লাল সূর্য | আব্দুল্লাহ আমান

লাল সূর্য | আব্দুল্লাহ আমান

লাল সূর্য ● আব্দুল্লাহ আমান

আর কতক্ষণ? ফিসফিস করে আলিকে জিজ্ঞাসা করল মোস্তফা। ঠান্ডা একটা বাতাস শিস শব্দ তুলে চলে গেল কানের পাশ দিয়ে। হাসনাহেনা-ই হবে আশপাশের কোন একটা ঝোপে। জেগে আছে ওদের সাথে। সারা দিনের ঝিরঝিরে বৃষ্টি সোঁদা গন্ধ তুলেছে মাটিতে। হাসনাহেনার সুবাস আর সোঁদা গন্ধের মধ্যে মোস্তফার জিজ্ঞাসা কান পেরোল বাতাসের মত করেই।
‘খস খস খস’! মস্তিষ্ক সিগন্যাল দিল সারা শরীরে। সহসাই টানটান স্নায়ু। তর্জনী এঁটে বসল গাদা বন্দুকের ট্রিগারে। দুজনেই পূর্ণ সজাগ। ডোরাকাটা সরিসৃপটা কাঁঠাল গাছের পাকা হলুদ পাতায় গা মেলে সর সর শব্দ তুলে যাচ্ছে । ‘হু–স্’ করে দম ছাড়ল দুজনেই। বুকের ভিতর তাজা বাতাস টেনে নিল ফের।

কাচা ইটে বানানো হয়েছিল রাস্তাটা। তাদের গ্রামের রাস্তা। সুন্দর মনোরম একটা গ্রাম। মায়ের মত মমতায় ঘিরে কলকল করে বয়ে চলা একটা নদী। গাছ-গাছালি আর বুনো ঝোপে সবুজ করে রাখা তাদের এ গ্রাম। দলবেঁধে নদীতে গোসল করতে যাওয়া। কে কতবার নদী পাড়ি দেবে তা নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা। বনে-জঙ্গলে হুটোপুটি। ভোরে মাখনের মত নরম ধুলায় পা ডুবিয়ে ছুটতে ছুটতে স্কুলে যাওয়া।

এত্ত আনন্দ আর সুখ সইল না বেশীদিন। ছোট্ট গ্রামে তাদের বাইরের সাথে খুব একটা যোগাযোগ ছিল না। ভালো করে জানবার বুঝবার আগেই একদিন দেখল। তারা দেখল দানবের মত কালো শ্বাস ফেলতে ফেলতে কনভয় আসতে। ছোপ ছোপ রঙা গাড়ি আর গাড়ি। একের পর এক গাড়ি। ক’দিন আগের বানানো এ কাচা ইটের রাস্তা তাদের নিতে পারেনি। মাটি আর খোয়ায় রাস্তাটা এখন বিভীষিকা। নিতে পারেনি তাদের এ গ্রামের মানুষেরাও। এ গ্রামের সব কিছুই আজ বিভীষিকা।

আলি মাটি খামচে ধরল। হ্যাঁ মাটি। এই মাটি আর তার নেই। এই মাটি আর তাদের নেই। তাদের কিচ্ছু নেই। মাটি নেই, গাছ নেই, নদী নেই, ধুলোয় ডোবা পথ নেই, গ্রাম নেই। কিচ্ছু নেই তাদের কিচ্ছুই নেই।

সেদিনের কথা আলি কিভাবে ভুলবে, কিভাবে সে ভুলতে পারে সেদিনের কথা! যেদিন গ্রামের আরো অনেক যুবকের সাথে তার বড় ভাই আব্বাস হাটু ভেঙে বসেছিল নদীর পাড়ে। হাত দুটো পিছনে বাঁধা। নিষ্ঠুর চেহারার এক দানব ঠোঁটের কোণ ঘেষে সুচাল উঠে যাওয়া গোঁফে তা দিতে দিতে বিকট চিৎকার করল ‘ফায়া—র’। আর সেকি আওয়াজ। ‘ট্যা ট্যা ট্যা ট্যাররর্রর…..’। কানে তালা লেগে গেল। দুহাতে কান চেপে সে লুকিয়ে দেখেছিল লাল রক্তে ভিজে গেল মাটি। তার ভাইয়ের রক্তে। তাজা রক্ত সেই যে তার বুকের মধ্যে আগুন জ্বালাল আজ পর্যন্ত তা আর নেভেনি। সে দেখেছিল সন্তান কোলে টেনে নেওয়ার মত তার বড় ভাইকে পরম মমতায় তাদের সেই নদী বুকে টেনে পানির আঁচলে ঢেকে দিল। যেন তার সন্তানের এ রক্তাক্ত দেহ সে কাউকে দেখাতে চায় না। নদীর পাড়-মাটি বেয়ে গড়াচ্ছিল রক্ত।

আলি মাটি খামচে ধরল। হ্যাঁ মাটি। এই মাটি আর তার নেই। এই মাটি আর তাদের নেই। তাদের কিচ্ছু নেই। মাটি নেই, গাছ নেই, নদী নেই, ধুলোয় ডোবা পথ নেই, গ্রাম নেই। কিচ্ছু নেই তাদের কিচ্ছুই নেই। সেই সেদিনের পর; হায়েনা আর দানবের আগ্রাসনের পর তাদের সব হারিয়েছে। গ্রামজুড়ে হায়েনার হাসির মত বাকি আছে শুধু পাকিস্তানি বাহিনির পৈশাচিক উল্লাস। নিজেদের সব কিছু নিজেদের করে নিতেই পালিয়ে গিয়ে তারা নাম লেখায় মুক্তি বাহিনিতে। দশ মাসের কঠিন অমানুষিক ট্রেনিং। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহন।

‘আলি ভাই’! মোস্তফার ডাকে চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। ‘আলি ভাই এসে পড়েছে’। তাদের দুজনের দায়িত্ব। একটা গাড়িকে গ্রামে ঢুকতে না দেওয়া। দু ইউনিটে তারা ভাগ হয়েছে। তারা দুজন গ্রামে ঢোকার রাস্তায়। বাকি তেরোজন গ্রামের পাকিস্তানি ছাওনি কাভার করবে। ডিসেম্বর মাস। জায়গায় জায়গায় মুখ থুবড়ে পড়ছে পাকিস্তানি পিশাচগুলো। তাই দ্বিগুণ আত্মবিশ্বাসে তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিয়েছে তাদের কমান্ডার। গ্রামের পাকিগুলোকে তেরোজন সামাল দিতে পারবে। ভয় শুধু নতুন বাহিনি এসে না পড়ার।
‘ভাই এসে পড়েছে’। দাঁতে দাঁত চেপে বসল দুজনের। প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হল শরীর। পকেট থেকে গ্রেনেড বের করল আলি। বিসমিল্লাহ বলে পিন খুলে গাড়ি লক্ষ করে ছুড়ল। এক, দুই, তিন …। বুম। খোলা হুড দিয়ে একদম মাঝখানে ফেটেছে বোমাটা। হাত পাচেক শূণ্যে উঠে গাড়ির কলকব্জা-টায়ার সব এদিক সেদিক ছিটকে গেল। আলি ও মোস্তফা একে অপরের দিকে তাকাল। দুজনের ঠোঁটেই ঝুলছে বিজয়ের হাসি।

আলি ভাই সাড়া পেয়ে চোখ মেলে দেখলেন আমাকে। ঠোঁটের কোণে হাসির আভা ফুটে উঠল তার। বললেন, ‘এই দেখ আমার গ্রাম। আমার সূর্য। আমার মাটি। এই দেখ আমার দেশ’। ভোরের পাখিরা তখন কলকাকলি শুরু করেছে। লাল সূর্যের প্রথম কিরণ এসে পড়েছে হাসিমাখা নিথর মুখটার উপর।

আটজনের আটজনই খতম। কিন্তু একি! গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে যে! ‘ট্যারর্ররররর ট্যা ট্যা ট্যাররররররর…..’। অনবরত ব্রাশ ফায়ার করতে করতে আগুনচোখা আরো দুটো গাড়ি আসছে। মূহুর্তেই চোখাচোখি আর সিদ্ধান্ত হল দুজনার। তিনটা গ্রেনেড আর কয়েক রাউন্ড গুলি আছে বাকি। পজিশন নিল আলি। ‘তুমি গ্রামে গিয়ে সবাইকে সাবধান করবে, আমি এদিকে কাভার করব’। মোস্তফাকে বলল আলি।
‘ভাই গেলে দুজনেই যাব নইলে দুজনেই থাকব’।
‘না তুমি গিয়ে সবাইকে সাবধান করবে। নয়তো আমাদের এতদিনের সব কষ্ট মাঠে মারা যাবে’।
‘আপনাকে রেখে আমি যাব না ভাই!’
‘মোস্তফা! বস কে?’
‘ইয়েস স্যার!’
‘এক্ষুণি চলে যাবে, সবাইকে সতর্ক করবে ঠিক আছে’!
‘ইয়েস স্যার!’
‘ইনশাল্লাহ কালকের সকাল আমাদের হবে। এ গ্রাম-নদী সব কিছু আমাদের হবে ইনশাল্লাহ। যাও এখন’।
আমি গ্রামের দিকে যেতে থাকলাম। কিছুদূর এগিয়ে একবার পিছন ফিরে তাকালাম। কী ভীষণ আত্মপ্রত্যয়মাখা দৃষ্টি সামনের দিকে আলি ভাইয়ের। সশ্রদ্ধ একটা স্যালুট দিয়ে আমি এগোতে লাগলাম গ্রামের দিকে।
‘তারপর কি হল দাদু’?
মোস্তফা সাহেব চশমাটা খুললেন চোখ থেকে। চোখটা ঝাপসা হয়ে এল কেন যেন। তারপর? তারপর আমরা গ্রামটাকে পাকিস্তানি হায়েনাদের কবল থেকে মুক্ত করলাম। রাত পার হয়ে গিয়েছিল। সাবধান আমি করেছিলাম। কিন্তু নতুন কেউ আসেনি আর। পাকি ছাওনি জয় করেই আমরা ছুটে গেলাম আলি ভাইয়ের জন্য। বেঁচে ছিল ও। সারা শরীর ভর্তি গুলির চিহ্ন। বাম হাতটা তো পুরোটাই ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল। রক্তে রঞ্জিত গোটা দেহ। দৌড়ে গেলাম আমি আলি ভাইয়ের কাছে। শ্বাস পড়ছিল। পূবাকাশে সূর্যটা তখন উঠি উঠি। আলি ভাই সাড়া পেয়ে চোখ মেলে দেখলেন আমাকে। ঠোঁটের কোণে হাসির আভা ফুটে উঠল তার। বললেন, ‘এই দেখ আমার গ্রাম। আমার সূর্য। আমার মাটি। এই দেখ আমার দেশ’। ভোরের পাখিরা তখন কলকাকলি শুরু করেছে। লাল সূর্যের প্রথম কিরণ এসে পড়েছে হাসিমাখা নিথর মুখটার উপর।

কথা শেষ করে পাঞ্জাবির খুটি দিয়ে চোখ মুছলেন মোস্তফা সাহেব। ‘তোমরা খেলা কর’ বলে উঠলেন তিনি। তিনতলার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। ১৬ ডিসেম্বর আজ। চারদিকে লাল সবুজের মেলা। বিজয়ের পতাকা উড়ছে সব জায়গায়। মাইকে বাজছে, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাীধনতার সংগ্রাম’। বিজয় দিবস উদযাপন করছে আজ বাংলাদেশ। একই সাথে বুকটা ব্যাথায় টনটন আর ফুলে উঠল গর্বে । কত ত্যাগ আর রক্ত বিসর্জনের পর আজ এই দেশটা তার। তার নিজের দেশ। পশ্চিমাকাশের লাল সূর্যের কিরণে চিকচিক করছিল ভেজা চোখের অশ্রু। বুক ভরে তিনি টেনে নিলেন তাজা বাতাস। নিজের দেশের। বাংলাদেশের।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *