে ধরি নাদিয়াকে। ওর ঠোঁটে তখনো বেনসন। একটা লাফিং বুদ্ধা হাসছে। নাদিয়া বলে, ‘এই ফ্ল্যাটে কারা থাকে?’

‘মিজানের বায়াররা।’

‘চায়নিজ?’

‘বোধ হয়। আপনার ঘাড়ে তিল আছে নাকি? আগে তো দেখিনি।’

নাদিয়া একটু পিছিয়ে আসে আমাকে ছাড়িয়ে।

‘ওরা কদ্দিন আগে গেছে?’

‘কারা?’

‘চায়নিজরা?’

‘ঠিক জানি না তো। এই তো ভাইরাস-টাইরাস নিয়ে যে গ্যাঞ্জাম হলো, তারপরেই বোধ হয়…’

‘উফ!’

বসে পড়ে নাদিয়া। চারপাশে তাকায়। ভীত দৃষ্টি।

‘কী হলো?’

‘ভালো লাগছে না আমার!’

‘সন্ধ্যার আগেই বেরিয়ে যাব আমরা। চিন্তা কইরেন না।’

‘গোটা ফ্ল্যাটটায় ওরা ছিল…ধোয়া তো নিশ্চয় হয়নি…কেনই-বা হবে…আপনি জেনে-বুঝে এই জায়গায় আসছেন…’

‘আরে শোনো…কিছু হবে না…’

ঘাড় ধরতে যাই নাদিয়ার। ছিটকে সরে যায় সে।

‘ছোঁবেন না আমাকে…হাত…হাত ধুয়ে আসেন আগে…’

ড্রয়িংয়ের বেসিনে হাত ধুই। নাদিয়া তাকিয়ে আছে। আমি হাত ধুই ২০ সেকেন্ড ধরেই।

‘এখানে থাকা নিরাপদ না। চলেন বাইরে যাই।’

‘আরে! আপনি এত প্যানিক করছেন কেন? সব ঠিক আছে।’

‘কিচ্ছু ঠিক নাই। মানুষ মরছে জানেন না। আমাদের এখানেও মরছে…’

‘আপনি বুঝতে পারতেছেন না। হুদাই এত…’

নাদিয়া কেশে ওঠে হঠাৎই। থমকে যাই। আবার কাশে সে। বলি, জ্বর? জ্বর আছে নাকি আপনার?

নাদিয়া তাকিয়ে থাকে। মেয়েটার চোখ সুন্দর। চোখের নিচে কাজল দেওয়া—ওপরটা ফাঁকা। অদ্ভুত সুন্দর চোখ। বলে, ‘আমি এখন যাব…’

আবার কাশে সে। শুকনো কাশি। আমার দিকে তাকায় করুণ চোখে। তারপর তাকায় নিজের হাতের দিকে। তারপর সারা ঘরে। লাফিং বুদ্ধা হাসছে।

‘আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে রায়হান…আপনি আমাকে বাইরে নিয়ে চলেন…প্লিজ…’

‘আপনি ভয় পেয়েছেন। ভয়ের জন্য আপনার কাশি আসছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আপনি একটু শান্ত হোন…’

তখনই প্রথম কেশে উঠি আমি। এবং একটু পরই মনে হতে থাকে আমি আর নিশ্বাস নিতে পারছি না। আমিও হয়তো ভয় পেয়েছি…আমরা দুজনেই হয়তো ভয় পেয়েছি। অথবা যতটা ভয় পাওয়া উচিত তার কিছুই আমরা পাইনি। আমরা ঘামতে থাকি। আমাদের দুজনের পৃথিবী ছোট হয়ে আসতে থাকে। দরজা খুলে আমরা বেরিয়ে আসি। বাইরে চোখ ঝলসে দেওয়া রোদ। কিন্তু দেয়ালে দেয়ালে অবিশ্বাস। অবিশ্বাস বাতাসের ভেতর। অবিশ্বাস আমাদের হাতে-চোখে। আমরা পরস্পরের দিকে তাকাতে পারি না। আমরা বিদায় নিই না। আমরা আর একে অপরের হাত ধরি না। আমাদের মনে হয়, আমাদের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু তার ভেতরেই আমরা বেঁচে থাকতে চাই। এই বেঁচে থাকা কেমন স্বার্থপরের মতো দেখায়…কিন্তু মানুষ তো আসলে স্বার্থপরই…আমরা তাই বাঁচবার আশা নিয়ে একা হয়ে যাই।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *