লজ্জা মানুষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে

লজ্জা মানুষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে

  • মুহাম্মাদ আইয়ুব

কাজ থেকে সবেমাত্র বাড়ি ফিরেছে শেখর। মা শেফালী দেবী আর বাবা অরুণ কুমার উঠোনে গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত। ষোড়শী উর্বশী বোন মালিনী ব্যস্ত রান্নায়। ও মা! লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে চাড্ডি একখানা পরে দিব্যি গোসলে ব্যস্ত। গুপ্তাঙ্গ ফুলেফেঁপে আছে তা স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে দূর থেকে। লজ্জায় আমি মুখ ফিরিয়ে নিলেও বাবা মা দেদারসে আলাপ সারছে চাড্ডি পরুয়া শেখরের সাথে।

বেনারস থেকে এ ধরনের অনেকগুলো নির্লজ্জ খন্ড খন্ড চিত্র দেখতে দেখতেই একসময় আমরা নেমে পড়লাম গাজিয়াবাদ স্টেশনে, গন্তব্য এখন দেওবন্দ। প্লাটফর্মে বসে ট্রেনের অপেক্ষা…। হরেকরকম মানুষের মাঝে আমি দাড়িওয়ালা সিংদের লোলুপ দৃষ্টিগুলো আবিষ্কার করে ফেললাম। পাগড়ি নীতিতে অটল সাধুরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মেয়ে বয়সী তরুনীদের খোলা বুকে কিংবা টাইট জিন্সের নীচের দিকে। অনেকটা উচ্চস্বরেই সালমান ভাই বলে উঠল, আস্তাগফিরুল্লাহ। আমাদের দেশ কত ভালো ভাই! চিন্তা করেন। যোগ করলাম আমি।

তবে ১৬ সালের সেই বিকেলের কথা থেকে আমি এখন ফিরে আসছি। দেশ আমার একুশ সাল শেষ করতে যাচ্ছে। ডিজিটাল হতে হতে আজ আমার দেশের মা বোনেরা নিজেদের ঝুলির শ্রেষ্ঠ সম্বল আল হায়া তথা লজ্জা বিসর্জন দিচ্ছে হেসেখেলে। একসময় বাঙালী নারী বলতে আমি বুঝতাম ঘরকুনো, আর এখন দেখছি তারা বাজারকুনো। লাইফস্টাইল পুরাই চেঞ্জ। গত কয়েকমাসে আমার স্ত্রীকে নিয়ে বারবার হাসপাতালে যেয়ে আমি বারকয়েক লজ্জার মুখোমুখি হয়েছিলাম কারণ বাহিরের ফাংশন এখন নারী, আর আমি যে পুরুষ!

বাজার ঘাট,দোকানপাট, হাসপাতাল এখন পুরুষদের বহন করতে অক্ষম। সবাই নারীর অপেক্ষায়। ডিজে গানের তালে তালে বাঙালী ছেলে মেয়ে হাত ধরে নাচানাচি করছে। লাখ টাকা দিলেও আমি বিশ্বাস করতাম না বছর পাঁচেক আগে কিন্তু সেদিন রাতে নিজ চোক্ষে দেখলাম! আপডেট হতে হতে আমরা এর সংজ্ঞা বদলে বেহায়াপনা পর্যন্ত টেনে নিয়েছি।

যে লজ্জা ছিল ঈমানের ভূষণ তা আজ কিতাবের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করলেও করেনি আমাদের চরিত্রের শ্রী বর্ধন। লেখিকার লজ্জা মার্কেট আউট না হলেও আমাদের জীবন থেকে আউট হয়ে গিয়েছে। অথচ আমাদের প্রিয়জী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল হায়া উ শুবাতুম মিনাল ঈমান’ – ‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ’ এখন তো ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ এই অংশ আমরা হারিয়ে দেউলিয়া হতে বসেছি বুড়োগুড়ো সবাই। না আছে নামাজে মজা, আর না জিকির, তেলাওয়াত, অজিফাতে।

এই সমাজ এখন নেংটো হওয়াতে তার সমস্ত স্বার্থকতা খুঁজছে অথচ লজ্জার বহুবিধ কল্যাণে স্বার্থক ছিলেন হজরত উসমান জিন্নুরাইন। বর্ণিত আছে, লজ্জাশীলতা, শালীনতা, বিনয়, উত্তম আখলাক, নম্রতা, দানশীলতা, মেধা এবং বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ে তিনি ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন প্রসঙ্গক্রমে এ মহান ব্যক্তির লজ্জাশীলতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি কি সে ব্যক্তিটিকে লজ্জা পাবো না, যাকে দেখে স্বয়ং ফিরিশতারাও লজ্জা পায়?’ আবু সাঈদ আল খুদরী (রা.) বলেন আমি একদিন রাসূলুল্লাহকে দেখেছি রাতের শুরুতে দুহাত তুলে রাতের শেষ পর্যন্ত বলতে, হে আল্লাহ, আমি উসমানের উপর সন্তুষ্ট। তাই তাঁর উপর আপনিও সন্তুষ্ট হয়ে যান।

পাঠক! চলুন, এই মহান লজ্জাশীল সাহাবীর একটি গল্প শুনে আসি-

হযরত উসমান (রা.) ও আম্মাজান আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার হযরত আবু বকর (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাক্ষাত প্রার্থনা করলেন। তিনি তখন আয়েশা (রা.) এর একটি চাদর পরিহিত অবস্থায় তার বিছানায় শায়িত ছিলেন। তিনি এই অবস্থায় থাকতেই আবু বকর (রা.) কে সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন। আবু বকর (রা.) তার সাথে নিজ প্রয়োজন সেরে চলে গেলেন। অতঃপর উমর (রা.) এসে তার সাথে সাক্ষাত প্রার্থনা করলেন। তিনি শায়িত অবস্থায় তাকেও অনুমতি দিলেন। তিনিও তার সাথে প্রয়োজন সেড়ে চলে গেলেন। উসমান (রা.) বলেন, অতঃপর আমি তার সাথে সাক্ষাত প্রার্থনা করলাম। তিনি উঠে বসে আয়েশা (রা.) কে বলেন, তুমি তোমার কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নাও। উসমান (রা.) বলেন, আমিও তার সাথে নিজ প্রয়োজন সেরে বিদায় নিলাম।

আয়েশা (রা.) বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি দেখলাম, আপনি আবু বকর ও উমর (রা.) এর আগমনে শংকিত বা সতর্ক হননি, যতটা হয়েছেন উসমান (রা.) এর আগমনে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, উসমান অতিশয় লজ্জাশীল প্রকৃতির লোক। আমি আশংকা করলাম, যদি আমি তাকে এই অবস্থায় ঘরে ঢোকার অনুমতি দেই তবে সে তার প্রয়োজন নিয়ে আমার নিকট পৌঁছতো না। (মুসলিম, মুশকিলুল আসার)

দিনশেষে চাতক পাখির ন্যায় সবারই তাকিয়ে থাকতে হয় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে, কারণ মুক্তির মন্ত্র মেলে যে সেখান থেকে। সুতরাং আল হায়া নিয়ে তাঁর চীর অমর কিছু বাণী দিয়ে আজকের মত ইতি টানছি।

১. হযরত আবু মাসউদ (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নবুয়াতী কথার মধ্যে মানুষ যা পেয়েছে তাতে এও আছে, ‘তুমি নির্লজ্জ হতে পারলে যাচ্ছে তাই করতে পারো’। (বুখারী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, আহমাদ, ইবনে হিব্বান, তাবারানী)

২. হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ঈমানের ষাট বা সত্তরের অধিক শাখা আছে। তার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট শাখা হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই) এবং তার সর্বনিম্ন শাখা হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা। লজ্জাশীলতাও ঈমানের একটি বিশেষ শাখা। (বুখারী, মুসলিম)

৩. আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতা কোন বস্তুর কেবল কদৰ্যতাই বৃদ্ধি করে। আর লজ্জা কোন জিনিসের সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে। (আহমাদ, ইবনে মাজাহ)

৪. আবু সাঈদ আল-খুদরী (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্দর মহলের পর্দানশীন কুমারী মেয়ের চেয়েও অধিক লজ্জাশীল ছিলেন। তিনি কোন কিছু অপছন্দ করলে তাঁর চেহারা দর্শনেই আমরা তা বুঝতে পারতাম। (বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ)

পাঠক! আজকাল আর কারো বাসাবাড়িতে যাওয়া হয় না, কারণ বেনারসের শেখর আর গাজিয়াবাদের প্লাটফর্মের ষোড়শী উর্বশীরা এখন এদেশের শহরে বাবা মা ভাই বোনের সামনেই বাস করছে আরামসে। সুতরাং বেড়াতে গেলে দিরিলিস, কুরুলুসের যুগে নয়, অপেক্ষা করতে হবে সোনালী যুগের উসমানের।

লেখক : খতিব, শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *