আব্দুল্লাহ আফফান : ডিসেম্বরের শেষের দিকে ঠান্ডা ভালই পরেছে কুয়াশাও কম যায় না। সামিয়া লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তবু্ও তার ঠোটেঁ কেমন একটা হাসি লেগে আছে। লেপের উষ্ণতায় ঘুমটা ভালই হচ্ছে বুঝি। সুন্দর স্বপ্নও দেখছে বলে মনে হচ্ছে।
সূর্য পুরোপুরি না উঠলেও সূর্যের আলোকরশ্মি পূব আকাশে উঁকি দিয়েছে এখন।
সাদিকা(সামিয়ার আম্মু)ফজর নামাজ পড়ে জায়নামাজেই বসে ছিল। এলার্ম ঘড়িটা টুংটুং বেজে উঠল। সাদিকা জায়নামাজ ছেড়ে উঠে পড়ে। জায়নামাজটা গুছিয়ে রেখে সামিয়ার রুমে যান তিনি।
সামিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকে সামিয়া!সামিয়া মামনি উঠো। দেখ! কত ভোর হয়ে গেছে। সবাই উঠে গেছে শুধু তুমিই ঘুমিয়ে আছ ‘মা’। সামিয়া আড়মোড়া ভেঙ্গে লেপ থেকে মাথা বের করল। ঘুম চোখেই বলল, কি হয়েছে আম্মু। সকাল হয়ে গেছে উঠে পড়। আর এক মিনিট ঘুমাই না আম্মু। সামিয়ার আদুরে স্বর।
সারা রাত তো ঘুমালে। এখন আবার ঘুমাতে হবে? উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে নাও। আর এক মিনিটও না। সাদিকার কড়া জবাব। সামিয়া বুঝে গেছে আর কাজ হবে না। ‘উঠছি মামনি’ বলতে বলতে সামিয়া লেপ থেকে বের হল। বিছানা ছাড়ে।
সাদিকা মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে নাস্তা বানাতে গেল। ঘুমে ঢুলঢুল চোখে সামিয়া ঘর থেকে বের হয়। তার মুরগিটা ছানাদের নিয়ে উঠানে ঘুরে ঘুরে পোকা-মাকড় খাচ্ছে। গাছের পাতায় শিশির জমে আছে। ঠিক যেন মুক্তোর মতে জ্বলছে শিশিরগুলো। তাই-ই কিছুক্ষন পরপর টপটপ করে ঝরছে। শীতের কাপড় পরা হয়নি। তাই কেমন শীত শীত লাগছে সামিয়ার। এখন তার মনোযোগ মুরগিছানাদের দিকে। প্রতি সকালে নিজে ওঠে আগে তাদের খেতে দেয় সামিয়া । আজকে এখনো দেয়া হয়নি। সে ঘর থেকে চাল এনে উঠোনে ছিটিয়ে দিল। মুহুর্তেই মুরগীর বাচ্চাগুলো খাবার দেখে দৌঁড়ে চলে এলো। কী সুন্দর যে লাগছে বাচ্চাগুলোকে দেখতে! উফ! সামিয়ার মনটা আনন্দে নেচে উঠলো যেন।
সামিয়া ফ্রেশ হয়ে স্কুলের জন্য রেডি হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো একবার।
কি বানাচ্ছো আম্মু? রুটি বানাচ্ছি। কতক্ষণ লাগবে?
তোমার স্কুলের সময় কি হয়ে গেছে?
না আম্মু এখনো হয়নি।
তাহলে এতো তাড়া কিসের?
না এমনি বললাম।
প্লেট নিয়ে এসো তোমার নাস্তা দিচ্ছি।
তুমি খাবে না আম্মু?
হাতের কাজ শেষ করে খাব।
সামিয়া ঘর থেকে প্লেট নিয়ে এলো। সাদিকা ডিম ভেজে রুটি দিল। সাদিয়া প্লেট নিয়ে ঘরে গিয়ে খেতে বসল। ঝটপট খেয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বলল। যাই আম্মু।
ঠিকঠিক যেও। ঠিক আছে আম্মু।
সামিয়ার গায়ে আজ সুন্দর একটি সোয়েটার। সোয়েটারে বুকের অংশে সুন্দর ফুলের ছবি আকাঁ। সোয়েটারে কী দারুণ মানিয়েছে ওকে। একটা ছোট পরি মনে হচ্ছে তাকে। স্কুলে বন্ধুরা নিশ্চয় খুশি হবে। সামিয়া তাই ভাবছে আর মনে মনে আনন্দ পাচ্ছে এখন। ভাবতে ভাবতেই পথে রুপার সাথে দেখা হল ওর।
কেমন আছ রুপা?
ভাল, তুমি কেমন আছ সামিয়া! ভাল, খুব শীত পড়েছে না! হুম।লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমালে বেশ ভাল হত। সেটা কি আর বলতে হয়। কিন্তু কি আর করা, ক্লাসে যে আসতে হবে আমাদের।রুপা বলল, হ্যাঁ। তাই তো।
কথা বলতে বলতে ওরা ওদের ক্লাসের সামনে চলে এলো। ক্লাস শুরু হতে এখনো অনেক দেরি। সামনের বেঞ্চে বসার জন্যই সামিয়া আগে আগে এসে পড়ে। শুধু সেই নয় আরো অনেকে আছে যারা সামনের বেঞ্চে বসতে চায়। কে কার আগে আসতে পারে এ নিয়ে প্রতিযোগিতাও চলে তাদের। কোনদিন সে বসে কোনদিন অন্য কেউ।
আজ সামনের বেঞ্চে বসা হয়ে গেছ। তাই দ্বিতীয় সারির বেঞ্চেই বসল সামিয়া। ক্লাস শুরু হওয়ার আগে এখন কিছু সময় ফাঁকা। এ সময় ফাঁকা থাকলে সব মেয়েরাই খেলে। কেউ খেলে দড়িলাফ। কেউ গোল্লাছুট। কেউ খেলে কানামাছি। যে যেভাবে পারছে গ্রুপ করে খেলছে। সামিয়াও তাদের একদলে যোগ দিয়েছে।
সে খেলছে দড়িলাফ। দড়িলাফ খুব ভাল খেলতে পারে ও। সহজে ক্লান্তও হয়না। মেয়েদের খেলার শেষ নেই। এদিকে আজ হলো কী একটু সময় না যেতেই রঞ্জু বেল পিটিয়ে দিল। রঞ্জু বেল পেটাচ্ছে একনাগাড়ে। ঘন্টার শব্দ শুনে খেলা ফেলে হুড়োহুড়ি করে সবাই ক্লাসে এলো । ক্লাসে বসে একে অন্যের সাথে খেলা বিষয়ে কথা বলছে। তাদের কথার বিষয় , আজ কে খেলায় জিতেছে কে হেরেছে! এদের কেউ আফসোস করছে আজ ভালো খেলতে পারেনি বলে, কেউ রাগ ঝারছে খেলার সময় কম বলে।
সামিয়া কথার ফাকেঁ লক্ষ করলো লিমা আজও আগের ভারি ফুল হাতা গেঞ্জি পরে আছে। লিমার মুখটা মলিন। সামিয়া বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি যে এটা পরে আস তোমার শীত লাগেনা? লিমা বলেছিল, হালকা শীত পড়েছে। এজন্য আবার সোয়েটার লাগে নাকি। আজ সে অল্প অল্প কাপছেঁ। মুখে যাই বলুক না কেন শীতকে উপেক্ষা করতে পারছে না। সামিয়া আজ তাকে কিছুই বলল না। বলেই বা কী হবে। কিছু না কিছু বলে কাটিয়ে দিবে ও। হঠাৎ ক্লাসে মেম এসেছেন। তাই সে পড়ায় মন দিল।
দুই
আনিস ঢাকায় চাকরী করে। সেই সুবাদে ঢাকাতেই থাকতে হয়। বৃহস্পতিবারে অফিস করে বাড়ির পথে রওয়ানা হয় এবং শুক্রবার থেকে শনিবারে এসে অফিস করে। আনিসের একমাত্র মেয়ে সামিয়া। মেয়েকে প্রচন্ড ভালবাসে সে। মেয়ের জন্য তার সব ভালবাসা। মেয়েকে সময় দিতে পারে না বলেই মেয়ের প্রায় সব আবদার পূর্ণ করতে চেষ্টা করে আনিস। কিছু লাগবে কি না! তাই জানতে বাড়ীতে একটা ফোন করে আনিস।
সমিয়া পড়ছিল। মোবাইলের রিংটোন শুনে দৌঁড়ে এসে ফোন ধরল।
হ্যালো, আব্বু কেমন আছ!
হ্যাঁ মামনি ভাল আছি। তুমি কেমন আছ?
ভাল, আব্বু তুমি খেয়েছ?
না মামনি এখনো খাইনি।
সামিয়া অভিযোগ সুরে বলল, এখনো খাওনি কেন। অসুখ করবে তো। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। ঠিক আছে মামনি, ফোন রেখেই খাব।
আব্বু তুমি কবে আসবে?
কালকে আসব ।তোমার কিছু লাগবে?
আমার জন্য সুন্দর দেখে একটা সোয়েটার আনবে।
গতবার না একটি সোয়েটার কিনে দিয়েছি। ওটা চলবে না?
না! ওটাতো পুরোনো হয়ে গেছে। নতুন একটা লাগবে।
ঠিক আছে মামনি, আসার সময় নতুন সোয়েটার নিয়ে আসব।
ঠিক আছে।
আম্মু কোথায়।
মামনি তো রান্না ঘরে। খাবার গরম করছে।
আম্মুকে দাওতো একটু।
দিচ্ছি আব্বু।
সামিয়া ফোন নিয়ে রান্না ঘরে আম্মুর কাছে ফােন দেয়। সামিয়া ফোন দিয়ে ঘরে চলে যায়। সন্ধ্যার পর থেকে সামিয়া পড়েনি। আম্মু বকা দিবে বিধায় পড়ার টেবিলে বসে ছিল। তার পড়া আগেই হয়ে গিয়েছ। তাই পিছনের পড়া রিভাইজ দিচ্ছিল আর অপেক্ষা করছিল কখন আব্বু ফোন দিবে। কখন বাবার সোয়েটারের কথা বলবে সে। সোয়েটারের কথা বলা পর্যন্ত সে অস্বস্তিতে ভুগছিল। এখন স্বস্তি লাগছে তার। সোয়েটারের কথা ভেবে তার চোখ চকচক করছে। অজানা এক অনুভূতি মনে ভর করেছে সামিয়ার মনে। সোয়েটারটা কেমন হবে,তার রং কী! ডিজাইন কেমন হবে? সে এটা কী করবে এসব নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই যেন।
তিন
আনিসের বাড়ি আসতে আসতে রাত হয়ে গেল। রাস্তায়ও জ্যাম কম ছিল না।
বাড়ি এসেই সামিয়াকে কোলে তুলে নিল সে। বাবার কোলে উঠেই সামিয়া বলল,আব্বু আমার জন্য সোয়েটার এনেছ। হ্যাঁ, মামনি। এনেছি। ব্যাগেই আছে।
সামিয়া কোল থেকে নেমে ব্যাগ নিয়ে বসল। সারা ব্যাগ ঘেঁটে একাকার করে সোয়েটার বের করল। সোয়েটারটা লাল রঙে বুকের কাছে সুন্দর ছবি দেয়া। সামিয়া খুব আগ্রহ নিয়ে সোয়েটারটি দেখছে। আনিস মেয়ের এমন উৎসাহ দেখছে,আর মুচকি মুচকি হাসছে।
আনিস বলল,মামনি পছন্দ হয়েছে।
সামিয়া মাথা নাড়িয়ে বলল,হ্যাঁ আব্বু।
তুমি পরো। দেখি কেমন মানিয়েছে।
আনিস নিজেই সোয়েটারের ভাজ খুলে পরিয়ে বলল, বাহ! বেশ মানিয়েছে তো।
সামিয়া আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। ওকে আসলেই ভাল লাগছে।
বাপ-বেটির কি শুধু গল্প করলেই চলবে! না খাওয়া-দাওয়াও কিছু করতে হবে।
সাদিকা কথাটা বলে, টেবিলে খাবার সাজায়। সাদিকা খুব ভাল করেই জানে আজ বাপ-বেটি এক হয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প তো করবেই। আগে তো খাবারটা খেয়ে নিক।
রাতের খাবার খেয়ে বাপ-বেটি আবার গল্প করতে বসে। সামিয়া গল্প করতে করতে বলল, আব্বু তোমাকে একটা কথা বললে কি রাগ করবে। আনিস বলল রাগ করবো কেন? বল। আব্বু তুমি জানো এটা আমি কেন কিনেছি। আনিস কিছুটা অবাক হয়ে বলে, কেন আবার তোমার জন্য!
সামিয়া মাথা নাড়িয়ে বলে, আমার জন্য আনতে বলিনি।
তাহলে কার জন্য এনেছ?
আমাদের ক্লাসে একটি মেয়ে আছে। তার নাম লিমা। তার আব্বু না অনেক গরীব। তাই তার কোন সোয়েটার নেই। সে শীতে অনেক কষ্ট পায়। তার জন্য আনেছি।
এতে রাগ করার কি আছে। সে শীতে কষ্ট পাচ্ছে তার জন্য আনিয়েছ এটা তো ভাল কাজ। ভাল কাজ করলে কি কেউ রাগ করে! বোকা মেয়ে। সামিয়া আনিসকে জড়িয়ে ধরে বলে তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল আব্বু। আনিসও তার মেয়েকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরে।
চার
আজ সামিয়া অন্য দিনের চেয়ে আগে ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। তার গায়ে পুরোনো সোয়েটার। সামিয়া আগে লিমার বাড়ি যাবে তাই দ্রুত বের হয়েছে। সামিয়া লিমার বাড়ির এসে ডাকল, লিমা!
লিমার আম্মু বের হয়ে বলে, তুমি কে মা?
আসসালামু ওয়ালাইকুম, আন্টি আমি সামিয়া। লিমার সাথে পড়ি।
ওয়ালাইকুম আস সালাম! ও আচ্ছা, ভেতরে আসো। সামিয়া তার পেছনে পেছনে ঘরে যায়।
সামিয়া বসে বসে ঘরের চারদিক তাকিয়ে দেখছে। ঘরে তেমন আসবাপত্র না থাকলেও সবকিছু পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা। একটুপর লিমা পুরাতন জামাটি পরেই তার সামনে আসে।
কেমন আছ সামিয়া? সামিয়ার দৃষ্টি তখন ঘরের আসবাপত্রের দিকে। লিমা কখন এসেছে তা খেয়ালই করেনি। লিমার কন্ঠ শুনে চমকে তাকায় সে।
ভাল। তুমি কেমন আছ?
ভাল।
লিমা কিছু বলছে না। সামিয়াও কি বলবে বুঝতে পারছে না। অবশেষে কিছু না পেয়ে বলল, আংকেল কোথায়?
কাজে গেছে। ও। তোমাদের ঘরটা অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে লিমা।
লিমা এমনিতেই কথা কম বলে। তেমন কারো সাথে মিশে না। এখন আরো কথা বলছে না। মনে মনে রাগও হচ্ছে। তার হাতে অনেক কাজ পরে আছে। সেগুলো করে স্কুলে যেতে হবে। কিন্তু এখন সামিয়া এসে সব ভন্ডুল করে দিল। হয়তো আজ তার স্কুলে যাওয়া হবে না। আবার সামিয়াকেও কিছু বলতে পারছে না। বললে কি না কি মনে করে।
হঠাৎ সামিয়া ব্যাগ থেকে সোয়েটার বের করে বলল, লিমা এটা আব্বু তোমার জন্য কিনেছে। লিমা সোয়েটার হাতে দাড়িয়ে রইল। সে বুঝতে পারছেনা কী করবে! নিবে না দিয়ে দিবে। এসময় লিমার আম্মু একটি প্লেটে কয়েকটা পিঠা নিয়ে রুমে ঢুকল। লিমার হাতে সোয়েটার দেখে বলল, এটা কী?
সামিয়া বলল, আন্টি! আব্বু এটা লিমার জন্য কিনেছে।
লিমার আম্মু বলল, এটা আবার কী দরকার ছিল!
পরে লিমাকে বলল, নাও। বড়রা কিছু দিলে নিতে হয়। সামিয়াকে বলল, তুমি পিঠা খাও। সামিয়া পিঠা নিল। অল্প অল্প করে খাচ্ছে সে। সামিয়া হাতের পিঠা খেয়ে বলল, আন্টি আমি এখন তাহলে স্কুলে যাই।
এখনই চলে যাবে? আচ্ছা যাও। আবার এসো, কেমন।
জি, আন্টি।
লিমাকে বলে সামিয়া স্কুলের পথে হাটতে লাগলো। সামিয়ার খুব ভালো লাগছে এখন। স্কুলের বন্ধুকে সোয়েটারটা দিতে পেরে অনেক আনন্দ হচ্ছে তার। অার যাইহোক কমপক্ষে লিমার আর শীতে কষ্ট হবে না।