লাওয়ারিশ; সহজিয়া কবিতার স্নিগ্ধ ও মুগ্ধস্রোত

লাওয়ারিশ; সহজিয়া কবিতার স্নিগ্ধ ও মুগ্ধস্রোত

লাওয়ারিশ; সহজিয়া কবিতার স্নিগ্ধ ও মুগ্ধস্রোত

মাসউদুল কাদির ❑ ‘নানান ধর্মের, বর্ণের, আকারের মানুষের ভীড়ের জমজমাট বাজারের পাশের আবর্জনার স্তূপে—পড়ে আছে সদ্য জন্ম লওয়া লাওয়ারিশ। একটা তাজা প্রাণ। অরনীলা। নবজাতক শরীরে দানব-দানবীর উল্লাসের চিহ্ন। অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলো ব্যঙ্গ করছে রাষ্ট্রকে—বিদ্রূপ করছে সমাজকে’। —[লাওয়ারিশ]

বইমেলা ২০২০-এ প্রকাশিত হয়েছে আদিল মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লাওয়ারিশ’। একটা ঘোর অথবা চরম প্রেম উপলব্ধির মধ্য দিয়ে পড়ে শেষ করলাম বইটা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ইতোপূর্বে তার কিছু কবিতা পড়েছি। তাতে ভালো করে কিছু বোঝা যায়নি। লাওয়ারিশ পড়ার পর কবিস্বভাবটি আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। অসংখ্য তরুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ আমাকে হতাশ করেছে। কিন্তু আদিলকে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম পেয়েছি। মনে হয়েছে, তার সমবয়সি অন্যদের চেয়ে আদিল অনেক বেশি কবিতামনস্ক। সব কবির মতো তার কবিতা না। তার কবিতায় আছে অন্য এক বৈচিত্র্য। আছে আলাদা উপমা ও উৎপ্রেক্ষা। তার লিখত পঙক্তি ভেতর ‘কবিতা’ আছে নানা মাত্রায়। কয়েকটি দৃষ্টান্ত—
১. আমাদের সকাল—ঘুম না ভাঙলেই পরকাল [সকাল]
২. প্রেমিক হলেই মানুষ পূর্ণিমা হয়ে যায়/ জোৎস্না হয় পূর্ণতা [পূর্ণিমা]
৩. বিড়াল পা’য়ে হেঁটে যাচ্ছে প্রেম। ফিরেও থাকায় না মন। অভিশাপ দেয় তাকে— [অভিশাপ]
৪. অথচ মেঘ জানলও না—/ ‘বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা/ শারাবান তহুরার চেয়েও দামি।’ [বৃষ্টিপ্রেম]
৫. একদিন স্মৃতি বিস্মৃতি হলে তন্দ্রা আসবে/ কবিতা হবে ঘুম/ হারানো দিনের সুখ [নৈশালাপ]
৬. সে পৃথিবীর একাই একটা শ্রাবণ/ জান্নাত থেকে নেমে এসেছে সবেমাত্র [পড়শি]
৭. শত ভাগ্যে নারী হয়ে জন্মেছিস/ মাতৃত্বের মুখ নিয়ে থাকিস। দুর্গা হয়ে নয় [নারী]
৮. কোলের বুভুক্ষ শিশুটা আর্তনাদ করেই চলছে/ গাল নাড়ছে—জিভ চাটছে/ এদিকে একবিংশ শতাব্দীর গায়ে কলঙ্ক লাগছে। [কলঙ্ক]
৯. কালবৈশাখী ঝড়ে তছনছ করে দেয় সবকিছু/ ধ্বংস হয় মুখস্থ কবিতা—মনের হেফজখানা [একলা বৈশাখ]
১০. মানবিকতা পাশ মার্কের নিচে নেমে যাবে—/ অল্পদিনের মধ্যেই [অদ্ভুত শহর]

৮০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে আছে ৫০টির বেশি কবিতা। কবিতাগুলোতে ছন্দ ও ভাববোধের চরম শিখরে থেকেই অনুপম সব পঙক্তির আয়োজন করেছেন তিনি। প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্য, সবকিছু নিয়েই তিনি কবিতা লিখেছেন। তার রচনায় এমন কিছু পঙক্তি আছে, এমন ধরনের উচ্চারণ আছে, যা আমরা সচরাচর একজন কৃতী কবির সার্থক কবিতায় প্রযুক্ত হতে দেখি। মনে হয়, ওই কবিতাগুলো পড়ার পর পাঠক শুধু তৃপ্তই হবেন না, এই কবির প্রতি আশাবাদীও হয়ে উঠবেন। এমন কিছু পঙক্তি—
ক. কথা ছিলো—/ তোমায় দেবো বাদলা দিনের প্রথম কদম ফুল/ কিন্তু একি হলো!/ ভুলে দিয়ে দিলাম তুমুল ভালেবাসার গন্ধহীন শিমুল ফুল। [শিমুল ফুল]
খ. এই চায়ের কাপে/ কখনো লাগে শ্রমিকের ঘাম/ কখনো আবার প্রেমিকার ঠোঁটের পরশ।/ একটি চায়ের কাপে লক্ষ লক্ষ চুমুক!/ সবাই চুমুকে শান্তি খুঁজে পায়/ কি আশ্চর্য! কেউ কোনদিন কষ্ট খুঁজে পায়নি! [এক কাপ চা]
গ. এই শহরে কবিতার ধ্বনি রোজ ফিকে হয়ে আসে/ হারায় ধ্রুপদী শব্দ, কবিতা আসে না নিঃশব্দে চুপিসারে/ খুঁজে পাওয়া যায় না পবিত্র হৃদয় [এই শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে]
ঘ. তোমার আঙুলের কাছে আমার আঙুলের প্রেম নিবেদন/ কতটা বিষাক্তরকম প্রণয়/ উষ্ণ যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম/ এক পৃথিবী সুখ [অসুখী শরীর]
ঙ. মানুষ ও কুকুর একসাথে খাবার খাচ্ছে/ ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে অনেকেই/ হাঁড় কাঁপানো শীতে বিবস্ত্র শিশু ও বৃদ্ধ/ পতিতা সামান্য টাকায় বিলিয়ে দিচ্ছে শরীর [ল্যাম্পপোস্ট]
চ. রাত্রির ঘুমে খুঁজে পাই না স্বর্গের সুখ/ নিশ্চুপে জ্বলছি/ পরিনত হয়েছি মানুষ রূপী প্রেতাত্মায়/ ক্ষয় হওয়া কিছু পায়ের ছাপের মতো/ —আমিও ক্ষয়ে ক্ষয়ে চলছি [ক্ষয়]
ছ. আমি মানুষের ভালোবাসা দেখি/ কখনো আবার কুঞ্চিত ঘৃণায় মানুষের নীচুতা দেখি!/ পশুত্ব দেখি, দেখি পাশবিক লোভ-লালসা।/ টাকার প্রযোজনে শরীর বিক্রি করা/ এগার টাকায় সুখ কিনে খাওয়া/ প্রিয়জনের ভয়ানক মুখ ফিরিয়ে নেয়া/ বিবেকের বন্ধ্যাত্ব! [মানুষ দেখি]
জ. একদিন সুবহে সাদিকে ইস্তেগফার করে/ রমজানের প্রথম দশক কিংবা শেষ দশকের শুক্রবারে/ জীবনকে পূর্ণতার চুম্বন দিয়ে/ ধরণীকে বিদায় জানিয়ে তার ডাকে সাড়া দিবো/ ইনশাআল্লাহ্। [কবর]

এই কাব্যগ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা আছে ছোট ছোট। আট কিংবা বারো লাইনের মধ্যে। কবিতাগুলো পড়ে মনে হয়েছে আদিল মাহমুদ সংক্ষিপ্ত কবিতায় অভ্যস্ত। তা ছাড়া যদি অল্প কথায় বক্তব্য শেষ করা যায়, তাহলে বাকবিস্তারের প্রয়োজন কী! অনেক ক্ষেত্রে বাকবিস্তার বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে। তবে সংক্ষিপ্ত কবিতাগুলোতে সমৃদ্ধ চিত্রকল্প, ব্যতিক্রমী শব্দপ্রয়োগ, অপ্রচল উপমা সাধ্যমতো ব্যবহার করেছেন তিনি। ‘সকাল’, ‘নীলা মিনারের গল্প’, ‘চাঁদ’, ‘বৃষ্টিপ্রেম’, ‘নারী’, ‘নৈশলাপ’, ‘পড়শি’, ‘মায়া’, ‘মানুষ’, ‘সংলাপ’, ‘বিষফুল’ ইত্যাদি তার সংক্ষিপ্ত কবিতার ভিন্ন ভিন্ন নাম। সংক্ষিপ্ত কবিতগুলোর উল্লেখযোগ্য কিছু পঙক্তি এরকম—
১. প্রতিরাত শেষে আসবে সকাল/ এমন কিন্তু নয়/ অনেক সময় সূর্য হাসলেও/ কারোর সকাল রাত্রিময়
২. ওদিকে রোজ সকালে স্বামীর উষ্ণ নিঃশ্বাসে ঘুম ভাঙ্গে নীলার। এদিকে শীতের শুষ্কতায় ঝরে পড়া দুই লাইন কবিতার সাথে জীবন বেঁধেছে মিনার।
৩. অবচেতনায় কলম হয় আঙুল/ শূন্যে লিখি জটিল মনস্তত্ত্ব/ পুরানো দিনের কথা, স্মৃতির কবিতা।/ কেউ জানে না— স্মৃতির কথা ভেবে ভেবে প্রভাত হয়
৪. প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে, একটু খাওয়াবে তোমার ওষ্ঠাসুধা?
৫. দু’জনেই চাঁদ দেখতো—/ মেয়েটি আকাশের দিকে তাকিয়ে! ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে!
৬. সন্ধ্যালাপে আজ উপাসনা মন্ত্র নেই/ জল ও স্থলের মধ্যবর্তী শূন্যতা/ কেঁদে নাও যতটা পারো বৃক্ষের কাছে নির্জনে/ মাথার উপর আকাশটাও একা আছে
৭. চঞ্চল মনে পানকৌড়ির ডুবসাঁতার অবিরাম/ আহা! এ যেন আমার প্রেম/ মিশে আছে জলে—লেগে আছে পানকৌড়ির ঠোঁটে

জীবন, প্রকৃতি ও স্বদেশের বিভিন্ন প্রসঙ্গকে একেকটি চরিত্র হিসেবে দাঁড় করিয়ে নিজের অনুভূতির কথা আদিল মাহমুদ ব্যক্ত করতে চেয়েছেন দীর্ঘ কবিতার আদলে। রহস্যলোক, গভীরতর বোধ, প্রকাশবৈচিত্র্য ও শব্দের দারুণ ব্যঞ্জনায় এসব দীর্ঘ কবিতা মন জয় করেছে। মন হয়েছে কবিতাগুলোতে খেলা করেছে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, দ্রোহ ও প্রেম। কবিতার পঙক্তিগুলো এমন—
ক. ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে/ সঁপে দেয়া হৃদয়ের গভীরে/ অনন্য ভালোবাসার আদরে/ অসংখ্য আলোর বিন্দুর আলাপনে/ বুনো সুবাসের আচ্ছনতায়/ বেতসপত্রের আড়াল থেকে—/ ডাকছে ঝিঝি/ সোনালি উজ্জ্বল হাসিতে/ বিকশিত আকাশে/ জমে থাকা মেঘ খন্ড বলে/ উপভোগ কর পূর্ণিমার খৈয়ামি রুবাই। [পূর্ণিমার খৈয়ামি রুবাই]
খ. আমাদের প্রেমও সহ্য করতে পারলো না সমাজ সভ্যতা/ আমি আর চৈতালী ‘আমরা’ হতে পারলাম না/ বন্ধনহাতে তার কপালে লাগলো অন্য পুরুষালী সিঁদুর/ সমুদ্রের ঢেউয়ের মত অনর্থক হয়ে গেলাম আমি/ বিরহী প্রেমিকের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে—/ আমার জন্মের মৃত্যু হয়ে গেলো। [চৈত্র মাস]
গ. আমাকে কিছুক্ষণ সময় দিও/ তোমাকে একটা গল্প শুনাবো, রূপকথার গল্প নয়/ গল্পটা রক্ত শীতল উপন্যাসেরও না/ অঙ্কুর কোমল মায়াবী/ লাজুক নিষ্পাপ দুষ্ট দুরন্ত সরলতা ছোট্ট সুন্দর/ আমার শৈশবের—শৈশবপাঠ্য। [শৈশবপাঠ্য]

লাওয়ারিশ কাব্যগ্রন্থে আদিল মাহমুদ আঙুলের হইচই দিয়ে নিজেকে জানান দিয়েছেন। বেশ ভালো ভালো কবিতাও লিখেছেন। রচনা করেছেন উদ্ধৃতিযোগ্য কিছু পঙক্তি। তবে বেশি না হলেও কয়েকটি কবিতায় শব্দের ব্যবহার জুতসই মনে হয়নি। বয়স ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কবি এসব ত্রুটিগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলেই মনে করি। আদিলকে অভিনন্দন।

লেখক : ছড়াকার ও কথাসাহিত্যিক 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *